ভীমবেঠকা গুহাতে আছে বিশাল বিশাল সব পাথরের চাঁই, আর সেইসব পাথরের গায়ে আঁকা আছে নানাধরনের ছবি, ছবিগুলি অন্তত পন্চাশ হাজার বছর থেকে এক লক্ষ বছর আগের আঁকা। এখানে আছে প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া বিভিন্ন আকারের পাথরের গুহা, যে কারনে প্রস্তর যুগের মানুষেরা সেখানে আশ্রয় নিয়ে রোদ- বৃষ্টি ও বন্য জীবজন্তুর হাত থেকে নিরাপদে থাকতে পারতো।বিশ্বের প্রাচীনতম পাথরের মেঝে ও দেওয়াল এখানে দেখা গেছে।
এখানকার পাথরগুলি একেকটা একেক আকারের, এইরকম প্রায় একশো কুড়ি – তিরিশটা রক শেল্টার আছে। ভীমবেটকাকে বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান ঘোষণা করে ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদন দেয়, সে অনুযায়ি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের নথিতে এই জায়গাটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮৮৮ খ্রিঃ, একটি বৌদ্ধ মঠ জাতীয় কিছু হিসেবে। এই তথ্য পাওয়া গিয়েছিল স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে।
ভীমবেঠকা গুহাটি ভারতের মধ্য প্রদেশের রায়সেন জেলায়, ভোপাল শহরের ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিন ঢালে অবস্থিত। ভীমবেঠকার আসল নাম ভীমবৈঠক, কথিত আছে ভীম মাঝে মাঝে এখানে এসে বসতেন। ১৯৫৮ সালে ভি এস ওয়াকানকার নামে একজন ঐতিহাসিক এই জায়গাটা আবিস্কার করেছেন। এখানে প্রস্তর যুগের গোঁড়ার দিক থেকে (অর্থাৎ ১০০,০০০ বছর আগে) প্রস্তর যুগের শেষ পর্যন্ত ( ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ বছর আগে) একটানা মানুষ বসবাসের চিহ্ন আছে, তাদের তৈরী পাথরের কুঠার ও অন্যান্য জিনিষপত্র ( মাইক্রোলিথিক টুলস্) পাওয়া গেছে।
এখানকার এইসব গুহাতে সম্রাট অশোক কিংবা গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় পর্যন্তও মানুষ ছিল এমন প্রমানও পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকরা এইসব ছবি পরীক্ষা করে প্রমান করেছেন ছবিগুলি অন্তত পন্চাশ হাজার বছর থেকে এক লক্ষ বছর আগের আঁকা।আর আছে আদিম মানুষের আঁকা হাজার হাজার ছবি।নতুন কয়েকটা মধ্যযুগেও আঁকা হয়েছে। আঁকার জন্য তারা উদ্ভিজ্জ রঙ ব্যাবহার করতো, সময়ের সাথে সাথে এই রঙ নষ্ট না হওয়ার কারণ হচ্ছে ,ছবিগুলো আঁকা হত গুহার ভেতরের গভীর অংশের দেওয়ালের গায়ে ও ছাদে। যেহেতু এই ছবিগুলি রোদ- বৃষ্টির ছোঁয়া পেতোনা, তাই রং নষ্ট হয়নি। ছবিগুলি বিভিন্ন বিষয়ের উপর আঁকা হয়েছে এবং সেগুলি আঁকাও হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। চিত্রশিল্পে মানুষের চেহারার অবয়ব থেকে শুরু করে শিকারের দৃশ্য, ধর্মীয় চিহ্নসহ সব বিষয়ই জায়গা পেয়েছে।
গুহাচিত্রগুলোকে বোঝার জন্য কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়। যেমন- মানুষের অবয়ব (নর-নারী), প্রাণী (বিভিন্ন প্রজাতির), শিকারের দৃশ্য, রণসংগীত, নৃত্যানুষ্ঠান, পৌরাণিক কাহিনী এবং বিভিন্ন নকশার মধ্য দিয়ে অলংকারিক সাজসজ্জা। ছবিগুলোকে সময় অনুযায়ী সাত ভাগে ভাগ করা যায়—
প্রথম যুগ- (উচ্চ প্যালিওলিথিক) সবুজ ও গাঢ় লাল রেখাচিত্র, বিষয়বস্তু বৃহদাকার পশু, যেমন বাইসন, বাঘ, গন্ডার।
দ্বিতীয় যুগ- (মধ্য প্রস্তর যুগ) অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ছবি, ছবির মধ্যে রেখার নকশা। জীবজন্তু ছাড়াও আছে মানুষের ছবি ও শিকারের ছবি। শিকারের দৃশ্যে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রের পরিষ্কার ছবি দেখা যায়: কাঁটাওয়ালা বর্শা, ছুঁচলো লাঠি ও তীর-ধনুক, গোষ্ঠীগত নাচ, পাখি, বাজনা, মা ও শিশু, গর্ভবতী মহিলা, মৃত পশু কাঁধে পুরুষ, পানভোজন ও মৃতের সমাহিতকরণের ছবি।
তৃতীয় যুগ- (তাম্রযুগ) অন্যান্য জায়গায় পাওয়া তাম্র যুগের ছবির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই সময়ের ছবি থেকে বোঝা যায় সমসাময়িক গুহাবাসীরা মালওয়া সমভূমির কৃষিজীবীদের সাথে বিনিময় প্রথায় যোগাযোগ রাখত।
চতুর্থ ও পঞ্চম যুগ- (প্রাথমিক ঐতিহাসিক): এই সময়কার ছবিতে স্পষ্ট নান্দনিক সামঞ্জস্যের চিহ্ন পাওয়া যায়। তাদের ব্যাবহার করা রঙ ছিল- লাল, সাদা ও গেরুয়া। ঘোড়সওয়ার, ধর্মচিহ্ন, আলখাল্লার মতো পোশাক এবং বিভিন্ন সময়ের লিপির নিদর্শন এখান থেকে পাওয়া যায়। যক্ষ মুর্তি বৃক্ষদেবতা এবং আকাশ-রথের ছবি থেকে ধর্মবিশ্বাসের প্রমাণ মেলে।
ষষ্ঠ ও সপ্তম যুগ- (মধ্যযুগ) এই ছবিগুলো জ্যামিতিক ও সুসংবদ্ধ হলেও শৈল্পিক উৎকর্ষের অবক্ষয়ের পরিচয় দেয়। ব্যবহৃত রঙ তৈরি করা হত ম্যাঙ্গানিজ, হেমাটাইট ও কাঠকয়লার মিশ্রণে। একটা পাথরে হাতি, সম্বর হরিন, বাইসন ও হরিনের ছবি পাওয়া গেছে। আর একটা পাথরে একটা ময়ূর একটা সাপ, একটা হরিণ আর সূর্যের ছবি পাওয়া গেছে। আরও একটা পাথরে দাঁতওয়ালা দুটো হাতি পাওয়া গেছে। প্রাগৈতিহাসিক ছবির মধ্যে ধনুর্বাণ ও ঢাল-তলোয়ার ব্যবহারকারী শিকারীদের দেখা যায়।
#তথ্যসূত্র
#কাকাবাবু_সিরিজ_ভূপাল_রহস্য_সুনীল_গঙ্গাপাধ্যায়
#উইকিপিডিয়া
#ছবি_roar_media