নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর এলগিন রোডের বাড়িটি কলকাতার লোকজনের কাছে ‘বসু বাড়ি’ নামে পরিচিত। কিন্তু বসুদের দুটো বাড়ি ছিল কলকাতায়। একটি এলগিন রোডে ৩৮/২ নম্বর বাড়ি। আরেকটি ভিক্টোরিয়া প্যালেসের উল্টোদিকে উডবার্ন পার্কের ১ নম্বর বাড়ি। কিন্তু পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় ৩৮/২ নম্বর বাড়িটিতে সকলের স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিল না। তাই পাশের বাড়িটি ১৯২৭ সালে নেতাজির মেজ ভাই শরৎচন্দ্র বসু ভাড়া নেন। পরের বছর তারা উডবার্ন পার্কের বাড়িটিতে চলে আসেন।
উডবার্ন পার্কের বাড়িতে ১৯৩৭ সালে মহাত্মা গান্ধী এসেছিলেন। সেবার কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসেছিল এখানে। জওহরলাল নেহেরুও এখানে থেকেছেন। ১৯২৮ সালে উডবার্ন পার্কের বাড়িটির কাজ শেষ হয়। তারপর শরৎ বসু ছোটভাই সুভাষকে নিয়ে এ বাড়িতে উঠে আসেন। তিন তলায় নেতাজি থাকতেন। নিচ তলায় শরৎ ও সুভাষের চেম্বার ছিল। দোতলায় শরৎ বসু নিজ পরিবার নিয়ে থাকতেন। ১৯২৮ থেকে ৩২ সাল পর্যন্ত নেতাজি যত চিঠি লিখেছেন তাতে ১ উডবার্ন রোডের বাসার ঠিকানা ছিল। ১৯২৮ সালে বিখ্যাত কলকাতা কংগ্রেসের আয়োজন এ বাড়িতেই হয়েছিল। সেবার বেঙ্গল ভলেনটিয়ার্সরা মতিলাল নেহেরুকে যে সামরিক অভিবাদন জানিয়েছিল তা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। মতিলাল নেহেরু সেবার এ বাড়িতেই উঠেছিলেন। ৩৭-এ কলকাতায় ফিরে আসার পর অবশ্য তিনি ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়িতেই থাকতেন। এছাড়া দার্জিলিং-এর কার্সিয়াং-এ শরৎ বসুর আরেকটি বাড়ি ছিল। সে বাড়িতে নেতাজি অনেকবার স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য গিয়েছেন।
এ পরিবারের মূলত দুটো গাড়ি ছিল। একটি স্টুডি বেকার প্রেসিডেন্ট, আরেকটি ওয়ান্ডারার ডব্লু ২৪। পরেরটি ব্যবহার করতেন সুভাষচন্দ্র বসুর মেজ ভাই শরৎচন্দ্র বসু। যিনি বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা ও পরবর্তীতে ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। গাড়িটি বর্তমানে নেতাজি মিউজিয়ামে রয়েছে।
১৯৪১ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ৩৮/২ এলগিন রোডের বাসায় নেতাজি অবস্থান নিয়েছিলেন। সবাই জেনে গিয়েছিল নেতাজি নির্জনব্রত পালন করছেন। গৃহভৃত্যরা তার কক্ষের সামনে খাবার দিয়ে যেত। তিনি খাবার খেয়ে দরজার সামনে থালা বাটি রেখে দিতেন। এটা আসলে তার একটা কৌশল ছিল। অনেকে ভেবেছিলেন ঋষি অরবিন্দের মতো হয়ত তিনিও ধর্মপথে চলে যাবেন। কিন্তু ব্রিটিশরা বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখত। নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখত। এমনকি রাতের বেলা ভবঘুরের বেশে তার বাসার সামনে শুয়ে থাকত।
স্টুডি বেকার প্রেসিডেন্ট গাড়িটি শরৎ বসু ব্যবহারের কারণে পুলিশের কাছে বেশি পরিচিত ছিল। তাই এদের চোখ ফাঁকি দিতে নেতাজি পালিয়ে যাওয়ার জন্য ওয়ান্ডারার ডব্লু ২৪ গাড়িটি নির্বাচন করেন। ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি ১টা ৩৫ মিনটে এ গাড়িতে চেপে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। চালক হিসেবে ছিলেন নেতাজির ভাইপো শিশিরকুমার বসু। তখন তার বয়স ছিল ২১ বছর। যিনি পরে কলকাতায় চিকিৎসক হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। গাড়িটি তাকে বিহারের গোমো স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসে। স্টেশনটি এলগিন রোডের বাসা থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। এ নিয়ে শিশির বসুর বিখ্যাত একটি বই আছে। নাম ‘মহানিষ্ক্রমণ’।
পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে প্রথমে একটু দক্ষিণমুখী গাড়ি চালান শিশিরবাবু। অ্যালেনবি রোড ঘুরে আবার একটু উত্তরে সরে আজকের শরৎ বসু রোড হয়ে শিয়ালদহ, হ্যারিসন রোড হয়ে হাওড়া হয়ে গোমো পৌঁছন তারা। সুভাষচন্দ্রকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে শিশিরবাবু কলকাতা ফিরে আসেন। এই ঐতিহাসিক গাড়িটিকে সংস্কার করে বর্তমান ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়িতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। যা এখন নেতাজি মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯৩৭ সালে শরৎ বাবু ৪,৬৮০ টাকায় গাড়িটি ক্রয় করেন। গাড়িটি তার নামেই সে বছর রেজিস্ট্রেশন করা হয়। রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল বিএলএ ৭১৬৯। জার্মানির গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অডি এটি নির্মাণ করে।
১৯৫৭ সাল পর্যন্ত শিশির বসু নিয়মিত এ গাড়ি ব্যবহার করতেন। তাঁর পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ভ্রমণে যেতেন। ১৯৫৭ সালে নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো গড়ে তোলার পরে নেতাজি সংগ্রহশালায় প্রথম যে বস্তুটি প্রদর্শনের জন্য দেওয়া হয়, সেটি ওই ওয়ান্ডারার গাড়ি। ১৯৭৯ সালে নেতাজিকে নিয়ে একটি জাপানি ছবির শুটিংয়ে গাড়িটি শেষবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছিল।
গাড়িটি এরপর দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হয়নি। জার্মান গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা অডি-র পূর্বসুরি অটো ইউনিয়নের সাহায্য চাওয়া হয়। অডি-র পক্ষে কাশিমবাজারের পল্লব রায় গাড়িটির রোস্টেরেশনের কাজ করেন। ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি গাড়িটিতে ভারতের জাতীয় পতাকা লাগিয়ে গাড়িটির নবযাত্রা উদ্বোধন করেন। তিনি নতুনভাবে চালু হওয়া গাড়িটি চড়ে কিছুটা পথ অতিক্রম করেন।
তবে অন্য গাড়ি স্টুডি বেকার সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায়নি। গাড়িটি কোথাও সংরক্ষণ করা হয়েছে কিনা তাও বলা সম্ভব নয়। তাই সে গাড়ির ছবি দেওয়া যায়নি। তবে একই মডেলের অন্য একটি গাড়ির ছবি দেওয়া হলো। বোস বাড়ির এ স্টুডি বেকার গাড়িটি সেসময় খুবই বিখ্যাত ছিল। মহাত্মা গান্ধী কলকাতায় এসে বহুবার এ গাড়ি ব্যবহার করেছেন। পত্রিকার ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ১৯৩৭ সালের ২৬ অক্টোবর কলকাতা সফরে এসে তিনি এ গাড়িতে করেই রামরাজাতলা স্টেশন থেকে বসু বাড়িতে এসেছিলেন।
সূত্র:
বসু বাড়ি, শিশির কুমার বসু
The Lost Hero by By Mihir Bose
দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, এইসময়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস