Sakhina, the daughter of Omar Khan the great warrior lady.

যুদ্ধ তখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অতর্কিত আক্রমণ সামলাতে না পেরে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে ফিরোজ খাঁর বাহিনী … ইতিমধ্যে বন্দিও করে ফেলছে তাদের সেনাপতিকে। এমন সময় হঠাৎ যুদ্ধের ময়দানে আবির্ভূত হলো সতেরো-আঠারো বছর বয়সী এক তরুণের। তার হাতের ছটায় যেন বিদ্যুৎ লাফাচ্ছে। তার নেতৃত্বে ফিরোজের বিপর্যস্ত বাহিনী নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে পুনরায় ঘুরে দাঁড়ায়। ক্ষ্যাপা নেকড়ের মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রু সৈন্যর ওপর। দুর্ধর্ষ আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী বিপন্নপ্রায়…..একের পর এক আক্রমণে বিপক্ষ শক্তি বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। এমন সময় ঘটে এক নিন্দনীয় ঘটনা যা কাহিনীর কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। কিছু মিথ্যে তথ্য আর গুজব এই মহাবীরের মনোবলকে একদম ভেঙে দেয়। মুহূর্তেই পাল্টে যায় যুদ্ধের ভাব-গতি। আস্তে আস্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তার নিথর দেহ ! দুর্ধষ এই তরুণ সেনাপতির শিরোস্ত্রাণ ছিটকে মাটিতে পড়লে বের হয়ে আসে তার অপূর্ব চুল। এতক্ষণে বুঝতে পারে, যে সেনাপতি অভূতপূর্ব রণকৌশলে যুদ্ধ করছিল সে আসলে কোনো তরুণ নয়…. একজন তরুণী। মোঘল সাম্রাজ্য চলছিলো তখন। সেই কিল্লাতাজপুর তখন মোঘল নবাব উমর খাঁর অধীন। সমর যুদ্ধে ছদ্মবেশ ধরে বিপক্ষ শক্তিতে কাঁপন ধরিয়ে দেয়া এ নারী আর কেউ নয় তারই আদরের মেয়ে বীরাঙ্গনা সখিনা।

যোদ্ধা মানেই সুঠাম দেহ আর সুদর্শন তরুণ, যোদ্ধা মানেই বিচক্ষণ আর রণকৌশলে দক্ষ নেতৃত্বদানে যোগ্য সেনা …… কল্পনাতে তো আমরা এমনটাই দেখি l নারী হিসেবে এসব পারদর্শীতার গল্প আমাদের কম। তাঁদের এ বিষয়ে শিক্ষাদানে আগ্রহও কম বা আমরা পদ্মাবতী, প্রীতিলতাদের গল্প যতোটা শুনি এসব বীর সেনানীর গল্প ততোটা শুনি না। অথচ ব্রিটিশদের আসার আগেও বীরত্বের গৌরবময় ইতিহাস আছে বীর সখিনার মতো নারীদের। তারা মুসলিম পরিবারে পর্দার মাঝে থেকেও শিখেছেন রণকৌশল, ছিলেন বিচক্ষণ….পান্ডিত্য ছিলো সরাসরি যুদ্ধেও। তাই প্রয়োজনে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন প্রতিপক্ষের ওপর আঘাত হানতে।

ইতিহাসখ্যাত এই সখিনা লড়াই করেছেন তাঁর স্বামীর জন্য। নিজের বাবার বন্দিশালা থেকে স্বামীকে মুক্ত করতে ছদ্মবেশ ধরে লড়াই শুরু করেন তিনি। তাঁর স্বামী কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি ঈশা খাঁর দৌহিত্র ফিরোজ খাঁ দেওয়ান। কেল্লা তাজপুরের মুঘল দেওয়ান উমর খাঁর মেয়ে সখিনা ছিলেন অপরূপ সুন্দরী ও প্রতিভাবান এবং বহু কাজে পারদর্শী। জন্মকালীন সময়ে তার প্রকৃত নাম ছিল সখিনা এবং ডাক নাম সাকি । তিনি কেল্লা তাজপুরের মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মুঘোল সুবেদার ছিলেন l পারিবারিক পরিবেশে বাড়িতেই শিক্ষালাভ করেন সখিনা। তবে নিজের মেয়েকে নিজের মনের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টাই করেন উষ্ণ হৃদয়ের অধিকারী এই বাবা l আদর করে তিনি সখিনাকে সাকি নামে ডাকতেন l বাবা মুঘল সাম্রাজ্যের কেউকেটা বলে ঐ সময়ের অধিকাংশ নারীদের তুলনায় অনেক বেশী স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছিলেন সাকি। আত্মরক্ষামূলক শিক্ষালাভের পাশাপাশি ঘোড়া চালনা, আর্চারী শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিনি। নির্ভীকতা ,সহজাত সৌন্দর্য্য, চতুরতা এবং অসাধারণ অধ্যবসায়ের জন্যেও স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। এছাড়াও তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক নেতার তুলনায় সবচেয়ে বিপজ্জনক ভূমিকাও নিতেন। বাংলার কিশোরগঞ্জে লোকগাঁথায় তার সম্বন্ধে ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। তবে তার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বিবরণ জানা দরকার….দরকার আরো প্রচার l বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলপত্রাদি, প্রচলিত লোকগাঁথা, কবিতাসমগ্র এবং মুখে মুখে চলে আসা বিভিন্ন তথ্যাবলী সমন্বয় করার মাধ্যমে তার সম্পর্কে আরও গবেষণা করা দরকার l কেল্লা তাজপুর থেকে ৫০-৬০ মাইল দূরেই বাস করতো জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁর নাতি ফিরোজ খাঁ। ঈশা খাঁ ছিলেন বারোভূঁইয়ার অন্যতম স্বাধীন শাসক। সখিনার কথা তার সুযোগ্য নাতি ফিরোজ খাঁর কানেও পৌঁছে। সেই থেকে অপরূপ সুন্দরী সখিনাকে একপলক দেখতে ব্যকুল হয়ে পড়েন তিনি। এদিকে দেওয়ান উমর খাঁ পারিবারিকভাবে কড়া নিয়ম পালন করতেন। তাই, কোনভাবেই দেখার সুযোগ নেই সখিনাকে। ফলে ফিরোজ খাঁ একটি কৌশলের আশ্রয় নেন….তিনি দরিয়া নামে এক সুন্দরী মহিলাকে তসবি বিক্রেতা হিসেবে উমর খাঁর অন্তঃপুরে সখিনার বাসায় পাঠান। দরিয়ার মুখে ফিরোজ খাঁর অসামান্য রূপ-গুণের কথা শুনে সখিনা নিজের অজান্তেই মনেপ্রাণে ফিরোজ খাঁ-কে ভালবাসতে শুরু করেন।

যুদ্ধের ময়দান

সাকির মনের কথা বুঝতে পেরে ফিরোজ খাঁ পরিবারের সম্মতি পেতে জঙ্গলবাড়িতে ফিরে আসেন এবং পরিবারের সম্মতি নিয়েই উমর খাঁর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু নিজের মেয়ের সাথে ফিরোজ খাঁর বাগদানে আপত্তি জানান উমর খাঁ। প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া হয়….এতে করে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। লজ্জা, ঘৃণা আর ক্ষোভে ফিরোজ খাঁ বিশাল সৈন্যদল নিয়ে আক্রমণ করেন। অতর্কিত এ আক্রমণে উমর খাঁর সৈন্যদল পিঁছু হটে যায়। সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে উমর খাঁ পরাজয় বরণ করেন। এই সংঘাত আর শত্রুপক্ষের বিজয়ে কেল্লা তাজপুর নারীশূন্য হয়ে যায়। তবে এতে একটুও বিচলিত হননি সখিনা৷ তিনি নিজের ঘরেই বসে ছিলেন। এসময় ফিরোজ খাঁ স্বসম্মানে তাকে বরণ করে নেন। শানাই বাজলো, ঢোল বাজলো….বিয়েও হলো! কিন্তু উমর খাঁ তখনো এ বিয়ে মানতে পারেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ আর মেয়েকে ফেরৎ পাওয়ার আশায় তিনি আরও শক্তি-সামর্থ নিয়ে বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। কন্যাকে তিনি ফিরিয়ে আনবেনই l পরবর্তীতে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরোজ খাঁ-কে বন্দীও করেন। এছাড়া ফিরোজ খাঁ-কে বারবার তালাক দেওয়ার চাপ দিতে থাকলেও ফিরোজ খাঁ তাতে সম্মত হননি। যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরোজ খাঁর বন্দী হওয়ার ফলে যখন সৈন্যবাহিনী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত, তখন যুদ্ধ ময়দানে ছদ্মবেশে হাজির হন সখিনা। যুবক বেশে তিনি ফিরোজ খাঁর সেনাপতির পরিচয় দিয়ে লড়াই চালিয়ে যান। একে একে বিপক্ষ শক্তিকে নাজেহাল করতে শুরু করেন। এমন সময় উমর খাঁর জনৈক উজিরের কুমন্ত্রণায় একটা গুজব রটিয়ে দেয়া হয়…..বলা হয়, যার জন্য এই যুদ্ধ সেই ফিরোজ খাঁই নাকি তার স্ত্রী সখিনাকে তালাক দিয়েছেন।

যুদ্ধের ময়দান

এ খবর সখিনার কানে পৌঁছালে তিনি ভেঙে পড়েন… ফলে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে একসময় বিপক্ষ শক্তির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। শিরোস্ত্রাণ খুলে মাটিতে পরে l অবাক কান্ড ! দেখা যায় ছদ্মবেশ ধরা এই যুবক আসলে অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী বিদ্যান বীর সখিনা। অন্যদিকে উমর খাঁ তার আদরের মেয়েকে হারিয়ে শোকে পাগল প্রায়। প্রাণ প্রিয় মেয়ের প্রাণহীন দেহ কোলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি । সেই কান্নার সুরে জঙ্গলবাড়ীর বাতাস কী পরিমাণ ভারী হয়েছিল তা জানা যায়নি, তবে এ কাহিনী শুনে আজও সবার অন্তর করুণ সুরে সিক্ত হয়ে ওঠে! মেয়েই যখন নাই তখন শত্রুতা আর কার সাথে? ফিরোজ খাঁকে বন্দীশালা থেকে মুক্তি দেন উমর খাঁ । বন্দী দশা থেকে মুক্তির পর সখিনার বিরহে ফিরোজ খাঁ পাগলের মতো হয়ে পড়েন।

সখিনার কবর

এরপর থেকে কেল্লা তাজপুরবাসী বিচিত্র এক দৃশ্য দেখেন। প্রতি সন্ধ্যায় দরবেশধারী একজন প্রদীপ জ্বেলে সখিনার সমাধির পাশে নিশ্চুপে বসে থাকেন। পরে অবশ্য সবাই বুঝতে পারে, বেশধারী এই ব্যক্তি আসলে সখিনার স্বামী ফিরোজ খাঁ। প্রচন্ড শোক সহ্য করতে না পেরে একদিন তারও মৃত্যু হয় l বীরাঙ্গনা নারী সখিনার প্রাণত্যাগের স্থানেই সমাধি হয় তাঁর….স্থানটি কুমড়ী নামে খ্যাত।

কেল্লা তাজপুর

এককালে কেল্লা তাজপুর গ্রামের চারপাশে উঁচু উঁচু মাটির প্রাচীর ছিলো। প্রায় চার মাইলব্যাপী এই প্রাচীরের মাঝে ঘোড়াদৌড় হতো। গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে দুই মাইল বিস্তৃত সুরিয়া নদী। যুদ্ধের পরিখার চিহ্নও রয়েছে এখানে। উঁচু মাটির টিলা এখনো রয়েছে বিভিন্ন স্থানে…. দেওয়ান উমর খাঁর বাড়ির ধ্বংসাবশেষও রয়েছে সেখানে ।

দেওয়ান উমর খাঁ দিল্লির মুঘল সম্রাটের অনুগত ছিলেন। এদিকে বারোভূঁইয়ার সম্রাট ইশা খাঁ ও তার নাতি ফিরোজ খাঁ বংশীয় ভাবেই মোঘলদের শত্রু ছিলেন । বাংলা সবসময়ই দিল্লির শাসন থেকে পুরোপুরি না হলেও আলাদা ছিলো, দিল্লির কোনো প্রদেশ বা রাজ্য হিসেবে বাংলা অধিনস্ত ছিলো না। ভারতবর্ষ এক থাকায়… বাংলা স্বাধীনভাবে থাকলেও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার মতো মাসিক বা বার্ষিক চাঁদা দিয়ে পুরো ভারতবর্ষের সাথে একত্র বা মিলেমিশে থাকতো।

Omar Khan of Mugal ancestry the cheif of Kella Tajpur

দেওয়ান উমর খাঁ কেন ফিরোজ খাঁর বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন বা বিয়ের প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাগে, ক্ষোভে বা অপমানেই যে কেবল ফিরোজ খাঁ আক্রমণ করে তা নয় বরং এর ভিত্তি আরও গভীর। দিল্লির শাসনের অধীনস্থ হয়ে বিভিন্ন সুবেদার বা গভর্নর তাদের প্রতি এতোটাই অনুগত ছিলেন যে বাংলার ধন সম্পদ উপঢৌকন হিসেবে দিয়ে দিতেই বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। ফলে বাংলার নবাব, বারোভূঁইয়া সকলের সাথে বিরূপ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকতো। এ ঘটনায় আরেকটি বিষয়ে বিশেষ লক্ষণীয় দিক আছে সেটা হলো, প্রেম ভালবাসার অধিকতর গ্রহণীয় কাহিনী হচ্ছে পবিত্রতা। ভালবাসায় সখিনা যেমন গভীর অনুরাগী ছিলেন তেমনি ফিরোজ খাঁও সখিনার প্রতি গভীর ভালবাসা দেখিয়েছেন। কেবল ক্ষমতার দাম্ভিক বা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক দিয়েই ঘটনাটি ব্যাখ্যার সুযোগ নেই। ফিরোজ খাঁ পুরোপুরি বন্দি হয়েও যেমন অসংখ্য চাপের পরেও স্ত্রীকে ছেরে দিতে সম্মত হননি। তেমনিভাবে স্বামীকে মুক্ত করতেই নিজে শত্রু শিবিরে হানা দেন। লড়াই করে জয়ের দিক এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক এমন সময় তালাকের মিথ্যে খবর ছড়িয়ে পড়লে তিনি ভেঙে পড়েন। এর মাধ্যমে একজন নারীর বীরত্বের কথা যেমন বুঝা যায়, তেমনি তার কোমলতার বিষয়টিও ফুটে উঠে। নারী তো এমনই! দৃঢ়চিত্তে লড়াই ও মনোভাবে কোমল এই দুই গুণে বিজেতার গল্প কেবল নারীরই…নারীই প্রকৃত বীর। নারীর এই অদম্য স্পৃহা নারীকে বরাবরই ইতিহাসখ্যাত করেছে। তাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হবে সখিনাকে। সম্মান জানাতে হবে শীর উন্নত সকল বীর নারীদের। নারীদের ভালোবাসার আগুনের কতোটা তেজ তার প্রমাণ দিয়েছেন সখিনা। শ্রদ্ধা জানাই বাংলার ময়মনসিংহের অগ্নিকন্যা সেই সাকিকে।

Dewan Feroj Khan, the grand son of Isha Khan, husband of Sakhina

একটি দেশের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় গল্পের চরিত্র হিসাবে এমন একজন বীর পাওয়া। তাই এই বীরদের গল্প নাটকে বা সিনেমাতে তুলে ধরে সকলের কাছে পরিচিত করার অনুরোধ রইল সবার প্রতি l