বীরবল। ইতিহাসের একটি হাস্যোজ্জ্বল চরিত্র। ইতিহাসপ্রেমীরা তো বটেই এছাড়াও এই উপমহাদেশে এমন কেউ নেই যারা বীরবলের নাম শোনেননি বা তাকে চেনেননা। সম্রাট আকবর আর বীরবলের মিষ্টি সম্পর্কের গল্প, হাসি ঠাট্টার গল্প আমরা ছোট বেলা থেকেই শুনে বড় হয়েছি। কিন্তু আমরা হয়তো সম্রাট আকবর আর বীরবলের সম্পর্কের গভীরতা ঠিক কতটা ছিল তা সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারিনি l আজ সেই গল্পই করছি l

বীরবলের জন্ম হয় এক ব্রাম্মণ পরিবারে। আমরা তাকে বীরবল বলে চিনলেও এটা তার নাম নয়, উপাধি। তার আসল নাম ছিলো মহেশ ভাট। ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতির সংস্পর্শে বড় হয়েছেন তিনি l তিনি একাধারে ভালো শিল্পী, কবি আর অসাধারণ একজন মজার মানুষ ছিলেন। সবাইকে মজার মজার কৌতুক বলে বা গল্প শুনিয়ে আনন্দ দিতেন তিনি l একদিন সম্রাট আকবরের কানেও তার এই খ্যাতির খবর পৌঁছায়। বীরবলের ডাক পরে তার কাছে, বীরবল উপস্থিত হয় তার দরবারে। বহু গুণের সমাহার ছিল তার মধ্যে l তিনি শুধুমাত্র একজন ভালো কবি বা সংগীতজ্ঞ ছিলেন না । তিনি অসামান্য একজন যোদ্ধাও ছিলেন। পাঞ্জাবের সুলতানপুরের যুদ্ধে তার যোগ্যতা দেখে সম্রাট আকবর তাকে বীরবর উপাধি দেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই নামটি বীরবলে পরিণত হয়।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে বীরবল সম্রাট আকবরের দরবারে এসেছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার প্রতিভা ও যোগ্যতার জন্য রাজা উপাধি পান। বীরবলের মাঝে সম্রাট আকবর দেখেছিলেন এক অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব, প্রাণবন্ত মন, আকর্ষিক বুদ্ধিমত্তা আর সব থেকে বড় যে জিনিসটা ছিল তা হল, সম্রাটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও নিষ্ঠা। বীরবলের অসাধারণ কবি প্রতিভার জন্য তাকে কবি রাই বা কবিদের রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন আকবর। তিনি ব্রজের একজন কবি ছিলেন আর সম্রাটের দরবার বীরবলের কবিতায় মুখরিত হয়ে উঠতো। তিনি একজন উদার মনের মানুষও ছিলেন। তার এতো সব প্রতিভার কারণেই মোঘল দরবারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিতে সময় লাগেনি।

একবার রাজ্যের উত্তর – পশ্চিম অংশ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ইউসুফ জাই ও মান্দার আফগান উপজাতিকে বারবার হারানোর পরেও তাদেরকে পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই সম্রাট আকবর জৈন খানের সাথে বীরবলকেও পাঠান যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখার জন্যে। এদিকে বীরবলের প্রতি সম্রাটের এই ভালোবাসা অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেননি। জৈন খান তাদের মধ্যে একজন। সে মিথ্যে কথা বলে বীরবলসহ সম্রাট আকবরের প্রায় আট হাজার সৈন্যকে একটি দুর্গম পথে পাঠান, যেখানে আফগান সৈন্যদের ফাঁদ পাতা ছিল। বীরবল ও তার সৈন্যরা যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত লড়াই করে গেলেও মৃত্যুকে কেউ এড়াতে পারেননি। এ কঠিন খবর আকবর সহ্য করতে পারেননি। আবুল ফজলের ভাষ্যমতে, প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ সম্রাট আকবরকে একেবারে স্তব্ধ করে দেয়। টানা দুদিন তিনি কিছুই খাননি। এমনকি দরবারের সব কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। নিজেকে ঝড়কা দর্শন থেকে বিরত রেখেছিলেন l তুরান থেকে আগত অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেননিl টানা দুইদিন না খেয়ে থাকার পর ছেলের সাথে দেখা করতে পাঞ্জাব থেকে আসা মা হামিদা বানুই তাকে খাওয়াতে পেরেছিলেন। হামিদা বানু সভাসদদের সাথে নিয়ে সম্রাটকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আনার চেষ্টা করেন। শুধু আকবর নয় ,পুরো দরবার বীরবলের শোকে কাতর হয়ে গিয়েছিল। শোকে কাতর দরবারের কবি কেশবদাস তাঁর স্মরণে ব্রজভাষায় দুঃখ ভরা একটি শ্লোকও লিখেছিলেন। বীরবলের মৃত্যু কেন সম্রাটকে এতটা নাড়িয়ে দিয়েছিলো? তিনি কি শুধুই একজন সভাসদ ছিলেন বলে? নাকি অন্য আরও কোন কারণ ছিল? সেগুলোই বিশ্লেষণ করবো।

বীরবল, সম্রাট আকবরের কাছে কতটা প্রিয় ছিলেন সেটা বোঝাতে গেলে আমাদের কতগুলো গল্পের অবতারণা করতে হবে। একবার সম্রাট আকবর দুটি বন্য হাতির মধ্যকার লড়াই দেখছিলেন। প্রিয় বন্ধু বীরবলও ছিল সেখানে। এমন সময় বন্য হাতি দুটোর একটি এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে শুরু করে। তারপর হঠাৎ করেই তেড়ে আসতে থাকে এক ভৃত্যের দিকে। ঘটনার এই পর্যন্ত বেশ ভালোই ছিল যদি না হাতিটি অর্ধেক পথ অতিক্রম করে দিক পরিবর্তন করে বীরবলের দিকে ছুটতো। হাতিটি বীরবলকে নিজের শুর দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলেছিলো। এমন অবস্থায় বীরবলের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব ছিল না সেখান থেকে ছুটে আসার। ঘটনার আকস্মিকতায় সম্রাট আকবর বিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনি একজন সম্রাট হয়েও কোন কিছুর পরোয়া না করে নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে হাতিটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপস্থিত সব সভাসদরা ততক্ষনে চিৎকার করতে লাগলো। আকস্মিক এই আক্রমণে হাতিটি বীরবলকে ছেড়ে আকবরের দিকে ঝুকেছিলো। আকবরের এই সাহসিকতার কারণেই সেদিন বীরবল রক্ষা পেয়েছিলেন। এতেই বোঝা যায় যে, আকবরের জীবনে বীরবল কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বন্ধুর প্রাণ বাঁচাতে নিজের জীবনের পরোয়া করেননি।

আরেকটি ঘটনা এমন, সম্রাট পলো খেলতে ভীষণ পছন্দ করতেন। এই খেলায় তার সঙ্গী হতেন বীরবল। একদিন খেলতে খেলতে বীরবল ঘোড়া থেকে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সম্রাট আকবর চাইলেই হাজার ভৃত্য বীরবলের সেবায় নিয়োজিত হতো। কিন্তু না, তিনি তা করেননি। তিনি নিজে বীরবলের সেবা করে তার জ্ঞান ফেরান। এই ঘটনা দুটি থেকে বোঝা যায়, সম্রাট আকবর বীরবলকে কতটা পছন্দ করতেন। সম্রাট আকবরের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসী ব্যাক্তি হিসাবে বীরবল যে ত্রিশ বছর দরবারে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তার মাঝে এমন একটা দিনও নেই যে সম্রাট বীরবলের প্রতি একটিবারের জন্যেও বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু সম্রাট অন্যান্য দরবারীর ভুলের কারণে কখনো কখনো ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং শাস্তিও দিয়েছিলেন। যেমন মান সিং যখন হলদিঘাটির পরে মহারানা প্রতাপকে অনুসরণ করতে পারেননি তখন সম্রাট আকবর মান সিং এর প্রতি রাগান্বিত হয়েছিলেন, যদিও মান সিং- ও তার প্রিয়ভাজনদের মাঝে একজন ছিলেন। সরকারী কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের দ্বারা ভুল ও অপকর্মের প্রতি সম্রাটের তীব্রতা ছিল লক্ষণীয়। তিনি প্রকাশ্যে লিখেছিলেন, ‘জনসাধারণের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেকোন কাজের জন্য অপরাধীদের প্রতি তিনি সবচেয়ে কঠোর।’ এতো আইন, এতো কঠোরতার মাঝেও কেবল তিনজন ব্যাক্তিই তাদের পুরো কর্মজীবনে সম্রাটের অসন্তুষ্টির কারণ হননি। তারা হলেন, কবি ফয়জি, সুরকার তানসেন এবং রাজা বীরবল।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা না বললেই নয়। আগ্রায় সম্রাট আকবরের প্রাসাদ থাকা সত্তেও তিনি ঠিক করেছিলেন আগ্রার মতো ফতেহপুর সিক্রিতে তিনি প্রাসাদ তৈরি করে ওখানে স্থায়ী হবেন। যা ভাবা তাই কাজ l প্রাসাদ, হারেম, ইবাদাতখানা সবই তার জন্য নির্মাণ করা হলো l বীরবলকে তার সর্বক্ষণ পাশে চাই l তাই তার প্রিয় বন্ধু বীরবলের জন্যেও পাথরের তৈরী একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তার প্রাসাদের পাশেই। উদ্দেশ্য সফল হলো। প্রিয় বন্ধুটিকে সবসময় তার পাশেই পেলেন। পরিবারের সকলকে নিয়ে তিনি এখানে এসেছিলেনও থাকতে l কিন্তু বিধির বাম,তার আর থাকা হলোনা। রাজ্যের কাজের জন্য তিনি আগ্রায় গেলেন , কিন্তু অগ্রা থেকে আর ফতেহপুর সিক্রি ফেরত যাওয়া হলো না। রাষ্ট্রীয় কাজে আগ্রাতে গিয়ে কাজ শেষ করে তিনি আর ফতেহপুর সিক্রিতে ফিরে আসবেন না, তা কেউ ধারণা করতে পারেননি। কারণ তার মা, বোন, স্ত্রী, ফুফু সবাই সেখানেই অবস্থান করছিলেন। যদি ফতেহপুর সিক্রি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নিতেন, তাহলে পুরো পরিবারকে সেখানে রেখে আসতেন না। না আসার এই সিদ্ধান্ত কেনই বা নিলেন সম্রাট? একটু চিন্তা করিl অনেক ঐতিহাসিকবিদরা বলেন,পানির সমস্যার কারণেই সম্রাট আকবর আর ফতেহপুর সিক্রিতে ফিরে আসেননি। কারণ সেই সময় নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় শহরে পানির ঘাটতি দেখা গিয়েছিলো।

কিন্তু এখন মনে হয় আসল কারণ তা ছিল না। পানির সমস্যা যদি প্রধান কারণ থাকতো তাহলে পরিবারে সকলকে নিয়ে, পাকাপাকিভাবে তিনি চলে আসতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। হয়তো দুটি মৃত্যুই ছিল এই ফতেহপুর সিক্রিতে ফিরে না যাওয়ার পিছনে প্রধান কারণ ।

১৫৮৫ সালের দিকে তার ছোট ভাই মির্জা হাকিম হঠাৎ করেই মারা যান। তার মৃত্যু শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই বীরবলের মৃত্যু সংবাদ পান সম্রাট। বীরবলের মৃত্যুতে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। এই ফতেহপুর সিক্রিতেই রয়েছে তার এবং বীরবলের নানা সুখকর, মধুর স্মৃতি। বীরবল শুধু তার বন্ধুই ছিলেন না, তাকে মানসিক শান্তি দেয়ার উৎসও ছিল। পণ্ডিত সি এম নাইম বলেছেন, প্রায়ই সম্রাটের কঠিন সময়ে বীরবলের গল্পগুলি তাকে প্রশান্তি এনে দিতো, তাকে এমন একজন মানুষে রূপান্তরিত করতো, যার ভিতরে সহজেই প্রবেশ করা যায়, যার মনে কি চলছে সহজেই অনুমান করা যায়। এই গল্পগুলোর সাথে বাস্তবের ঠিক কতটা মিল আছে জানা নেই, কিন্তু সম্রাট আকবর যে বীরবলের মজাদার এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা উপভোগ করতেন তাতে সন্দেহ নেই। যে সভায় বীরবলের গল্প হতো না, সেই সভা যেন অসম্পূর্ণই থেকে যেত। সম্রাট আকবর যতই নিজেকে নানা কাজে ব্যাস্ত রাখতেন, তবুও বীরবলের প্রাণবন্ত গল্প, হাসি ঠাট্টা তাকে সমস্ত কঠিন সময় থেকে মুক্তি দিতো। বীরবল তার জীবনের চাপগুলোকে মোকাবেলা করতে যে ভাবে সাহায্য করতো তা আর কারোও পক্ষে করা সম্ভব ছিলোনা।

বাদৌনি লিখেছিলেন, বীরবলের মৃত্যুতে সম্রাট ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন, অন্য কোন সভাসদদের মৃত্যুতে  তেমনটা কখনোই দেখা যায়নি। তার প্রিয় বন্ধুটির রক্তাক্ত, নিথর দেহটি পাথরের উপর অবহেলায়, অপবিত্র অবস্থায় পরে আছে এটি ভেবে আকবর সারাক্ষন কষ্ট পাচ্ছিলেন l তিনি ক্রমাগত বলেই চলেছিলেন যে, সেই পাহাড়ি অঞ্চল থেকে তার প্রিয় বন্ধুর দেহটি তারই নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল। এ অনুভূতি থেকে তিনি বারবার কাবুলের দিকে ছুটে যেতে চেয়েছেন প্রিয় বন্ধু বীরবলের লাশ খুঁজতে আর যারা বীরবলের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল তাদের শাস্তি দিতে। কিন্তু তার সভাসদরা তাকে যেতে দেননি। তারা সম্রাটকে শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, এমন একজন মহান বীরকে শুদ্ধ করতে সূর্যের আলোই যথেষ্ট। তিনি যেন শান্ত থাকেন l

সম্রাট আকবর আবুল ফজলকে বলেছিলেন, এমন একটি মৃত্যুর পর তার আনন্দের স্মৃতিগুলো যেন বিষাদময় হয়ে উঠেছে। এই মৃত্যু তার হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে ভেঙে দিয়েছে। তিনি যদি সেই প্রিয় বন্ধুর দেহটাকে নিজের চোখে দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি বোঝাতে পারতেন বীরবলের প্রতি ঠিক কতটা ভালোবাসা জমা ছিল তার ভিতরে। এদিকে বেশ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গুজব ছিল, বীরবল মারা যাননি, তাকে সাধু-সন্ন্যাসীর বেশে ঘুরতে দেখা গেছে, বা তিনি হয়তো ফিরে এসেছেন তার পুরোনো জায়গা নাগরকোটে। যতবারই এই ধরনের গুজব সম্রাট আকবরের দরবারে পৌঁছেছিল, ততবারই তিনি খোঁজ নিতে লোক পাঠিয়েছিলেন। মনে মনে আশা করে ছিলেন, সত্যি হয়তো তার প্রিয় বন্ধুটি বেঁচে আছে, সত্যি হয়তো একদিন তার কাছে ফিরে আসবেন। সম্রাট আকবর তার একটি চিঠিতে আব্দুর রহিমকে লিখেছিলেন, “পৃথিবীটা একটি মরীচিকা মাত্র। তৃষ্ণার্ত আত্মার প্রতি ধোঁকা … এই উন্মত্ততার শেষে কেবল একটি কুঁয়াশা ……একটি ধোঁয়া।”

রাজ্যের নানা জটিলতা, নানা যুদ্ধ-বিগ্রহ, অশান্তি থেকে সম্রাট আকবরকে দূরে রাখতো বীরবলের সেই মজার মজার কৌতুকগুলো। আমরা যেমন অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যাই, ঠিক তেমনভাবেই বীরবল, তানসেন, ফয়জীর মতো মানুষগুলো আকবরকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সাহায্য করতো। বীরবল মারা যাওয়ার পরেও সম্রাট আকবর বীরবলের জন্য অপেক্ষা করতেন। তারা একে ওপরের প্রতি মানসিকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। আকবর একজন সম্রাট হলেও, তিনিও একজন মানুষ। তারও মনে দুঃখ, কষ্ট ছিল। তারও মানসিক শান্তির প্রয়োজন হয়েছিল। তার ভিতরেও প্রিয় বন্ধু হারানোর কষ্ট ছিল। হয়তো সেই কষ্টগুলো রাজ্য শাসন, প্রজাদের সেবা, শত্রূ প্রতিরোধ ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যার কারণে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কষ্টগুলো ম্লান হয়ে যায়নি। তাই হয়তো বীরবলের স্মৃতি বিজড়িত সে ফতেহপুর সিক্রিতে তিনি আর ফিরে আসতে পারেননি। হয়তো সেই স্মৃতিগুলো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। প্রিয় বন্ধুকে হারানোর কষ্ট হয়তো তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি।

আবদুল ফজল লিখেছেন, “বীরবলের মৃত্যুতে সম্রাটের ভিতরে তছনছ হয়ে গেছে, সেই শহরের মনোরম প্রাসাদ তাঁর হৃদয়কে আর আকর্ষণ করেনি।” সম্ভবত ফতেহপুর সিক্রির প্রাসাদ এবং উঠানগুলি এমন এক বন্ধুর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় যার অনুপস্থিতি সম্রাটের হৃদয়কে অসুস্থ করে তুলেছিল। বীরবল একমাত্র হিন্দু ছিলেন, যিনি সম্রাটের প্রতি পুরোপুরি একনিষ্ঠভাবে নিবেদিত ছিলেন। আর তাইতো মৃত্যুর পরেও আকবরের হৃদয়ের অন্তস্থলে সবচেয়ে মূল্যবান জায়গাটি দখল করে ছিলেন তাই আকবর আর ফতেহপুর সিক্রিতে ফিরে আসেননি। ইবাদত খানার সেই দুর্দান্ত প্রাণবন্ত আলোচনা যেন চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

বীরবল, তানসেন, ফয়েজীর মতন ব্যাক্তিরা কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না, আকবরের মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্যেই একেকজন একেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছেন। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, এইসব ব্যাক্তিরা সম্রাটের মনোচিকিৎসক হিসেবে সম্রাটের পাশে থেকে তার জীবনের কঠিন দিকগুলোকে মোকাবেলা করতে সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং মোঘল সাম্রাজ্য গঠনের ক্ষেত্রে এদের অবদানও কোন অংশে কম নয়।

তথ্যসূত্র: Book- AKBAR THE GREAT MUGHAL By Ira Mukhoty