ইংল্যান্ডের গ্লচেষ্টারশায়ারের চেল্টহাম শহর । পৈত্রিক বাড়ীতে রোসিনা ডেস্পার্ড নামে এক তরুণী নিজের শোবার ঘরে সামান্য প্রসাধনের পর বিছানায় শুতে যাবার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে। কাপড় চোপড় বদল করতে করতে মনে হল সে যেন দোরগোড়ায় মায়ের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। কিন্তু বারান্দায় কাউকে সে দেখতে পেলনা। আরও এগিয়ে গিয়ে এদিকে ওদিকে নজর করতে হঠাৎ চোখে পড়লো সিঁড়ির গোড়ায় একজন মহিলা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন।পরনে তার লম্বা কালো পোশাক।হাতের রুমাল দিয়ে মুখ খানা ঢেকে আছেন।কয়েক সেকেন্ড ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি সিঁড়ি দিয়ে ধীর পদক্ষেপে নেমে গেলেন।রোসিনার হাতের মোমবাতি তখনি দপ করে নিভে গেল।জায়গাটা অন্ধকার হয়ে যাওয়াতে রোসিনার পক্ষে আর কিছু লক্ষ্য করা সম্ভবপর হল না।
ঘটনাটি ঘটে ১৮৮২ সালের জুন মাসে।পরবর্তী সাত বছর ধরে ডেস্পার্ড পরিবারের বিভিন্ন লোক এই অপচ্ছায়াটি দেখতে পেলেন।অপচ্ছায়াটির এই নিঃশব্দ আনাগোনা, ইতঃস্তত ঘুরে বেড়ানো, একটা যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো ।পরিবারের সকলেই তার এই আগমনকে সহজ ভাবে গ্রহণ করলেন।তারা সকলেই একে তাদের নিজেদের একজন বলে যেন মেনে নিলেন।একবার রোসিনা প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে তার উপস্থিতি লক্ষ্য করলেন।মহিলাটির শোকাহত ও বেদনার্ত চেহারা দেখে রোসিনার খুব মায়া হল।অন্তর তার করুণা ও সহানুভূতিতে উদ্বেল হয়ে উঠলো।রোসিনা ছায়ামূর্তির সঙ্গে কথা বলতে চাইলো।কিন্তু মহিলাটি উত্তর না দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন।তার মাথা তখন দুঃখভারে সামনের দিকে ঝুঁকে ছিল।নিজের দুঃখে তিনি এত মুহ্যমান ও আত্মনিমগ্ন ছিলেন যে অন্য কারো কথা যেন তার কানেই গেল না।
ডেস্পার্ড পরিবারের সকলে যখন খেতে বসতেন তখনও ঐ অপচ্ছায়াটি আবিভূর্ত হত।তাও আবার একই সময়ে-কাউকে সে দেখা দিত,কাউকে দিত না।আর-এই ঘটনা সমগ্র পরিবারের মনের ও স্নায়ুর উপর স্বভাবতঃই বেশী রকমের চাপ সৃস্টি করতো।দুই একজন দেখতে পাচ্ছে,বাকীরা কেউ দেখতে চাইলেও দেখতে পাচ্ছেনা-ব্যাপারটা কল্পনা করাও রীতিমত ভীতিজনক ।কোনদিন এই অপচ্ছায়া বাড়ীর দুই অতিথির মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরতো।অতিথিরা এই অপচ্ছায়ার সংবাদ অবগত নন।তারা দুজন হয়ত গল্পে মশ্গুল।তারা তার উপস্থিতি টের না পেলেও বাড়ীর অন্য কেউ তাকে ঠিকই দেখতে পেয়েছে।
রোসিনা আর তার বাবার সামনেই এই অপচ্ছায়াটির আবির্ভাব ঘটতো ঘন ঘন ।তারাই তাকে দেখতে পেতেন সবচাইতে বেশী।তারা যখন বাপ বেটিতে কথা বলতেন তখন অপচ্ছায়াটি তাদের কথার মাঝ খানে নানাভাবে বাঁধার সৃষ্টি করতে চেষ্টা করত।
মহিলাটির এই আবির্ভাবের ঘটনাবলী রোসিনা রোজই সযত্নে লিখে রাখতে লাগলো ।এই ভূতের পরিচয় বের করতে ও সে বেশ সচেষ্ট হয়ে উঠলো ।সম্ভবতঃ অপচ্ছায়াটি ইমোজেন সুইনহো নামে কোন এক রমণীর।এই বাড়ীর পূর্ববতী মালিকের হয়ত তিনি গৃহিণী বা উপপত্নী ছিলেন।ঝগড়া ঝাটির পর প্রেমিকটি হয়ত তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।তারপর তিনি ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে দুঃখ দারিদ্র্য ও সীমাহীন কষ্টের মধ্যে অন্য কোথাও মৃত্যুবরণ করেন।যে স্থানে তার সুখের দিনগুলো কেটেছিল সে স্থানের কথা ভুলতে না পেরেই হয়ত তার সেখানে এত ঘন ঘন আবির্ভাব ।
১৮৮৯ সন থেকে তাকে আর ঐ বাড়ীতে দেখা যেত না। সম্ভবতঃ রোসিনার বাবা মিঃ ডেস্পার্ড বাড়ীটিকে যাজক দিয়ে মন্ত্রপূত করেন বলে অপচ্ছায়া আর আসতে পারতোনা।ঘটনাটি তৎকালে আশে পাশের সকলের কৌতুহলের উদ্রেক করেছিল।এমনকি সাইকিকাল রিসার্চ সোসাইটির তরফ থেকে এ ব্যাপারে অনুসন্ধানও চালানো হয়।কিন্তু অপচ্ছায়ার আবির্ভাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মানুষের মন থেকে ব্যাপারটি মুছে যায়।এমনটি চেল্টহামের মানুষ গল্পটি প্রায় ভুলেই যায়।
উনসত্তর বছর পর ১৯৫৮ খৃষ্টাব্দে আবার এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। ডেস্পার্ডদের বাড়ীর অদূরে বেশ কয়েকটি বাড়ী-পরে এক বাড়ীতে একজন লোক একাকী বাস করতেন।তিনি হঠাৎ একরাতে অন্ধকারের ভেতর তার শোবার ঘরের জানালায় একটি অপচ্ছায়া দেখতে পেয়ে জেগে উঠলেন।অপচ্ছায়াটির অঙ্গে প্রাচীন ভিক্টোরিয়ান আমলের পোশাক।তার মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে।তাকে দেখে মনে হল, নিঃশব্দে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।মুখে তার একখানা রুমাল ধরা। ভদ্রলোক আতঙ্কে চীৎকার দিয়ে উঠতেই অপচ্ছায়াটি মিলিয়ে গেল।ভদ্রলোক এর আগে জীবনে কোনদিন ভূতের কথায় আমল দেননি।এইসব আতিপ্রাকৃত ব্যাপার স্যাপার তার কোনদিন কোন রকম আগ্রহও ছিলনা।পরবর্তী কয়েক বৎসর ধরে ঐ কালো জামা পরিহিতা মহিলার আনাগোনা চললো।কখনও তাকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরনীচ করতে দেখা যেত,কখনও দেখা যেত এ ঘরে ওঘরে তিনি পায়চারী করে বেড়াচ্ছেন।কখনও আবার করুণ ভাবে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। মুখ ঢেকে দিচ্ছেন তার রুমাল দিয়ে।অবশ্যই কাল তার দুঃখ ও বেদনা প্রশমিত করতে পারেনি কিন্তু তিনি কেন যেন ঠিকানা বদল করলেন তা আজও রহস্যময়ই থেকে গেছে।