ঊনিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম কৃষক বিদ্রোহ, যে বিদ্রোহ দেশীয় জমিদার, জোতদারদের সাথে ইংরেজ শাসকের কপালেও চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল, সেই ‘মুণ্ডা বিদ্রোহ’-এর অন্যতম নেতা বিরসা মুণ্ডার আজ শহীদ দিবস। ১৮৯৯-১৯০০ সময়কালে তিনি রাঁচির দক্ষিণাঞ্চলে এই বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। অনেক ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে ‘উপজাতীয় বিদ্রোহ’-এর শ্রেণীভুক্ত করেছেন। এটা ঠিক, একটি নির্দিষ্ট উপজাতির মানুষের দ্বারাই এই বিদ্রোহ সংগঠিত ও সংঘটিত হয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল এই ‘উলগুলান’ অর্থাৎ ‘প্রবল বিক্ষোভ’-এর লক্ষ্য ছিল জায়গীরদার ও ঠিকাদারদের হাতে ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জল-জঙ্গল-জমিনকে রক্ষা করা। শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে নিপীড়িত কৃষকশ্রেণীর এই অসম সংগ্রামকে তাই কেবল ‘উপজাতি বিদ্রোহ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া যেন ‘উলগুলান’-এর গৌরবময় গাথাকে লঘু করে দেখার সামিল।
 
ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার অনেক আগে থেকেই মুণ্ডা সহ অন্যান্য আদিবাসীদের কাছ থেকে জঙ্গল-জমি কেড়ে নেওয়ার খেলা শুরু হয়ে যায়। ব্রিটিশরাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার সুবাদে বিদেশী কোম্পানিগুলোর পক্ষে লুঠ করার যেন এক ছাড়পত্র পেয়ে যায়। বর্তমানেও দেশী ও বিদেশী উভয় কোম্পানীর দ্বারা সেই লুঠ চলমান। সেই সময় গোটা অঞ্চল যেন বিবেকহীন ঠিকাদারদের কাছে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সংগ্রহের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। অন্যদিকে চলে ভুখা আদিবাসীদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে শিক্ষা দেওয়ার নামে মিশনারিগুলোর ধর্মান্তরিত করার কাজ। নিজেদের বনভূমিতে যে তারাই পরাধীন, হাজার হাজার বছরের ধর্ম সংস্কৃতি থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করার যে বিশাল ষড়যন্ত্র চলছে; এ কথা খুব ছোট বয়সেই উপলব্ধি করেছিলেন বিরসা।
 
ছোটবেলায় লেখাপড়ার টানে কিছুদিন গ্রামীণ স্কুলে যাওয়া শুরু করলেও পরবর্তীতে এক মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে শর্ত দিয়েছিল, বিরসা এবং তার পুরো পরিবারকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হবে। ধর্মান্তরিত হলেও নিজের ধর্মের প্রতি যে তাঁর শ্রদ্ধা রয়েই গেছিল তা বোঝা যায় যখন মিশনারি স্কুলের এক শিক্ষক মুণ্ডাদের নিয়ে একনাগাড়ে যা ইচ্ছে তাই বলে যান। সেদিন বিরসা মুখে কিছু বলতে না পারলেও প্রতিবাদে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যান। ওই অল্প বয়স থেকেই আদিবাসীদের উপর হওয়া অন্যায়, অবিচার অস্থির করে তুলছিল বীরসাকে।
১৮৯৩-৯৪ সালে তিনি বনবিভাগ কর্তৃক গ্রামের পতিত জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে তিনি মুণ্ডাদের কাছে হয়ে ওঠেন ‘ধরতি আবা’ বা ‘জগৎ পিতা’। মুণ্ডাদের মুখে বিরসার জয়ধ্বনি শুনে ব্রিটিশরা আগেভাগেই বিদ্রোহের আঁচ অনুভব করতে পারছিল। তাঁর নেতৃত্বেই আদিবাসীদের মধ্যে বন আর ভূমি নিয়ে অধিকারবোধ দানা বাঁধে। অন্যদিকে এই বিদ্রোহকে দমন করার জন্য ও বিরসাসহ বাকী বিপ্লবীদের জব্দ করার জন্য ষড়যন্ত্র করে ব্রিটিশ সরকার পুরোনো বন আইনকে ছোটনাগপুর জঙ্গলে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
 
এই খবর মুণ্ডাদের মধ্যে ছড়িয়ে যেতেই তারা বীরসার নেতৃত্বে ফুঁসে ওঠে, পাহাড় জঙ্গলের মুণ্ডাসহ অন্যান্য আদিবাসী কৃষকরা গর্জে ওঠে; বিদ্রোহের ডাক দেয়। ঠিক এই সময়টার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল ব্রিটিশ সরকার। উসকানি আর বিদ্রোহে মদত দেওেয়ার অভিযোগে বিরসাকে আটক করে ব্রিটিশ সরকার। দীর্ঘ দুবছর তারা তাঁকে আটকে রাখে, তারপরেও থিতিয়ে পড়েনি তাদের বিদ্রোহ। জেল থেকে বেরিয়ে আবার তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন ‘উলগুলান’ বা ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে’। ব্রিটিশ সরকারের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সামনে বিরসাদের তীর ধনুক পরাজিত হয়। বিরসাসহ শতাধিক সঙ্গী গ্রেপ্তার হন। বিচারে তাঁদের ফাঁসির হুকুম হয়। ১৯০০ সালের ৯ই জুন রাঁচির কারাগারে বন্দীদশায় বিরসার মৃত্যু হয়। ধৃতদের মধ্যে অন্যান্য দুজনের ফাঁসি হয় এবং বাকীদের হয় দ্বীপান্তর।
 
ঝাড়খণ্ডের উলিহাটু গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন বিরসা। দরিদ্র বর্গিচাষির ছেলে বিরসা। দারিদ্র্য ছিল যার চিরসঙ্গী। আর পাঁচজন আদিবাসী ছেলেদের মতই ছিল তাঁর ছেলেবেলা। তিনি ভালোবাসতেন বাঁশি বাজাতে, কিন্তু বেঁচে থাকার অধিকারের লড়াই তাঁকে হাতে তুলে নিতে বাধ্য করেছিল তীরধনুক। সেদিন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু আদিবাসীদের মনে জল-জঙ্গল-জমির যে অধিকারবোধ জাগিয়ে দিয়েছিলেন তা আজও অটুট। তাই আজও তাদের লড়াই জারি থাকে তাদের জমি কেড়ে নেওয়া রুখতে, তাদের জঙ্গল বেচে দেওয়া রুখতে।
 
লেখা – Tamali Roy
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel