১৯১৮ সালের জুলাই মাসে বিপ্লবী বলশেভিক দল মস্কোতে ঘোষনা করলো – ‘জঘন্য ও অমার্জনীয় অপরাধের জন্য রাশিয়ার সম্রাট জারকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হলো এবং তা কার্যকরী করা হল’। – কিন্তু সরকারি ঘোষনায় বলা হয় যে, সম্রাজ্ঞী ও তার সন্তান সন্ততিদের একটি গোপন স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই প্রাণদন্ড সম্পাদনের বিবরণ বলশেভিকরা বহুবার পরিবর্তন করে সমগ্র ঘটনার উপর যেন একটা বিরাট জিজ্ঞাসা চিহ্ন ঝুলিয়ে রেখে দিল। ইতিহাসবেত্তাদের সামনে এমন কোন নিদর্শন নেই – যা দিয়ে তারা প্রমাণ করতে পারেন যে সম্রাটকে একাকিই ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তারা সমগ্র পরিবারকে যদি সম্রাটের সঙ্গে হত্যা করা হয়ে থাকে, কিংবা নিকোলাসসহ সমগ্র রাজপরিবারকে যদি নির্বাসনে পাঠানো হয়ে থাকে, তার সঠিক প্রমাণ আজ আর পাওয়া সম্ভবপর নয়।

১৯১৭ সালের প্রথম দিকে রাশিয়ার বিপ্লবী দল সম্রাট জার ২য় নিকোলাসকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সম্রাটের ৫ টি সন্তান যথাক্রমে- অ্যালেক্সি, ওলগা, ম্যারিয়া, তাতিয়ানা এবং আনাস্তাশিয়া ও সম্রাজ্ঞী আলেকজান্দ্রাসহ সম্রাটকে জারস্কোয়ে সেলো প্রাসাদের বাইরে সেন্ট পিটার্সবার্গের (বর্তমান রেরিনগ্রাডে) বলশেভিকরা বন্দি করে। ঐ বৎসর আগস্ট মাসে সাইবেরিয়ার প্রত্যান্ত অঞ্চলের অবলস্কে রাজপরিবারকে স্থানান্তারিত করা হয়। রাজপরিবারের প্রতি সামান্যতম সহানূভূতি সম্পন্ন কোন ব্যক্তি বা দলের পক্ষে ঐ অঞ্চলে যাওয়া দূরহ বলেই বিপ্লবী সংস্থার বদ্ধমূল ধারণা ছিল। ১৯১৮ সালে তাদের আবার স্থানান্তারিত করা হল । এবার তাদের নিয়ে আসা হল একাতারিনবার্গ নামে ছোট্ট একটি শহরে। শহরটির অবস্থান ইউরাল পর্বতের কাছাকাছি এবং এর বর্তমান নাম সেভার্ডলভস্কি। একাতারিনবার্গের অধিবাসীরা সকলেই ছিল বলশেভিক এবং সকলেই সম্রাট ও তার পরিবারের প্রতি ছিল শত্রু ভাবাপন্ন। বিপ্লবীদের ধারণা ছিল যে সম্রাট ও তার পরিবারের লোকেরা এই বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন লোকদের দৃষ্টি এড়িয়ে পালাতে পারবে না। সম্রাটের অনুসারিরা কিন্তু সব বাঁধা তুচ্ছ করে কয়েকবারই এই শত্রুপুরিতে হানা দিয়ে তাদের প্রিয় সম্রাটকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছে। মস্কোর বলশেভিক সরকার অবশেষে রাজপরিবারের সকলকে হত্যা করার আদেশ দেয়। বিরোধী দলেরা সম্রাটকে উদ্ধারের আশায় বারবার চেষ্টা চালানোর কারণে হয়তো বলশেভিকরা আশংকা করেছিল যে, রাজাকে মুক্ত করতে পারলে স্বয়ং রাজাই বিরোধী দলের নেতৃত্ব দান করবেন। তাতে হয়তো দাবার ছক উল্টেও যেতে পারে। আবার এও তারা মনে করতে পারে যে, রাজাকে হত্যার সংবাদ ঘোষনা করলে, সকলে জানতে পারবে যে, রাজা আর বেঁচে নেই। কাজেই তাকে উদ্ধারের প্রচেষ্টা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

তারপর তাকে লুকিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নিলে বলশেভিকদের আর কোনরকম অসুবিধার সম্মুখিন হতে হবে না। বলশেভিকদের ১৯১৮ সালের ঘোষনা সমগ্র পৃথিবীকে রীতিমত স্তব্ধ করে দিল। পাশ্চাত্য দেশগুলিতে – বিশেষ করে যে সব দেশে রোমানভদের আত্বীয় –স্বজন বসবাস করতেন- সেসব অঞ্চলের লোকেরা এই হৃদয়-বিদারক ঘটনা শুনে রীতিমত হতোদ্যাম হয়ে পড়লেন। এই রোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক সংবাদে সবাই যেন মূক হয়ে গেলেন। বলশেভিকরা জানালো যে, ১৯১৮ সালের ১৯ শে জুলাই রোমানভ পরিবারের সকলকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই সংবাদের সূত্রে আরো জানা গেল যে, এইভাবে সমগ্র রাজপরিবারকে হত্যা করার আদেশ মস্কো থেকে দেওয়া হয়েছে। ইউরোভস্কি নামে একজন লোকের নেতৃত্বে এই আদেশ কার্যকরী করা হয়েছে। এই নির্মম হত্যাকান্ডের প্রথম গুলিটি এই ইউরোভস্কিই ছোড়েন। রোমানভদের পূর্বাহ্নে কোন রকম সাবধান করা হয়নি। তাদের সকলকে সিড়ি দিয়ে একত্রে প্রায় তাড়িয়ে নামিয়ে আনা হয়। তারপর সেলারে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে সকলকে চেয়ারে বসার আদেশ দেওয়া হয়।

ইউরোভস্কির প্রথম গুলির সঙ্গে সঙ্গে বলশেভিক গার্ডদের অসংখ্যা গুলি ঝাঁকে ঝাঁকে গিয়ে পড়ে অসহায় এই পরিবারের সকলের উপরে। তাদের এই ভয়ংকর ও অমানবিক কাজের জন্য যে রিভলবার তারা ব্যবহার করে তা তাদের বিশেষভাবে স্থানীয় অস্ত্রাগার থেকে সরবরাহ করা হয়। রোমনভ পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পারিবারিক চিকিৎসক ড. বটকিন ও পরিচারকবৃন্দকেও সারিবদ্ধভাবে দাড়ানোর আদেশ দেওয়া হয়। গুলি ছোড়া শেষ হলে দেখা গেল ১১ টি রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে আছে। নির্মম ও হিংস্র গার্ডেরা মুত্যুর নিশ্চয়তা বিধানের জন্য তাদের বেয়নেট ও রাইফেলের বাটের ব্যবহার করতেও ভোলেনি। পরদিন ভোরে সবগুলো মৃতদেহকে একটি অপেক্ষামান ট্রাকে স্তুপিকৃত করা হয়। তারপর একাতারিনবার্গের চৌদ্দ মাইল দূরে অবস্থিত ফোর ব্রাদার্স মাইনে মৃতদেহগুলি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গ্যাসোলিনে ঢুকিয়ে তাদের দেহকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। মৃতদেহের অবশিষ্ট ভষ্মগুলো একটি জলাভূমিতে নিক্ষেপ করা হয়। সম্রাট ও তার পরিবারের নিজস্ব জিনিসপত্র যা সঙ্গে ছিল সব এসিডে ডুবিয়ে খনির প্রবেশদ্বারে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়।

এই ঘটনার ৪ দিন পর জুলাই মাসের ২৩ তারিখে একাতারিনবার্গে একটি প্রতিবিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিবিপ্লবের ফলে একাতারিনবার্গে প্রতিবিপ্লবীদের বা White Army–র দখলে চলে আসে। যে বাড়িতে রাজপরিবারকে বন্দী করা হয় সে বাড়ির সেলারে তারা চাপ চাপ রক্তের শুকিয়ে যাওয়া দাগ দেখতে পায়। দেয়ালের রক্তের দাগ গুলো স্থানে স্থানে ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। কিন্তু ওগুলো যে রাজপরিবারের লোকেরই রক্তের দাগ, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না।