কলোরাডোর একজন ব্যবসায়ী এবং সৌখিন সম্মোহক (hypnotist) একবার একজন গৃহিণীকে সম্মোহিত করেন। সম্মোহিত অবস্থায় মহিলাটি অদ্ভুত ভাবে অতীত ঘটনার চমকপ্রদ বিবরণ দিতে থাকেন। মহিলাটির বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে অনুসন্ধানকারীরা শতাব্দীপূর্বে মৃত একজন মহিলার সম্বন্ধে অনুসন্ধান চালাতে বাধ্য হন ও সেই মহিলাটি সম্বন্ধে আলোকপাত করতে সক্ষম হন।
কলোরেডোর পুয়েব্লো অঞ্চলের গৃহিণীটির নাম ছিল রুথ সাইমন্স্ ।তাঁর আসল নামটি কখনও একটি বারের জন্যও তিনি উচ্চারণ করেন নি.১৯৫২ সনে আচ্ছন্ন অবস্থায় তিনি সবসময় নিজেকে ব্রাইডি মারফি নামে পরিচয় দেন। ঐ অবস্থায় তিনি বিস্তৃতভাবে তার ছেলেবেলার কাহিনী বর্ণনা করেন। উনবিংশ শতাব্দীতে আয়ার্ল্যান্ডে কিভাবে তার বিয়ে সংঘটিত হয়, কিভাবে তিনি মৃত্যু বরণ করেন, কিভাবে তার অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পাদিত হয়, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তার ববরণ দেন। উনষাট বছর পরে আবার তিনি অ্যামেরিকায় জন্ম গ্রহণ করেন বলে দাবী করেন।
সম্মোহক মোরে বার্নষ্টিন ১৯৫৬ খৃষ্টাব্দে এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে একটি বই লেখেন। বইটির নাম ছিল “দা সার্চ ফর ব্রাইডি মার্ফ”। বইটি বাজারের সেরা বিক্রিত বই হিসাবে গণ্য হয় ।
বার্নষ্টিন “হিপ্নটিক রিগ্রেশনের” পন্থা অনুসরণ করেন। এতে যাকে সম্মোহিত করা হয় তাকে তার ছেলেবেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর তাকে আরো এক ধাপ পিছনে নিয়ে যান-ঠিক তার জন্মের আগের পর্যায়ে ।-আর আবাক বিস্ময়ে তিনি লক্ষ্য করেন যে তিনি ব্রাইডি মারফির সঙ্গে কথোপকথন করছেন।
এই অদ্ভুত ঘটনার শুরু হয় ১৮০৬ খৃষ্টাব্দে। তখন ব্রাইডির বয়স ছিল মাত্র আট বছর। মারফি তখন কর্ক নামে ছোট্র একটি অঞ্চলে বাস করতেন। তার পিতার নাম ছিল ডানকান মারফি, মাতার নাম ক্যাথলিন। ব্রাইডির পিতা একজন আইনজীবী ছিলেন। তিনি তার পিতা মাতার অত্যন্ত আদরের কন্যা ছিলেন। ১৭ বৎসর বয়সে সিন ব্রায়ান ম্যাকারর্থী নামে অন্য একজন আইনজীবীর সঙ্গে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তারপর তারা বেলফাস্ট শহরে চলে যান।
নিজের অন্তেষ্টি ক্রিয়া প্রত্যক্ষঃ
উঁচুজায়গা থেকে পতনের ফলে তার মৃত্যু হয় বলে ব্রাইডি উল্লেখ করেন। নিজের অন্তেষ্টিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করার ব্যপারে তিনি বলেন কোন একটি নির্দিষ্ট সমাধি ক্ষেত্রে তার সমাধিস্তম্ভ অবস্থিত। তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের উল্লেখ ও তিনি করেন। তিনি স্মৃতিচারণ করার মত করে বলেন, এ জীবনে তো আনন্দ নেই-না আছে কোন বেদনা। যাই হোক তিনি আমেরিকায় আবার জন্মগ্রহন করেন। কিন্তু কিভাবে এ ঘটনা ঘটল তাঁর সম্বন্ধে তিনি কিছু বলতে পারেন না।
রুথ সাইমন্স মিউ ওয়েস্ট জণ্ম গ্রহণ করেন।জীবনে কোন দিন তিনি আয়ারর্ল্যান্ডে যাননি। তার ভাষায় বিন্দু মাত্র আয়ারর্ল্যান্ডের ভাষার ছাপ নেই।
ব্রাইডির বর্ণিত ঘটনাবলী ব্রাইনষ্টিনের বই লেখার আগে ভাল ভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। বইটি যেহেতু বেষ্ট সেলারের মর্যাদা পেল সে জন্য প্রতিবেদকরা প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা শুরু করলেন।ঘটনাবলীর সুত্র ধরে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করার জন্য আয়ারর্ল্যান্ডে লোক পাঠানো হল। সেখানে কোনরকম অফিসিয়াল রেকর্ড পাওয়া গেলনা।আর যখন অফিসিয়াল কোন রেকর্ড পাওয়া গেল না তখনই এই জাতিস্মর সম্বন্ধে লোকের মনে সন্দেহের উদ্রেক হল। ব্রাইডি তার জন্ম তারিখ ১৭৯৮ খৃস্টাব্দের ২০ শে ডিসেম্বর বলে উল্লেখ করেন। কর্ক ছিল তার জন্মস্থান । তার মৃত্যুর সন ১৮৬৪ বলে বর্ণনা করেন। জন্ম বা মৃত্যুর সন সম্বন্ধে কোনরূপ সরকারী নথি পত্র পাওয়া যায়নি। “মেডোজ” নামে যে কাঠের বাড়ীতে তিনি বাস করতেন বলে দাবী করেন, তারও কোন হদিশ পাওয়া যায় নি। প্রকৃতপক্ষে আয়ারর্ল্যান্ডের বেশীর ভাগ বাড়ীই ইট বা পাথরে তৈরী হত। তাঁর স্বামীর নাম সিন বলে উচ্চারণ করলেও কখনও কখনও সম্মোহিত অবস্থায় তাকে শন বলেও উল্লেখ করতেন। তাঁর স্বামীর তিনি ব্রায়ান নামটি ছিল রুথ সায়মনেরও বিবাহিত স্বামী মধ্য নাম।
কিন্তু একটা বিষয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে তার বিস্তৃত বিবরণের বেশীর ভাগের সঙ্গেই মিল খুঁজে পাওয়া যেত ।উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় তিনি এনট্রিম কোষ্ট লাইন সম্বন্ধে যে বর্ণনা দেন তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। ঠিক তেমনি তার বেলফাষ্ট থেকে কর্ক পর্যন্ত ভ্রমণ বৃতান্তও হুবহু এক। তিনি বলেন তিনি সেন্ট থেরেসার গির্জায় উপাসনায় যেতেন।সেখানে তার বর্ণনা অনুযায়ী একটি গির্জা আছে বটে কিন্তু সেটি ১৯১১ সালের আগে নির্মিত হয় নি।
যুবতি ব্রাইডি সুবিধামত দরে যে মুদির দোকানটিতে কেনা কাঁটা করতেন তার নাম তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন দোকানটির নাম ‘ফার’ । অনুসন্ধানের পর জানা যায় যে ঐ নামে একটি মুদির দোকান ঐ অঞ্চলে ছিল ঠিকই।
ব্রাইডির উল্লেখিত জীবন বৃত্তান্তের মধ্যে অনেক ফাঁক ফোকর থেকে গেলেও এটা উনিশ শতকের আয়ার্ল্যান্ডের জীবনযাত্রার একটি সুপরিচিত চিত্র হিসাবে নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা যায় ।সুদূর অতীতের এধরনের জীবন কাহিনী রুথ সাইমন্স্ এর পক্ষে তুলে ধরা অস্বাভাবিক। মনোরোগ ও মনোবিদ্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এই উপাত্তের পুংখানুপুংখ বিচার বিশ্লেষণ করেন। সম্মোহনের মাধ্যমে বহুবার এই বিশারদেরা এধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। যাদের উপর এই সম্মোহন প্রক্রিয়া চালানো হয় তাদের অনেকের বর্ণনাই তাঁদের ধারনার অনুকুলে রায় দেয়। তাদের উপর একটি সঙ্কেত প্রয়োগ মাত্র তারা কার্যকারী হয়ে ওঠে। আর অবচেতন মনে তারা যেন বুঝতে পারে ঐ জবাবটাই প্রশ্ন কর্তা শুনবার আশা করছেন।
এই ধরণের সম্মোহন ক্রিয়া ব্যবহারের মূল কারণ হচ্ছে রোগীর মনের বা মস্তিস্কের অবিশ্বাস্য স্তূপীকৃত ঘটনার ভিড় হালকা করে বের করে আনা ।উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে রোগী যে কোন বিদেশী ভাষায় অনর্গল কথা বলে যায়-যে ভাষা সে ছেলে বেলায় কিংবা জীবনের কোন সময় ব্যবহার করেনি। এমনকি সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় তার পক্ষে সেই ভাষা বলা দূরে থাকুক, বোঝার ক্ষমতাও নাই।
সভ্যভাষণ থেকে দূরেঃ
যার ওপরে এই পদ্ধতি আরোপ করা হয় সে ছেলে বেলার বহু ভুলে যাওয়া কবিতার পংক্তি হুবহু উল্লেখ করে যেতে পারে। যদিও যাকে সম্মোহিত করা হয় সে স্বয়ংক্রিয় ভাবে সত্য কথা বলে না। এমনকি সন্তোষজনক উত্তর দেবার হাজার চেষ্টা থাকলেও তা পারে না।
বর্ণাষ্টিন স্বীকার করেন যে তিনি রুথ সায়মনস্কে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে রুথ সায়মনস্ বলে সম্বোধন করা সত্বেও ব্রাইডি মারফি তার কথা বলা শুরু করে।
রুথ সায়মনস্কে যে সব বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষানিরীক্ষা করেন তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সত্য উদ্ঘাটন করতে হলে বা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হলে তার আয়ারর্ল্যান্ডের ছেলেবেলার ঘটনা জানতে চাওয়া ঠিক হবে না। তাদের উচিৎ হবে রুথ সায়মনস্র ছেলেবেলার ঘটনা অনুসন্ধান করা এবং আরও জানতে হবে ছেলেবেলার তার সঙ্গে তার পিতামাতার সম্পর্ক কেমন ছিল।
বর্ণাষ্টিন লিখিত পুস্তকে উল্লেখ আছে যে রুথ সায়মন্স একজন নরওয়েজিয়ান চাচার কাছে লালিত পালিত হন। আর তার চাচী ছিলেন জার্মান স্কটিশ ও আইরিশ এর সংমিশ্রণ ।
তবে এটা সত্য , রুথ সায়মনস্এর নিজের পিতা মাতা আংশিকভাবে আইরিশ ছিলেন না এবং রুথ তাদের সঙ্গে মাত্র বছর তিনেক বসবাস করেন।
বৈজ্ঞানিকরা উপসংহারে একথা বলে সন্তষ্টি লাভ করতে চান যে ব্রাইডি মারফি যাকিছু বলুক তা রুথেরই শৈশব কালের ভুলে যাওয়া কাহিনী। তারা আরও বিশ্বাস করেন যে এই ধাঁধার জট তখনই খোলা সম্ভব হবে যখন রুথ সম্মোহনের মাধ্যমে তার নিজের শিশুকালের পরীক্ষার অনুমতি দিবো।