রাশিয়ার শেষ রাজবংশ রোমানভদের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির কাহিনী চির অন্ধকারেই রয়ে গেল। এই কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারের আবরণ ভেদ করে সত্য আর বেরিয়ে এল না। আর এর সুযোগ নিয়ে বহুলোক নিজেদের রোমানভদের বংশধর বলে দাবী প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াস চালাচ্ছে। কিছু সংক্যাক খামখেয়ালি লোক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে তারা রোমানভ রাজপরিবারের সভ্য। আবার কেউ কেউ আছে যারা সত্যিই প্রতারক- তাদের মনের দূরভিসন্ধি অতি সহজেই অনুমান করা যায়। জারের অগাধ সম্পদের দাবীদার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রাতারাতি তাদের ভাগ্য যাবে ফিরে- আরাম আয়েশে বাকী জীবন সুখে কাটানো যাবে, – সেই সঙ্গে আভিজাত্যের মর্যাদায় তারা অভিষিক্ত হয়ে জগতে কেউকেটা হয়ে উঠবেন। ধন্য মানুষের দুরাশা – ধন্য তাদের ধৃষ্ঠতা। কিন্তু একটি কিশোরী বালিকার করুণ কাহিনী নিয়ে একবার হলেও একটু ভাবতে হয়।
বিপ্লবের কারণে বহু অভিজাত রাশিয়াবাসী নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। তারাও মেয়েটির কাহিনী সত্য বলে মনে করেন। ১৯২০ খৃষ্ঠাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারী কিশোরীটি অর্ধ-আচ্ছন্নতার মধ্যে অতিকষ্ঠে বার্লিনের একটি খালের পাশ দিয়ে নিজেকে যেন টেনে নিয়ে চলেছে। তার কথাবার্তায় এমন একটি সত্যতার সুর ছিল, যা রাশিয়ার নির্বাসিত অভিজাত শ্রেনীর মনে অতি সহজেই বিশ্বাস উৎপাদন করে। সে নিজেকে গ্র্যান্ড ডাচেস এ্যানাসতাসিয়া বলে পরিচয় দেয়। এই এ্যানাসতাসিয়া ছিলেন রাশিয়ার হতভাগ্য সম্রাট জারের সর্বকনিষ্ঠ কন্যা।
কিন্তু সংকটের কোন আদি অন্ত নেই। বিপ্লবের পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রোমনভদের প্রচুর ধন-সম্পদ চোরাপথে রাশিয়ার বাইরে পাচার হয়ে যায়। সেগুলো পশ্চিমের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হয়। এই পরিবারের নগদ টাকাকড়ির হিসাব নিয়ে জানা যায় যে, প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশের ব্যাংকগুলোতে জমা আছে। এর সঙ্গে জার্মানীর জমিদারী সংযুক্ত করলে তা বহুল পরিমাণে বর্ধিত হয়ে উঠবে- তাতে কোন সন্দেহ নেই। বলশেভিকরা ১৯১৮ সালের ১৯ শে জুলাই একটি ঘোষনা প্রদান করে । সেই ঘোষনা অনুযায়ী জানা যায় যে, জারের প্রানদন্ডের আদেশ কার্যকরী করা হয়। কিন্তু তার পরিবার পরিজনকে রেহাই দেওয়া হয় ও তাদের কোন এক গোপন স্থানে নির্বাসিত করা হয়। তাই যদি সত্যই হয়- তবে জারের দু’একজন পুত্র কন্যা অবশ্যই বেঁচে ছিলেন।
পূর্ব কথায় ফিরে যায়। মেয়েটি টেনে টেনে বার্লিন খালের পাশ দিয়ে অতিকষ্ঠে এগিয়ে চলেছে। হাতে রয়েছে তার কিছু কাগজপত্র। এই কাগজগুলো Tschaikovski-র পরিচয় বহন করছে। অর্ধ-অচৈতন্য মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে অনেক সেবা শুশ্রুষার পর তার জ্ঞান ফিরে এলো। জ্ঞান ফিরে আসার পরপরই সে নিজেকে এ্যানাসতাসিয়া বলে পরিচয় দিল। তারপর মৃত্যুদন্ড এড়িয়ে সে কিভাবে পালিয়ে এলো, তার বিস্তৃত বিবরণ দিতে থাকলো। তার করুণ মর্মস্পর্শী বিবৃতি অতি সহজেই সকলের সহানুভূতি আকর্ষন করবে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তার ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, পরিবারের সকলের সঙ্গে তাকে একাতারিনবার্গের সেই বিশেষ বাড়ির সেলারে নিয়ে যাওয়া হয়। গুলির আঘাতে সে আহত হয়েছিল ঠিকই। সে আঘাত পেয়ে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। যখন তার জ্ঞান ফিরল, সে একটি চাষীর ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে নিজেকে আবিস্কার করলো। সঙ্গে দু’জন পুরুষ ও দু’জন মহিলাও তার সহযাত্রী ছিলেন। এই লোক দু’জন ছিলেন দুই ভাই ও বলশেভিক গার্ড । তাদের নাম Tschaikovski । রাজপরিবারকে হত্যা করার তাদের মোটেই ইচ্ছা ছিল না। তারা এই হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণও করেনি। তারা এ্যানাসতাসিয়াকে জানালো যে, মৃত মনে করে হত্যাকারীরা তাকে ঘরের মেঝেতে ফেলে রেখে চলে যায়। এই গার্ড দুজন যখন দেহগুলো বহন করে সেলারের বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন লক্ষ্য করে যে এ্যানাসতাসিয়ার দেহে প্রাণ ধুকধুক করছে। তখনই তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তাকে লুকিয়ে রাশিয়ার বাইরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলবে। এ্যানাসতাসিয়ার গলার মুক্তার মালাটি ও তার জামাই সেলাই করা আনকাট পান্না বিক্রি করে গার্ডরা অর্থ সংগ্রহ করে- তারপর দুজনে এ্যানাসতাসিয়াকে সঙ্গে করে রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে গার্ড দুজনের কোন এক আত্বীয়ের বাড়িতে কিছুদিন বসবাস করে। এ্যানাসতাসিয়া বলশেভিকদের ভয়ে অত্যান্ত ভীত ছিল। প্রকাশ্যে বের হতে সে মোটেই চাইতো না। দুই ভাই এর একজনকে সে বিয়ে করে। তাদের একটি সন্তানও জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু কোন এক বলশেভিক এজেন্ট তার স্বামীকে রাস্তায় দেখে চিনতে পারে। দলচ্যুত বলশেভিক হিসাবে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এর ফলে এ্যানাসতাসিয়া আবার একা হয়ে যায়। অসহায় অবস্থায় সে রীতিমত ভেঙে পড়ে। তার শিশুটিকে কেউ একজন পোষ্য হিসাবে গ্রহণ করে।
তার দেবর সের্গেই তাকে বার্লিনে পৌঁছে দেবার সংকল্প গ্রহণ করে। সেখানে সে বলশেভিকদের হাত থেকে কিছুটা নিরাপদ থাকবে এই আশাও মনে মনে পোষন করে। তাদের এই ভয়ঙ্কর যাত্রা যেদিন শেষ হল এবং তারা বার্লিনে পৌঁছালো, সেদিনই তার দেবর নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। হতাশায় ও ক্লান্তিতে এ্যানাসতাসিয়া মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। এমনকি একবার সে স্থির করে যে, এই খালের পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে তার জীবনের সমাপ্তি টেনে সব কষ্টের অবসান ঘটাবে। পরবর্তী দশ বছর এ্যানাসতাসিয়া তার পদবী ফিরে পাবার জন্য ও পৈত্রিক সম্পদ ফিরিয়ে দেবার জন্য বিভিন্ন স্থানে বহু লেখালিখি করে- বহু দাবী উথ্থাপন করেন। জারের প্রতি সহানুভূতি লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করেন।
এদিকে Tschaikovski ভ্রাতৃদ্বয় ও তার শিশু পুত্রের অনুসন্ধান করা হলো। কিন্তু তাদের কোন রকম চিহ্নই পাওয়া গেল না। রাজপরিবার সম্বন্ধে এ্যানাসতাসিয়ার দেওয়া তুচ্ছাতিতুচ্ছ সংবাদের পুংখানুপুংখ বিবরণ শুনে পশ্চিমের দেশগুলোতে তার বহু সমর্থক জুটে গেল। আবার প্রকাশ্যভাবে তাকে প্রতারক হিসাবে নিন্দা করতেও কিন্তু কেউ কেউ ছাড়লো না। বার্লিনে অবস্থানকারী রাশিয়ান সম্প্রদায় দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়লো। একদল তাকে গ্র্যান্ড ডাচেস হিসাবে বিশ্বাস করে স্বীকৃতি দিল আর অন্য দল তাকে প্রতারক প্রতিপন্ন করে তার নিন্দাবাদে মুখর হয়ে উঠলো। যারা তাকে যথার্থভাবে শনাক্ত করতে পারতেন, তাদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে মৃতুবরণ করেছেন। অন্যরা পাছে তাদের রোমানভ সম্পদের দাবীকৃত অংশ থেকে বঞ্চিত হন, এই ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। এ্যানাসতাসিয়ার দাবী সত্য বলে স্বীকৃতি পেলে তাদের নিজেদের দাবী ভেঙে যাবার আশংকা রয়েছে, এটা তারা সহজেই হৃদয়াঙ্গম করতে পারেন।
রোমানভ পরিবারের পিয়েরে গিলিয়ার্ড নামে ফরাসি দেশীয় একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে মেয়েটি আসলেই একজন প্রতারক। তিনি দাবী করলেন যে, এ্যানাসতাসিয়া মোটেই রাশিয়ান ভাষা বোঝে না। রোমান ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসীদের আচার- আচারণই তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। কিন্তু রাজপরিবারসহ জনসাধারণ সকলেই অর্থডক্স চার্চের অনুসারি।
গ্র্যান্ড ডিউক সিরিল ছিলেন জারের চাচাতো ভাই। রোমানভ পরিবারের যারা তখনও বেঁচে ছিলেন তাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান বা কর্তা ব্যাক্তি। তিনি এ্যানাসতাসিয়াকে জনসমক্ষে বের হবার আর অনুমতি দিলেন না। এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে আর কোনরকম আলোচনা হোক – এটাও তিনি বন্ধ করে দিলেন। তাতে কিন্তু এ্যানাসতাসিয়ার সমর্থকবৃন্দকে দমন করা গেল না।
প্রুশিয়ার রাজকুমারী আইরিন ছিলেন জারের ভগ্নি। তিনি নিশ্চিতভাবে স্বীকার করেন যে, মেয়েটির চোখ দুটি ও তার কপাল হুবহু এ্যানাসতাসিয়ার মতই। কিন্তু রাজকন্যা এ্যানাসতাসিয়াকে তো তিনি দশ বছর আগে দেখেছিলেন। এই দশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মেয়েটি বর্তমানে কেমন যে হয়েছে কে জানে। জারের এক চাচাতো ভাই গ্র্যান্ড ডিউক এনড্রু তাকে পরিপূর্ণভাবে তার ভাইঝি এ্যানাসতাসিয়া হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি মন্তব্য করেন- ‘মেয়েটি অবশ্যই গ্র্যান্ড ডাচেস। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।’
কিছুদিন পরে এ্যানাসতাসিয়া দাবী করেন যে, তার চাচা হেসের গ্র্যান্ড ডিউক আর্নেস্ট জার্মানী থেকে ১৯১৬ খৃষ্ঠাব্দে যখন রাশিয়ায় বেড়াতে যান তখন দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। গ্র্যান্ড ডিউক আর্নেস্ট সরাসরি তা অস্বীকার করেন। তিনি এ্যানাসতাসিয়া সম্বন্ধে মন্তব্য করেন যে, সে চরম মিথ্যাবাদী। কিন্তু ১৯৪৯ খৃষ্ঠাব্দে রাশিয়ার গার্ডস রেজিমেন্টের কমান্ডার কর্ণেল লারক্সি শপথ নিয়ে বলেন যে, এ্যানার দাবী অনুযায়ী সেই সময়ে আর্নেস্ট সত্যিই রাশিয়া পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।
১৯৩৩ সালে বার্লিনের আদালত একটি দলিল প্রস্তুত করলো। তাতে জারের ছয়জন জীবিত উত্তরাধিকারী মনোনিত হলেন। কিন্তু এ্যানাসতাসিয়াকে মৃত হিসাবে ধরে তার উত্তরাধিকার বাতিল করা হলো। আর তখনই এ্যানাসতাসিয়াকে রাজকন্যা হিসেবে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নটি আবার উঠলো।
হাসপাতালে এ্যানাসতাসিয়ার পুংখানুপুংখভাবে পরীক্ষা চললো। এক্সরে করে তার মাথার আঘাতের সুস্পষ্ট চিহ্ন ধরা পড়লো। হয়তোবা রিভলবারে বাটের আঘাতে এই চিহ্ন এর সৃস্ঠি। জারের কন্যার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের যে স্থানে কড়া পড়েছিল এ্যানার পায়েও ঠিক সেই স্থানে সেই রকমই কড়া বিদ্যামান দেখা যায়। তার ডান কাঁধেও একটি ক্ষতচিহ্ন পাওয়া যায়। তার বাম হাতের মধ্যম আঙ্গুলে আর একটি ছোট খাটো ক্ষতচিহ্ন পাওয়া যায়। ঘোড়ার গাড়ীর কোচোয়ানের অসাবধানে দরজা বন্ধ করার কারণে, শিশুকালে তার আঙ্গুলে এই ক্ষতটি সৃস্টি হয়েছিল। তার বিরোধীদল এ ধরনের কোন ঘটনা আদপেও ঘটেনি বলে দাবী করলো। কিন্তু একজন প্রাক্তন পরিচারিকা উক্ত আঘাতের কথা সমর্থন করেছিলেন।
১৯৩৮ সালে তার আইনজীবিরা ১৯৩৩ সালের উত্তরাধিকার দলিলটি বাতিল করার দাবী জানালেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণে এ ব্যাপারে শুনানী স্থগিত রইলো। ১৯৬৮ সালের মে মাসে হ্যামবার্গের আদালত তাকে হতাশ করে তার বিরুদ্ধে রায় দিল। কিন্তু মানুষের কল্পনা থেমে নেই। আজও বহুলোক বিশ্বাস করে যে, রোমানভদের কাহিনী একাতারিনবার্গের সেলারের ভেতরেই হয়তো শেষ হয়ে যায় নাই। কিন্তু এই কুহেলিকার জাল ভেদ করে সত্য উন্মোচন এখনও হয় নাই।