“আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম,

তবে আমি ডায়োজিনিস হতেই চাইতাম। “

-আলেকজান্ডার

দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার সম্পর্কে জানার ইচ্ছে, আগ্রহ আমাদের সবারই আছে। আর অল্পবিস্তর জানাশুনা বা নিজস্ব ধ্যানধারণাও তৈরি হয়েছে অনেকের। কারো একটু কম, তো কারো বেশি। এর কারণ অবশ্যই তাঁর স্বপ্ন, তাঁর পুরো পৃথিবীতে বিজয় অভিযানের পরিকল্পনা ;যা তাঁকে ইতিহাসে ”আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট “করে তুলেছে।

এখন ভাববার বিষয় এই যে, এত বিখ্যাত একজন ব্যাক্তি কেন আলেকজান্ডার না হলে ডায়োজিনিস হওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ করেন। কেন অন্য কিছুর থেকে আলেকজান্ডারের পরেই তিনি ডায়োজিনিস হওয়াকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন?  আর কে’ই বা এই ডায়োজিনিস?

চিত্রকর জন উইলিয়ামের চোখে টবের ভেতর ডায়োজিনিসের আবাস

চলুন তাহলে মনের প্রশ্নগুলোকে প্রশ্রয় দেয়াই যাক।

সিনিকদের মধ্যে সবচেয়ে অসাধারণ দার্শনিক ছিলেন ডায়োজিনিস। অবশ্য ক্ষ্যাপাটে দার্শনিক হিসেবেও তিনি আখ্যায়িত হন।

একজন রহস্যময় মানুষ ছিলেন ডায়োজিনিস। যৎসামান্য পোশাক পরে রাস্তার ধারের একটা টবে ছিল তাঁর বাস।(সচরাচর ড্রেনের বড় পাইপের ভেতর যেমনটি থাকতে দেখা যায়, অনেকটা সেইরকম।)নিজের সম্পদ বলতে তাঁর ছিলো কেবল একটা লাঠি, লন্ঠন, পরিধেয় সামান্য শতছিদ্র কাপড় এবং একটি খাবার পাত্র। আহরের যোগাড় হতো ভিক্ষায়।

ডায়োজেনস একজন সৎ লোকের জন্য অনুসন্ধান করছেন (1640–1647)

আর ভিক্ষা করতে গিয়ে ডায়োজিনিস কি বলতেন জানো?বলতেন, ” তুমি যদি অন্য কাউকে ভিক্ষা দিয়ে থাকো,তবে আমাকেও দাও।আর আজ অব্দি যদি কাউকে না দিয়ে থাকো,তবে আমাকে দিয়ে শুরু করো।”

ডায়োজিনিসের নামে মাঝে মধ্যে চুরি করার বা অন্যের জিনিস কেড়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে। তখন তাঁকে কেউ যদি প্রশ্ন করে, “আপনি তো প্রয়োজনের উর্ধ্বে বসবাস করেন,তো মানুষের জিনিস কেড়ে নেন কেন? ” অদ্ভুত এক ধারায় তিনি উত্তর দিতেন, “আমি অহেতুক প্রয়োজনের উর্ধ্বে বসবাস করি।এ জগতের সমস্ত জিনিস হচ্ছে ঈশ্বরের। আর জ্ঞানীরা ঈশ্বরের বন্ধু। তাই এ জগতের সব কিছুতেই জ্ঞানীদের অধিকার আছে। “

ডায়োজিনিস এবং কুকুরেরা, চিত্রকর জেন-লিয়ন জেরোম

এমনই আরো কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত কাহিনী বলি ডায়োজিনিসের।যেখানে তাঁর প্রজ্ঞার,নির্মোহ জীবনযাপনের সহজ-সরল তবে তখনকার প্রথার বিপরীত চিন্তাধারার প্রকাশ পায়।

   ডায়োজিনিসকে নিজ শহর সিনোপ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি এর জন্য কখনোই আক্ষেপ করেননি।বরং বলতেন, “নির্বাসনই আমাকে দার্শনিক বানিয়েছে। “তাঁকে দাস হিসেবে বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হলে তিনি বলেছিলেন, ” আমাকে এমন কারো কাছে বিক্রি করো যার মনিবের প্রয়োজন। “

 একবার ডায়োজিনিসকে একটি মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে সেটির কাছে ভিক্ষা চাইতে দেখা যায়। লোকজন তা অবলোকন করে জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যাপার?” ডায়োজিনিস উত্তরে বললেন, “প্রত্যাখ্যাত হবার অনুশীলন করছি। “

 খেয়াল করুন  তো, তাঁর এ সহজ উত্তর কতটা গূঢ় অর্থ বহন করে! সত্যিই তিনি  একজন প্রজ্ঞাদীপ্ত দার্শনিক।

ডায়োজিনিসকে প্রায়শই কুকুর বলে বিদ্রুপ করা হতো। তিনি অবশ্য এমন ডাকনাম পছন্দই করতেন এবং বলতেন, “অন্য কুকুররা তাদের শত্রুদের কামড়ায় আর আমি আমার বন্ধুদের কামড়াই,তাদের রক্ষা করতে। “

একদিন কি হলো,ডায়োজিনিস লন্ঠন হাতে বাজারে উপস্থিত। এই বুড়ো পাগলাটে লোকটার হাতে জ্বালানো লন্ঠন দেখে সবাই খুব রসিকতা করলো,আনন্দও পেল বেশ। তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো,” এই ভরদুপুরে লন্ঠন হাতে কোথায় চললেন?”

ডায়োজিনিস বললেন, “আমি আসল মানুষ খুঁজছি। গ্রীসের কোথায় মানুষ পাওয়া যাবে, কেউ বলতে পারবে?”

ডায়োজিনিস বিভিন্ন পন্থায় জনগণকে তাঁর সিনিক দর্শন জানাতে আগ্রহী ছিলেন। একবার তিনি দর্শনের নানান বিষয় নিয়ে আশেপাশের কিছু মানুষের সামনে আলোচনা করছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি লক্ষ্য করেন,মানুষেরা ধীরে ধীরে কেটে পড়ছে এবং নিজেদের কাজে মনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। তখন তিনি এক অদ্ভুত কাহিনী করলেন।হঠাৎ তাঁর আলোচনা থামিয়ে নাচতে আরম্ভ করলেন। তা দেখে সবাই আবার তাঁকে ঘিরে ধরলো।নাচ থামিয়ে ডায়োজিনিস তীব্র তিরস্কারের সাথে বললেন, “বুরবকের দল!ভালো কথায় আগ্রহ নেই, ভাঁড়ামিতে ঠিকই আগ্রহ! “

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ডায়োজিনস কে দেখতে এসেছেন

তাঁর কোনো বিলাস দ্রব্য ছিলো না,অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটি সম্পদ ব্যাতিরেকে।তিনি একটি পাত্রে পানি পান করতেন।চলার পথে একদিন তিনি এক শিশুকে জলাধার থেকে হাত দিয়ে পানি উঠিয়ে পান করতে দেখলেন।তখন তিনি আক্ষেপ করে বলে উঠলেন, “হায়!একটি শিশু সাধারণ জীবনযাপনে আমাকে হারিয়ে দিলো।”ক্ষণকাল বিলম্ব না করে তিনি তাঁর পাত্রটিকে ছুড়ে ফেলে দেন।

এবার আসি, আলেকজান্ডারের সাথে ডায়োজিনিসের কিছু কাহিনী নিয়ে। আলেকজান্ডার জ্ঞানী -গুণীদের খুব কদর করতেন। প্রথমবার যখন ডায়োজিনিসের কথা শুনেছিলেন, ঠিক করে নেন তাঁর সাথে দেখা করবেন।ডায়োজিনিসের আবাস_পরিত্যক্ত বিশাল একটা টব বা মদের ভার, সেখানে চলে গেলেন আলেকজান্ডার।

ডায়োজিনিসের সামনে উপস্থিত হয়ে নিজ পরিচয়ে তিনি বললেন, “আমি আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট।”

ডায়োজিনিস বললেন, “আমি ডায়োজিনিস দ্যা সিনিক।”

আলেকজান্ডার তাঁকে বললেন, “আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন না?”

প্রতুত্ত্যরে ডায়োজিনিস বলে উঠলেন, “কেন কেন? তোমাকে ভয় পেতে যাবো কেন? তুমি ভালো না খারাপ? “

আলেকজান্ডার বললেন,”অবশ্যই ভালো। “

তখন ডায়োজিনিস বললেন, “তো ভালো জিনিসকে কেউ ভয় পায় বুঝি? “

প্রথমবারের এমন কথোপকথন আলেকজান্ডারকে মুগ্ধ করেছিল।এরপর আরো বেশ কয়েকবার আসেন ডায়োজিনিসের কাছে।

 আরেকবার ডায়োজিনিস তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,” বাপু,তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?”

আলেকজান্ডার বললেন,”সমস্ত গ্রীস নিজের আয়ত্তে আনা।”

-তারপর?

-সমস্ত এশিয়া মাইনর নিজের আয়ত্তে আনা।

-তারপর?

-সমস্ত পৃথিবী নিজের আয়ত্তে আনা।

একগুঁয়ে ডায়োজিনিস তাঁর একই প্রশ্ন চালিয়ে গেলেন, “তারপর? “

– তারপর আর কি! বাড়িতে বসে বসে বিশ্রাম নেবো।

ডায়োজিনিস তখন মিটিমিটি উপহাসের হাসি হেসে বললেন, “হে হে, সে কাজটি এখন করলেই তো পারো।”

ডায়োজিনিসের এমন সব অদ্ভুত জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে আলেকজান্ডার নিজেকে তাঁর শিষ্যরূপে সমর্পণ করেন। এমনই একদিন গুরুর জন্য কিছু করার ইচ্ছে জাগলো আলেকজান্ডারের।ডায়োজিনিস তখন তাঁর ভাড়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, আর শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন।

আলেকজান্ডার তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে ডায়োজিনিস, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?”

ডায়োজিনিস শান্তভাবে বললেন, “তুমি আমার সামনে থেকে সরো তো বাপু!তোমার জন্য আমি রোদ পোহাতে পারছি না। “

 বিশাল এক সাম্রাজ্যের নরপতি, এতো ক্ষমতাবান একজন মানুষ নিজে যেচে তাঁকে কিছু দিতে চাইলেন, তবে এর সোজাসাপ্টা প্রত্যাখ্যান করলেন ডায়োজিনিস। কেননা যদিও তিনি দরিদ্র ছিলেন তথাপি তিনি ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন। প্রাচীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজারও তাঁকে দেওয়ার মতো কিছু ছিল না।প্রকৃতির নিয়মে বেঁচে থাকাই ছিল তাঁর আদর্শ। সেই মুহুর্তে প্রকৃতির উপাদান রোদ ছাড়া তাঁর অন্য কোনো প্রয়োজন ছিলো না।বস্তুত, প্রজ্ঞা তো সেটাই, কী প্রয়োজন আর কী প্রয়োজন নয় তা জানা।

আলেকজান্ডারের প্রতি এই দার্শনিকের এমন নির্লিপ্ত ভাব এবং এ ধরনের উত্তর শুনে আশ্চর্যান্বিত হলেন তিনি। তাঁর ভিতর জ্ঞানের এমন এক প্রজ্জ্বলিত আলোকশিখা দেখতে পেলেন আলেকজান্ডার, যা দার্শনিকদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা বহুগুণে বৃদ্ধি করে ।

টার্কির সিনোপ শহরে ডায়োজিনিসের ভাস্কর্য, লণ্ঠন জ্বালিয়ে তিনি মানুষের খোঁজ করছেন

আর তখনই আলেকজান্ডার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বলেন,”আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম, তবে ডায়োজিনিস হতেই চাইতাম। “

ডায়োজিনিসের প্রজ্ঞার সাথে পরিচিত হতে হলে,আমাদের তাঁর কিছু অমূল্য বাণী সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে।

 ডায়োজিনিসের অমূল্য বাণী :

  • একজন জ্ঞানীকে আবিষ্কার করতে আরেকজন জ্ঞানীর প্রয়োজন হয়।
  • তারই সবচেয়ে বেশি আছে, যে অল্পে তুষ্ট।
  • কুকুর এবং দার্শনিকেরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে থাকে, কিন্তু সবচেয়ে কম প্রতিদান পায়।
  • রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে তার যুবসমাজের শিক্ষা।
  • ছাত্র খারাপ আচরণ করলে তার শিক্ষককে চবকানো হবে না কেন?
  • ঈশ্বর হবার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো তাঁর কারো কাছে হাত পাতা লাগে না। যারা ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি, তাদের প্রয়োজন তাই খুব সামান্য।
  • একজন ধনীর বাড়িতে থুতু ফেলবার মতো কোনো জায়গাই থাকে না, তার চেহারা ছাড়া।

   বর্তমান সময়ে, যেখানে কেবল যশ-খ্যাতি-ঐশ্বর্যের পেছনে নিরন্তর ছুটে চলা এবং বিলাসিতার চাদরে মোড়ে থাকার প্রবণতা ; সেখানে ডায়োজিনিস দ্যা সিনিক হতে পারেন আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর প্রজ্ঞার  এমন সুচারু ব্যবহার এবং নির্মোহ জীবনযাপন থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। ডায়োজিনিসের উদ্ভট উদ্ভট কর্মকাণ্ডের পেছনে আসল উদ্দেশ্য ছিলো স্থানীয়দের তত্ত্ব বিশ্লেষণে না গিয়ে সহজ উপায়ে বাস্তব জীবনের শিক্ষা দেওয়া।

 আশা করি, ডায়োজিনিসের আদর্শকে খানিকটা হলেও ধারণ করা সম্ভব হলে, আমাদেরও মানসিক শান্তি অনুভূত হবে।