পারস্য বা আচেমেনিড সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে জয় করার পর বিশ্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর ইচ্ছা জাগে ম্যাসিডোনিয়ার সেই অহংকারী যুবরাজ, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর মনে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ সালে তিনি ভারত জয় করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। ইতিমধ্যেই নিজেকে তিনি পারস্যের ‘রাজাদের রাজা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
ভারত অভিমুখে অগ্রসর হলেও, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫ সালে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ শুরু হয়। সৈন্য ও জেনারেলরা জানায়, তারা অত্যন্ত ক্লান্ত—ঘরে ফিরে বিশ্রাম নিতে ও পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে চায়। ফলে আলেকজান্ডারকে সেই মুহূর্তে পিছু হটতে হয়। ইতিহাসে এটি এমন এক মুহূর্ত, যা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের গতিপথকেই পরিবর্তন করে দেয়।
আলেকজান্ডারের প্রাচ্য অভিযানের ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের সংস্কৃতি, বেশভূষা, এমনকি রন্ধনশৈলীতেও এক বিস্ময়কর মেলবন্ধন তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, আজকের দিনে জাফরান উপমহাদেশীয় রান্নার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসলা। আর এই জাফরানই ছিল পশ্চিমা রান্নাতেও সমান জনপ্রিয়। কেউ কেউ এমনও মনে করেন, গ্রিক সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই পশ্চিমের এই মসলা প্রাচ্যে আমদানি হয়েছিল। তবে এটি প্রমাণিত নয়।

জাফরান ও যুবক আলেকজান্ডারের সৌন্দর্যচর্চা
আলেকজান্ডার নিজে জাফরান ব্যবহার করতেন প্রসাধনী হিসেবে। তিনি প্রচুর পরিমাণে জাফরান সঙ্গে রাখতেন, কারণ তিনি এটি চুলের যত্নে কন্ডিশনার হিসেবে ব্যবহার করতেন। জাফরানের এই সোনালি আভা দিয়েই তিনি তার চুলের আকর্ষণীয় রং তৈরি করতেন। মনে করা হয়, এই মসলার বাণিজ্যই পরবর্তীতে উপমহাদেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রুট বা পথ খুলে দেয়। মসলার এই পথই আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে। ঐ পথ ধরেই রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
এবার আসি খাদ্য প্রসঙ্গে। ভারতীয় উপমহাদেশে “ভর্তা” একটি বিশেষ জনপ্রিয় পদ। ভাজা বেগুনের সঙ্গে রসুন, ধনেপাতা ও পুদিনা মিশিয়ে তৈরি হয় এক অনন্য স্বাদের খাবার। গ্রিসের বিখ্যাত খাবার “মেজে”, মধ্যপ্রাচ্যে “বাবা গনোশ”, রোমানিয়া ও হাঙ্গেরিতে “সালাতা দে ভিনেতে” এবং ফ্রান্সে “ক্যাভিয়ার দ’ওবারজিন”—সবই এই খাবারের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এই পদগুলির প্রস্তুতপ্রণালী প্রায় এক হলেও মসলা ও উপকরণে কিছু পার্থক্য রয়েছে। খাদ্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই রেসিপিগুলির জন্ম ইন্দো-গ্রিক সাম্রাজ্যের সময়কালেই।
যখন আলেকজান্ডারের সেনারা ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছিল, তখন তারা এখানকার নানা খাবারের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং সেগুলোকে নিজের মতো রূপ দেয়। যেমন আমরা যে “রায়তা”-র কথা বলি, সেটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন পদ হলেও গ্রিক রান্নাতেও দই-ভিত্তিক অনুরূপ রেসিপি দেখা যায়।

“ভর্তা ও বাবা গনোশ — দুই সংস্কৃতির এক প্লেট
রুটি তৈরির ক্ষেত্রেও দুই সংস্কৃতির মিল আছে—ভারতের নান রুটি আর গ্রিক “পিটা” প্রায় এক রকম। পার্থক্য শুধু এই যে, ভারতীয় বা পাঞ্জাবি নান তৈরিতে ময়দার সঙ্গে দই ও ঘি মেশানো হয়, অথচ গ্রিক পিটা তৈরি হয় এগুলো ছাড়াই।
এবার আসি ভাতের কথায়। আলেকজান্ডারের অভিযানের মাধ্যমে ভাত পশ্চিমে পৌঁছে যায়। ব্যাক্ট্রিয়ান যুদ্ধের সময় ম্যাসিডোনিয়ান সেনারা স্থানীয় খাবার হিসেবে ভাত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তবে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই চাল গুঁড়া আকারে ব্যবহৃত হতো—প্রসাধনী বা ওষধি হিসেবে। আলেকজান্দ্রিয়ার কবি আইসোটোপ (Isotopes of Alexandria) তার একটি কবিতায় রাজকীয় ভোজে ভাতের রোলের উল্লেখ করেছেন, যা আলেকজান্ডারের মৃত্যুর দুই শতাব্দী পরের সময়ের।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায় সেনাপতিদের মধ্যে। তাদের মাধ্যমেই বৌদ্ধ ধর্ম পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, যোগব্যায়াম বা “যোগ” অনুশীলনও এই যোগাযোগের মাধ্যমেই গ্রিক ও অন্যান্য সভ্যতায় প্রবেশ করে। অন্যদিকে, বুদ্ধকে মূর্তির মাধ্যমে উপস্থাপনের ধারা এই সময়েই গ্রিক শিল্পকলার প্রভাবে ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
সুতরাং, আলেকজান্ডারের প্রাচ্যে আগমন শুধু রাজনৈতিক নয়—বিশ্বসংস্কৃতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে।
বৌদ্ধরা ছিলেন নিরামিষভোজী। আসলে নিরামিষ সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল দুই অসাধারণ মনীষীর চিন্তার মিলনে—পিথাগোরাস ও বুদ্ধের মাধ্যমে।
পিথাগোরাসের মতে, জীবিত প্রাণীকে হত্যা না করে নিরামিষ ভোজনের মধ্য দিয়েই শরীর ও মনকে সুস্থ রাখা সম্ভব। বুদ্ধও বলেছিলেন, মানুষ যদি মাছ-মাংস ভক্ষণ থেকে বিরত থাকে, তবে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে শান্তিতে থাকবে। ফলস্বরূপ, পিথাগোরাসের অনুসারীরাও ধীরে ধীরে নিরামিষ জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

আলেকজান্ডারের প্রাচ্য অভিযানের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ও খাদ্য সংযোগ
শেষে বলা যায়, আলেকজান্ডারের প্রাচ্যে আগমন শুধু এক সাম্রাজ্যের নয়, বরং সভ্যতার টেবিলে ভাগ করা এক প্লেট ইতিহাসের গল্প।