সিরাজ মরলেন ইউরোপিয় ধন লালসা আটকাতে গিয়ে। তিনি না মরলে, পলাশী না হলে, ইউরোপ হত আজকের এশিয়া/আফ্রিকা; শহীদ সিরাজের হত্যা বিষয়ক কয়েকটি লেখা পড়লাম। কিছু ইউরোপিয় ঐতিহাসিকের প্রতিপাদ্য, পলাশী হয়ই নি, সিরাজকে খুন করে মীরজাফর, ইত্যদি ইত্যাদি। এবং পলাশীতে ইউরোপিয়দের কিছু করার ছিল না, সেটা তাদের কাছে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। আমাদের কারিগরদের কাছে সিরাজ কি করে মারা গেলেন সে ইতিহাস গৌণ, সিরাজ যে বাংলায় ব্রিটিশ ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী কোম্পানি আমলা নবোবদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, এবং সে জন্যে প্রাণ দিলেন, সে তথ্যটা প্রাথমিক। সিরাজ না মরলে, পলাশী না হলে ইউরোপ হত আজকের এশিয়া, বাংলার ব্যাপক বিনিয়োগ না গেলে ইউরোপের লুঠেরা প্রযুক্তি পুঁজি এবং জীবনযাত্রার বিকাশের মুখড়া শিল্পায়নটাই আটকে যেত। বাংলার ভাগ্যবান নবজাগরিত বাবুরা আজও অধমর্ণ হয়ে কাটাতেন শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান-আদিবাসী কারিগরদের অধীনে।

আমরা কারিগরেরা ইতিহাস খুঁজি যা ব্যতিক্রমী, জোরালো এবং মূলধারার ইতিহাসে সরাসরি অনুল্লেখিত। প্রবীন ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী স্পষ্ট ব্যতিক্রমী ইতিহাসবিদ যিনি বর্তমান ইউরোপিন ইতিহাসের উল্টো রাস্তায় হেঁটে সোজাসুজি বলেছিলেন সিংহাসনে বসার পরে সিরাজ অন্য মানুষ এবং কোম্পানিকে পলাশী ঘটাতে হয় ব্রিটিশ আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বজায় রাখার জন্যে।

এ তথ্য অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। সিরাজ নিয়ে আমরা আজও সুশীলবাবুর অনুগামী, যদি না কোন ব্যতিক্রমী ভাবনা সেটাকে পেড়ে ফেলতে পারে। সিরাজ বিষয়ে সুশীলবাবুই পথ দেখাচ্ছেন। আমাদের খোঁজ ছোটলোকের ব্যবসা আর তাদের ব্যবসা কেড়ে নেওয়া আর বাংলা জ্ঞান আর সম্পদ লুঠের ইতিহাস খোঁজা। অন্য সব গৌণ। বাংলা বা উপমহাদেশের কারিগর অর্থনীতি এবং তাকে বিশ্ববাজার থেকে বর্জনের ইতিহাস নিয়ে কেউই প্রায় কাজ করেন নি বলতে গেলে। আমাদের খোঁজা শুরু হয়েছে শূন্য থেকেই – কিছু পুরোক্ষ সূত্র দেখে।

ইউরোপিয়রা উপমহাদেশে এসেছিল প্রাথমিকভাবে দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে

১) বাণিজ্য! তাদের দেশে কিছুই প্রায় উৎপাদন হত না। বিশ্বের কারখানা ছিল উপমহাদেশ চিন আর পারস্য অক্ষ।

২) হাজারেরও বেশি বছর ধরে বাণিজ্যে যে ইউরোপের অধমর্ণতা ছিল, যেটা সে কাটাবার চেষ্টা করছিল ধর্মযুদ্ধের ছদ্মবেশে, সেই অধমর্টিণতাকে ইওরোপের পক্ষে উত্তমর্ণতা করানো। অর্থাৎ ইওরোপের পক্ষে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত তৈরি করা।

পোপের নির্দেশে পর্তুগিজ থেকে ফরাসী থেকে ডাচ থেকে ব্রিটিশ সক্কলেই চেষ্টা করেছে সোনার দেশ ভারত উপমহাদেশ দখলের, সফল হয়েছে ব্রিটিশ। ব্রিটিশেরা যুদ্ধে অজেয় পলাশীর আগে এ রকম কোন তত্ত্বই ছিল না। মুঘলদের সঙ্গে তারা লড়াইতে গোহারাণ হেরেছে – স্বয়ং সিরাজের সঙ্গে হেরেছে পলাশীর আগের বছরেই – ল্যাজ গুটিয়ে পালাবার জায়গা ছিল না। এমনকি তারা ১৮০০/১২০৭ সালেও টিপু সুলতানের সঙ্গেই পেরে উঠছিল না মারণ হাউয়ের বিরুদ্ধে লড়ে। সেই হাউই উলরিচে নিয়ে গিয়ে গবেষণা করে নতুন ধরণের হাউই উদ্ভাবন করে। তাতেও সফল হয় না – টিপুকে বশ করতে হয় বিশ্বাসঘাতকএর সাহায্যে। সেই হাউই নিয়ে তারা ফরাসীদের বিরুদ্ধে জেতে ইত্যাদি।

টিপু সুলতান বা ফতেহ আলী সাহাব টিপু

ভারতে ইওরোপিয় মারের ইতিহাসটা পলাশী থেকে শুরু নয় তার অনেক আগে থেকেই চলছে – সেটা পলাশীতে গিয়ে পূর্ণতা পেল। কি করে? শুধু পলাশী থেকে ক্লাইভই আইনি ঘুষে রোজগার করেছিল আজকের মুদ্রায় ১১২২৮ কোটি টাকা, বাঙ্গালি ব্রিটিশ অনুগামীদের কথা হিসেবে আনি নি।

পলাশীর যুদ্ধের মানচিত্র

পলাশী ছিল বিশ্ব ইতিহাসের ব্যতিক্রমী বিন্দু – যদিও হাবিবেরা যাতটা বক্সারকে গুরুত্ব দ্যান, পলাশীকে অজানা কারণে খুব বেশি গুরুত্ব দেন না। মনে রাখতে হবে ছলে বলে কৌশলে ইওরোপ তার ব্যালেন্স অব পেমেন্টের গতি পালটে ফেল্ল পলাশীর লুঠের প্রাবল্যে। এতদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ, লাতিন আমেরিকা, আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া কোথাও বাণিজ্যের নামে, কোথাও দাস ব্যবসায়, কোথাও শুধু দস্যুতা চালিয়ে, কোথাও বাজার থেকে(যেমন্ আমস্টারডামের দামি ধাতু বাজার থেকে রূপো আর সোনা কিনে) সোনা রূপো লুঠ করে এই উপমহাদেশ, চিন আর পারস্যে ব্যবসা করতে আসত। উপমহাদেশে ব্যবসার রীতিই ছিল মূলত দামি ধাতু আর দামি রত্ন বিনিময় – যে জন্য আজও বিনিময়ে রূপিয়া কথাটা থেকে গিয়েছে – দামি ধাতু, কড়ি মদ্য, মশলা আর ঘোড়াই ছিল উপমহাদেশের একমাত্র আমদানি। ইওরোপের কোন পণ্যই বাংলা বাজারে এবং সারা এশিয়ার পাতে দেওয়ার যোগ্য ছিল না। বাংলা পণ্য কেনার জন্যে কার্যকরী সম্পদ ইওরোপিয়রা উপমহাদেশে বাণিজ্যের জন্য যোগাড় করত সারা বিশ্বে সন্ত্রাস চালিয়ে, সেটা কোম্পানিগুলোর ভাষায় ইনভেস্টমেন্ট।

পলাশীর পরের লুঠে কোম্পানি এত আইনি রোজগার করল(আরও বিপুল বেআইনি রোজগারের কথা বলছিই না) যে তাকে আর ইওরোপ বা সারা বিশ্বজুড়ে আর বাংলা/এশিয় পণ্য কিনতে ইনভেস্টমেন্ট জোগাড় করতে হল না – অথচ বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসেরও শেষ হল না। পলাশীর এক বছর আগেও ১৭৫৭/১১৬৪ সে জাহাজ ভরে সোনারূপো এনেছে ইওরোপ থেকে ১৭৫৮/১১৬৫ থেকে তারা হাজার হাজার জাহাজ ভরে নিয়ে যেতে শুরু করল দামি ধাতু বাংলা থেকে। বাংলার টাঁকশালের দখল নিল ব্রিটিশ যা সিরাজের সময় পায় নি। তাকে রূপো আড়াই শতাংশ বাটায় ভাঙ্গাতে হত বাংলায়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্রিটিশেরা বাংলার লুঠ এবং খাজানা দখল করে পণ্য কেনার বিনিয়োগ তুলল, কিন্তু অন্য ইওরোপিয় কর্পোরেট কোম্পানির কি দশা হল? তারাও তো সারা বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগ বাংলায় এনে পণ্য কিনত। এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ, কেননা পলাশীর লুঠ শুধুই ব্রিটিশদের পক্ষে আশীর্বাদ হয়েছিল তাই নয় গোটা ইওরোপই এই লুঠে ফুলে ফেঁপে উঠেছে – আজকের ইওরোপের ধণাঢ্যতার ভিত গড়েছে পলাশী – আজও তারা সেই লুঠের সুদে দিন কাটাচ্ছে আসলে হাত পড়ে নি। ভারতের সব থেকে ধনশালী ভূখণ্ড বাংলায় বিপুল ব্রিটিশ ফ্রি মার্চেন্ট, ইন্টারলোপার্স আর কোম্পানির চাকুরেরা ব্যক্তিগত বাণিজ্য করে যা রোজগার করত(যেটার বিরুদ্ধে আলিবর্দি আর সিরাজ খডগ হস্ত ছিল, যাকে আটকাতে গিয়েই সিরাজকে প্রাণ দিতে হল), সেই লাভ আইনিভাবে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া মুশকিল ছিল। তারা সেই বিপুল লাভ বিনিয়োগ করল ফরাসী, ডাচ ইত্যাদি কোম্পানিতে এবং সেই বিল আমস্টার্ডামে বা প্যারিসে গিয়ে তারা ভাঙ্গিয়ে নগদ অর্থ লন্ডনে নিয়ে আসত। ফলে অন্যান্য ইওরোপিয় কোম্পানিগুলোকে আর বাংলায় ব্যবসা করতে অর্থ বিনিয়োগ করতে হল না, ব্রিটিশ ব্যক্তি ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগেই বাংলায় ব্যবসা চালিয়েছে তারা। পলাশীর ফলে সামগ্রিক ইওরোপ এক বছরেই উত্তমর্ণ হয়ে উঠল।

বিশ্বের ইতিহাস পালটে গেল চিরতরে। তারপরে শুরু হল ব্রিটিশদের শিল্পায়ন আর বাংলার বিশিল্পায়ণ আর কারিগরদের অধমর্ণতা। গোটা ইতিহাসটা আসলে আমরা শূদ্র কারিগরেরা এই দিক থেকে দেখি – শেষ পর্যন্ত সিরাজ বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, পারেন নি। শহীদ সিরাজকে যোগ্য সম্মানটাও দেওয়া হয় নি। অন্য সব কিছু অনুগল্প।

ছবিঃ ইন্টারনেট