সাড়ে চার হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর বাণিজ্যের প্রধান নদী বন্দরগুলোর মধ্যে পশ্চিম উপক‚লীয় বন্দর ছিল লোথাল, সোপারা, বারুচ ও মোজিরিস। সেগুলো সম্পর্কে আমরা ভালোই জানি। তবে পূর্ব উপক‚লীয় বন্দর ও বন্দর-নগরী তাম্রলিপ্তি সম্পর্কে তেমন জানি না। তাম্রলিপ্তি প্রাচীন বাংলার একটি প্রধান বন্দর নগরী। এটি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত। মূলতঃ বিহারের সিংভম জেলার ঘাটশিলাতে একটি তামার খনি ছিল। সেই তামা এই বন্দর থেকে বিশ্বের অন্যন্য দেশে রপ্তানি হত। তাই এই বন্দরের নাম ছিল তাম্রলিপ্তি। এমনকি বর্তমানে ঐ এলাকায় একটি পি এস ইউ কোম্পানি ভারতীয় কপার লিমিটেড এর অধীনে এখনো তামার খনি সক্রিয় রয়েছে।
 
তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্ত সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, সিংহলি গ্রন্থ এবং গ্রিক ভৌগোলিক ও চৈনিক তীর্থযাত্রীদের বিবরণে লেখা রয়েছে। এ সকল গ্রন্থ ও বিবরণ থেকে জানা যায়, পূর্ব উপকূলবর্তী তাম্রলিপ্তি গঙ্গা নদী যেখানে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে তার কাছে অবস্থিত ছিল। তাম্রলিপ্তি তৎকালীন বাণিজ্যপথের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং পূর্ব উপকূলের প্রধান প্রবেশপথ। এখানে ব্যবসায়ী, পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এখানকার মানববসতির সময়কাল মোটামুটিভাবে চতুর্থ/তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্ব থেকে অষ্টম খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বলে নির্ধারণ করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন বন্দর হিসেবে তাম্রলিপ্তির সর্বশেষ প্রমাণ বহন করছে অষ্টম শতাব্দীর উদয়মনের দুধপানি পাথরলিপি। গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমির মানচিত্রে ‘তমলিটিস্’ নামে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ রয়েছে। এসব থেকে বলা হয়, প্রাচীনকালে তাম্রলিপ্তি একটি সমৃদ্ধশালী নগরকেন্দ্র ছিল এবং এর সাথে জল ও স্থলপথে দক্ষিণ এশিয়ার বহু অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল। অবশ্য এ বন্দর নগরীর সঠিক জায়গা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। তবে এটি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহরেই ছিল বলে ধরা হয়। শহরটি বঙ্গোপসাগরের কাছে রূপনারায়ণ নদীর তীরে অবস্থিত।

এই বন্দর থেকে বাণিজ্যিক জাহাজ পন্য বোঝাই করে বহু দূর দেশে যেত। যথাঃ সিংহল মানে শ্রীলংকা, আফ্রিকা উপকূল, আরব সাগর ইত্যাদি। আর রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল- নীল, বস্ত্র, ও তামা। তাম্রলিপ্তি ছিল কলিঙ্গ রাজ্যের প্রধানতম বন্দর। এখান থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গিয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, সম্রাট অশোক তাম্রলিপ্তি বন্দর দখল করার জন্যই কলিঙ্গের সাথে যুদ্ধ করেন। কলিঙ্গ দখল করার পর এটিই মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রধান নৌ-বন্দরে পরিণত হয় এবং শিশপালগড় নগরী গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সম্রাট অশোক মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটালিপুত্র থেকে তাম্রলিপ্তি বন্দর পর্যন্ত বিরাট মহাসড়ক নির্মাণ করেন। জাতক কাহিনি ও শ্রীলংকার মহাকাব্য মহাবংশ থেকে জানা যায়, সম্রাট অশোক তার কন্যা সংঘমিত্র ও ছেলে মহেন্দ্রকে দিয়ে বুদ্ধের বোধিবৃক্ষ সিংহলে পাঠান এবং তাঁরা এই বন্দর দিয়েই গিয়েছিল। তখন তাম্রলিপ্তি বন্দর থেকে শ্রীলংকায় যেতে সময় লাগতো মাত্র ১৪ দিন। যেখানে পাটালিপুত্র থেকে তাম্রলিপ্তি যেতে সময় লাগতো ৭ দিন।

চীনের পর্যটক ফা-হিয়েন ৫ম শতকে তমলুকে আসেন এবং তার বইয়ে এই নগর সমন্ধে লেখেন। তিনি এখানে প্রায় ২৪ টি বৌদ্ধ বিহার ও এক হাজারের মত ভিক্ষু দেখেছিলেন। তবে আমরা সেসব বৌদ্ধ বিহারের কিছুই পাইনি। আমরা জানি না কি কারণে তমলুক ধ্বংস হয়ে গেল। এত বড় বন্দরের তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। এমনকি ১৮৮০ সালের আগ পর্যন্ত আমরা বাঙালীরা ভুলেই গিয়েছিলাম এই তাম্রলিপ্তির কথা।
 
স্থানটিতে দুবার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ চালানো হয়। এর সাথে যুক্ত ছিলেন বিখ্যাত বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধু গৌড়দাস বসাক, উমাচরণ অধিকারী, গুরুসদয় দত্ত, টি. এন. রামচন্দ্রন, কে. এন. দীক্ষিত, এস. কে. মুখার্জী প্রমুখ। খনন থেকে চারটি পৃথক সাংস্কৃতিক পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। এখানে নব্যপাথরের যুগের অল্প পোড়ানো মাটিরপাত্র, বিপুল পরিমাণ মধ্যপাথরের যুগের হাতিয়ার, হাড় দিয়ে তৈরী সূঁই বিশেষ এবং অল্প কিছু তামার জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। এছাড়া উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মাটিরপাত্র, স্বল্পমূল্যবান পাথরের গুটিকা, বিপুল সংখ্যক ছাপাঙ্কিত ও ছাঁচে ঢালা তামার মুদ্রা পাওয়া গেছে। কেউ কেউ এগুলো মৌর্য-শুঙ্গ যুগের বলে অনুমান করেন। এখানে ইটনির্মিত একটি জলাধার এবং পোড়ামাটির কিছু পাতকুয়ার নিদর্শনও পাওয়া গেছে।

বর্তমানে এই স্থানে একটি তাম্রলিপ্ত গবেষণা ও জাদুঘর কেন্দ্র৷ তৈরী করা হয়েছে। জাদুঘরের সংগ্রহে আছে পোড়ামাটির তৈরি যক্ষী ও জীবজন্তুর মূর্তি এবং সাধারণ পুরুষ ও মহিলাদের জীবন সম্পর্কিত পোড়ামাটির ফলক। তমলুকের নানা ধরনের মাটিরপাত্রের মধ্যে রয়েছে রুলেটেড (নক্শা করা) পাত্র, ধূসর মৃৎপাত্র, লোহিত লাল রঙের পাত্র, কালো মসৃণ মৃৎপাত্র ইত্যাদি।
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ভারতের অন্যান্য প্রাচীন বন্দরের মতন তাম্রলিপ্তি বন্দরে কিছুই নেই। কিন্তু বিশেষ কিছু প্রাচীন সাহিত্যের জন্য আমরা তাম্রলিপ্তি বন্দরের হারানো গৌরব ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি।