জোয়ান অফ আর্ক নামের একটি কিশোরি মেয়ে, যাকে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ডাইনি অপবাদে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। সময়টা ছিলো ১৪৩১ সালের ৩০ মে। যখন তাকে পোড়ানো হয়, তার গগনবিদারী আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে যায় চারপাশ। সীন নদীর তীরে উত্তর ফ্রান্সের এক লোকালয়ে একটি উঁচু পিলারে বেঁধে তাকে আগুনে পোড়ানো হয়, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সে ডাইনি! তাকে শুধু একবার পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা, বার বার তিন বার পোড়ানো হয়। সবশেষে তার শরীরটা যখন ছাই হয়ে যায় তখন সেই ছাই ছড়িয়ে দেয়া হয় ফ্রান্সের সীন নদীতে।

Joan of Arc burned in the artist's brush

শিল্পীর তুলিতে অগ্নিদগ্ধ জোয়ান অফ আর্কl

সেই সাহসী মেয়েটি ফ্রান্সের হিরোইন- জোয়ান অফ আর্ক। তার জন্ম ৬ ই জানুয়ারী ১৪১২ সালে। ফ্রান্সের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে তার জন্ম। বাবা জ্যাক ডি আর্ক ও মা ইসাবেল রোমিই। তিনি ছিলেন মুক্তিদাত্রী বীরকন্যা এবং রুপকথার গল্পের মতো এক নারী নেত্রী যিনি ইংরেজদের সাথে শতবর্ষ ধরে চলা যুদ্ধে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন (১৩৩৭-১৪৫৩)। তার স্মরনে ফ্রান্সে অনেক স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। জোয়ান লেখাপড়া জানতেন না। কথিত আছে যে, মাত্র তের বছর বয়সে মাঠে ভেড়ার পাল চরাবার সময় তিনি দৈববাণী শুনতে পান যে তাকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও ফ্রান্সের প্রকৃত রাজাকে ক্ষমতায় পূনর্বহাল করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। এই দৈববানী তার জীবনকে আমূল পালটে দেয়।

তখন ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে চার্লসের ছেলে সপ্তম চার্লসকে মনোনীত করা হয়, তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। কাছাকাছি সময়ে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড দু’দেশের রাজাই মারা গেলেন। ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন পঞ্চম হেনরি, রেখে গেলেন উত্তরাধিকারী শিশু ষষ্ঠ হেনরিকে। ফ্রান্সে তখন একটা প্রচলিত একটা ভবিষৎবাণী ছিল, এক কুমারী মেয়ে ফ্রান্সকে রক্ষা করবে।

চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানে পাশেই দাঁড়িয়ে জোয়ান l

যখন অর্লিন্স আর ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো তখন জোয়ান ভবিষৎবাণী করলেন, অর্লিন্সের কাছে ফ্রান্স যুদ্ধে হেরে যাবে আর সত্যি সত্যি ফ্রান্স হেরে গেল। লোকজন তখন কুসংস্কারে বিশ্বাসি ছিল। জোয়ানের ভবিষদ্বাণী সত্য হয়েছে দেখে লোকে তাকে ডাইনি মনে করতে লাগল। নিশ্চয়ই সে কালো জাদু করেছে। তাকে চার্চের প্রতিনিধিদের সামনে পরীক্ষা দিতে হলো, প্রমাণ করতে হল, জোয়ান কোনো ডাইনি নয়। পরীক্ষা পাশের পর জোয়ান হয়ে গেলেন সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন, নিলেন প্রশিক্ষণ।

১৪২৮ সাল, জোয়ান চার্লসের সেনা কমান্ডার রবার্ট বড্রিকটের কাছে গিয়ে বললেন, তিনি যুদ্ধ যেতে চান। রবার্ট সামন্তকে ডেকে এনে বললেন, এই মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাও তার বাপের কাছে, তারপর আচ্ছামত পেটাও। (তখন মেয়েদের যুদ্ধে যাওয়া একটা অবাস্তব ব্যাপার ছিলো) রবার্ট জোয়ানকে নিয়ে গেলেন ভবিষ্যৎ রাজা চার্লসের কাছে। সেখানে যাবার জন্য অবশ্য তাকে চুল ছোট করে, ছেলেদের পোশাক পরে নাইটের ছদ্মবেশে নিয়ে যেতে হয়েছিলো। জোয়ান চার্লসের কাছে অনুমতি চাইলেন যুদ্ধে যাবার জন্য। ধর্মযাজকদের মতানুসারে তিনি যুদ্ধে যাবার অনুমতি পেয়ে গেলেন, তার ব্যানারের নাম হলো যীশুর নাম।

তার নেতৃত্বে একের পর এক দুর্গ জয় করতে লাগল ফ্রান্সের সেনাবাহিনী। মে মাসের সাত তারিখে, লে তুরেলে দুর্গ অবরোধ করল ফ্রেঞ্চ বাহিনী। সে যুদ্ধে একটা তীর এসে জোয়ানের কাধে বিঁধে গেল, তিনি পড়ে গেলেন। কিন্তু না থেমে তিনি ফিরে এলেন এবং যুদ্ধ চালিয়েই গেলেন। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ফ্রেঞ্চরা নব উদ্যমে আক্রমণ চালালো। সেদিন ইংল্যান্ড হেরে যায় যুদ্ধে। দুর্গ জয় করে নেয় ফ্রান্স। এরপর জোয়ানের পরিকল্পনা অনুযায়ী রেইমস নগরী বিজয়ের পালা। জোয়ানের নেতৃত্বে তারা জিতে নিল রেইমস। কিন্তু এই নগরী কেন? কারণ এই নগরীতেই ফ্রেঞ্চ রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান হয়। ১৬ জুলাই নগরী হাতে আসবার পরদিনই, ১৭ জুলাই “ভবিষ্যৎ-রাজা” চার্লসের মাথায় মুকুট পরানো হয়, সেদিন থেকেই তিনি ফ্রান্সের রাজা সপ্তম চার্লস। তার অভিষেকের সময় চার্লসের পাশেই ছিলেন জোয়ান অফ আর্ক।

সেপ্টেম্বরের আট তারিখ ফ্রেঞ্চরা চেষ্টা করল ইংলিশদের অধিকার থেকে প্যারিস ছিনিয়ে নিতে। সেদিনের যুদ্ধে জোয়ানের পা জখম হয় ক্রসবো’র আঘাতে কিন্তু তাও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে নিতে লাগলেন। ১৪৩০ সালের মে মাসে, কম্প্যেন যুদ্ধের সময় বার্গান্ডিবাসীদের হাতে জোয়ান ধরা পড়ে গেলেন। তারা তাকে জেলে পুরে দিলো। বেশ কয়েকবার জোয়ান চেষ্টা করলেন জেল থেকে পালাবার, কিন্তু পারলেন না। এজন্য তাকে রাখা হলো টাওয়ারে। তিনি ষাট ফুট উঁচু টাওয়ার থেকে লাফ দিলেন। সেই দুর্গের চারদিকে পানিঘেরা পরিখা ছিল। তিনি সেখানে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। যখন জ্ঞান ফিরলো, গুরুতর আহত না হলেও চলতে পারার মতো সুস্থ তিনি ছিলেন না। তাকে ইংলিশদের কাছে ১০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে দেয়া হলো, যার মানে এখনকার হিসেবে কয়েক মিলিয়ন ডলার।

প্যারিসে জোয়ানের স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া মূর্তি।

ইংলিশদের প্রধান শত্রুই ছিল জোয়ান অফ আর্ক নামের এই কিশোরী, ধরা পড়বার আগ পর্যন্ত তাদের বিশ্বাসই হয়নি এই মেয়ে তাদের এত পরাজয়ের কারণ! এই মেয়ের কারণেই ইংলিশ সেনাবাহিনীর মনোবল ভেংগে চুরমার হয়ে গেছে! কীভাবে তাদের মনোবল আবার চাঙ্গা করা যায়? তারা জোয়ানকে ডাইনি হিসেবে প্রমাণ করতে চাইলো, কেবল কালো জাদু দিয়ে এই মেয়ে ইংলিশদের পরাজিত করেছে। একে সরিয়ে দিলেই ইংলিশ বাহিনীর আর কোনো বাধা নেই- এই বিশ্বাসটা সকলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চাইল তারা। তাকে ডাইনি আর ধর্মহীনতার দায়ে ফাঁসিয়ে দেয়া হলো। চার্চের প্রতিনিধিরা তাকে স্বীকার করে নিতে বলল, সে কোনো স্বপ্ন দেখেনি, কেউ স্বপ্নে তাকে কিছু বলেনি। তারা তাকে সৈন্যের পোশাক খুলে ফেলতে বলল কিন্তু তিনি তা করলেন না।

ফ্রান্সের রাজা চার্লস কিন্তু উদ্ধার করতে গেলেন না জোয়ানকে। ইংলিশ চার্চ কথা দিল, জোয়ান চার্চে গিয়ে কনফেশন নিতে পারবেন যদি তিনি সৈন্যদের পোশাক ছেড়ে মেয়েদের পোশাক পরেন। আর চার্চের কাছে কনফেশন দেয়া মানে পাপমুক্ত হয়ে যাওয়া,জোয়ান মেনে নিলেন।
কিন্তু আসলে তাকে মিথ্যে কথা বলা হয়েছিল। তাই তিনি আবার সেনার পোশাক পরে নিলেন। চার্চের প্রতি অবাধ্যতার জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। অন্য সব ডাইনির মতন তারও ভাগ্যে রইল আগুনে পুড়ে মৃত্যু। সীন নদীর তীরে ব্যস্ত লোকালয় রোয়াঁ’র বাজারে উইঞ্চেস্টারের কার্ডিনালের আদেশে তাকে তিনবার পোড়ানো হলো। এরপর ছাই ছিটিয়ে দেয়া হলো নদীতে। তখন তার বয়স ছিল আত্র উনিশ বছর।

জোয়ান অফ আর্কের নামে অনেক জিনিসই পরবর্তীতে প্রচলিত হয়। যেমন, ২০১৬ সালের মার্চে পুরনো একটা রিং নিয়ে দাবি করা হয়, এটা জোয়ান অফ আর্কের ছিল এবং সেই রিং কেবল জোয়ানের নামের জন্য ৩ লক্ষ পাউন্ডে বিক্রি হয়ে যায়! বলা হয়, আগুন ধরাবার আগে জোয়ান এ রিঙটা খুলে দিয়েছিলেন কার্ডিনালকে। এছাড়াও ১৮৬৭ সালে এক জার ছাই আবিষ্কৃত হয় প্যারিসে, যেখানে লিখা ছিল সেটা নাকি জোয়ান অফ আর্কের দেহাবশেষ!

প্যারিসের নটর ডেম ক্যাথেড্রালে জোয়ান অফ আর্ক এর আধুনিক মূর্তি।

পঁচিশ বছর পর পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাস ঘোষণা দিলেন, জোয়ান আসলে নিষ্পাপ ছিলেন। চার্চ মিথ্যা রায় দিয়েছিল। পাঁচশ বছর পর ১৯২০ সালে, ক্যাথোলিক চার্চ জোয়ানকে একজন সেইন্ট হিসেবে ঘোষণা করে। তার মৃত্যুদিবস (৩০ মে) ক্যাথলিকরা এখনও উদযাপন করে। ফ্রান্স এবং সেনাবাহিনীর প্যাট্রন সেইন্ট এখন জোয়ান।
এক সময়ের ডাইনি অপবাদের দায়ে পুড়ে মরা জোয়ান অফ আর্ক আজ ফ্রান্সের জাতীয় বীর।

তথ্যসূত্র
Wikipedia
roar-media
1 (‘’Joan of Arc: A History” by Helen Castor
2 (‘’Joan: The Mysterious Life of the Heretic Who Became a Saint” by Donald Spoto
3 (‘’The Trial of Joan of Arc” by Daniel Hobbins (Translation)