হারুন অর রশিদ এমন একজন দয়ালু খলিফা ছিলেন, যিনি কিনা রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশ নিয়ে প্রজাদের অবস্থা, তাদের দুঃখ- দূর্দশা দেখার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়তেন।তিনি শুধু একজন ধর্মীয় শাসকই ছিলেন না বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

পঞ্চম আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন হারুন অর রশিদ।তিনি ৭৮৬ সালে হাদির মৃত্যুর পর আব্বাসীয় বংশের ৫ম শাসক হিসেবে ২০ বছর বয়সে খিলাফতের মসনদে বসেন। ইসলামী স্বর্ণযুগের খলিফা ছিলেন তিনি।তার পদবী রশিদ কথাটার অর্থ ‘ন্যায়পরায়ণ’।তিনি ১৭০ হিজরীতে খেলাফতের দায়িত্ব পান আর ১৯৩ হিজরীতে ৪৫/৪৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার খিলাফতের সময়কাল ছিল ২৩ বছর, এবং তার খিলাফত কে আব্বাসীয় খিলাফতের স্বর্নযুগ বলা হয়।তার শাষনকাল ছিলো ৭৮৬ সাল থেকে ৮০৯ সাল পর্যন্ত, এর মধ্যবর্তী সময়টাকে স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে।

৭৬৩/৭৬৬ সালের ১৭ মার্চ আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনস্থ রাই অঞ্চলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আল মাহদী ও মায়ের নাম খাইজুরান। ছেলেবেলায় তার শিক্ষাগুরু ছিলেন ইয়াহিয়া বর্মাক।বড় হয়ে শিক্ষাগুরু ইয়াহিয়া বর্মাকের মতই তিনি একজন প্রতিভাবান মানুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হন।তার স্ত্রীর নাম ছিলো জুবাইদা ও তিন ছেলে— আমিন, মাপুন ও মুহতাসীম।

Image source: Google

হারুন অর রশীদ আব্বাসীয় খিলাফতের মসনদে আরোহণ করার কিছুদিনের মধ্যেই খারেজিরা বিদ্রোহ শুরু করে। আল ওয়ালিদ এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।এই বিদ্রাহ মসুল থেকে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানে ছড়িয়ে পড়ে। হারুন অর রশিদ আল ওয়ালিদকে দমন করেন কিন্তু উত্তরাধিকারী হিসেবে লায়লা নেতৃত্ব দেন এই বিদ্রোহের, তখন ইরাক পর্যন্ত এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তিনি খারেজিদের এই তীব্র আন্দোলন দমন করার জন্য কঠোর নীতি নেন। তিনি খারেজিদের পরাজিত করেন এবং লায়লাকে তার নিজ জীবনে ফিরে যেতে সুযোগ দেন। এতে খারেজি আন্দোলন দমন করা হয়।

বাইজানটাইনদের সঙ্গে আল মাহদীর সময় থেকেই আব্বাসীয়দের খারাপ সম্পর্ক ছিলো।তিনি বাইজানটাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফল হওয়ার কারনেই রশিদ উপাধি লাভ করেন। তিনি তার শাসনকালের শুরুর দিকে ৭৯১ সালে বাইজানটাইন সম্রাজ্ঞী আইরিনের সঙ্গে যুদ্ধে সফল হন।কিন্তু সেখানকার শাসন ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ার নতুন ক্ষমতাসীন নাইসেফোরাস আগের কর দেওয়ার চুক্তি অস্বীকার করেন এবং আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন। তাকে সমুচিত  জবাব দেওয়ার জন্য তিনি নাইসেফোরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন, এতে নাইসেফোরাস পরাজিত হন।৮০৮ সালে আবার বিদ্রোহ করলে আবারও তিনি তাকে পরাজিত করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এরকম চুক্তি ভঙ্গ শুধু দুবারই হয়নি বরং হারুন অর রশীদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এরকম ঘটনা ঘটেছে কিন্তু বারবারই তিনি জয় লাভ করে তাকে ক্ষমা করেছেন এবং তার বীরত্ব প্রমাণ করেছেন।

ঐতিহাসিকরা তার এই ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছেন। বারবার ক্ষমা না করে তিনি বরং রোমান সাম্রাজ্য দখল করতে পারতেন।ঐতিহাসিক আমীর আলী তার এমন মনোভাবে হতাশা প্রকাশ করেছেন।

তার শাসনামলে বাগদাদ জ্ঞান, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, ইসলামী শিল্প ও সঙ্গীতের যথেষ্ট প্রসার হয়। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাগদাদের বিখ্যাত গ্রন্থাগার ‘বাইতুল হিকমাহ’। বাইতুল হিকমাহ ছিল আব্বাসীয় আমলে ইরাকের বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত একটি গ্রন্থাগার, অনুবাদকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটিকে ইসলামি স্বর্ণযুগের একটি প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাইতুল হিকমাহ এ সময় তার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়। এসময় আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা বারমাকি পরিবারের ভূমিকা হ্রাস পেতে শুরু করে। ৭৯৬ সালে তিনি বর্তমান সিরিয়ার রাকা শহরে তার দরবার ও সরকারকে স্থানান্তর করেন। হারুনুর রশিদ বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী হওয়ায় তার জীবন ও দরবার নিয়ে বিভিন্নরকম গল্প লেখা হয়েছে। তবে এসবের মধ্যে কিছু বাস্তব তবে অধিকাংশই কাল্পনিক হিসেবে মনে করা হয়। বাস্তব ঘটনার মধ্যে একটি হলো শার্লেমাইনের কাছে ঘড়ি পাঠানোর ঘটনা। ৭৯৯ সালে হারুনুর রশিদের কাছে বন্ধুত্বের আহ্বান জানিয়ে পাঠানো ফ্রাঙ্কিশ দলকে বিদায়ী উপহার হিসেবে এটি দেয়া হয়েছিল। শার্লেমাইন ও তার লোকজন এই ঘড়ির শব্দ ও এর কান্ডকারখানার কারণে একে জাদুবস্তু ভেবেছিলেন।

হারুন অর রশিদের শাসনামলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো আফ্রিকায় বিদ্রোহ দমন।হারুন অর রশিদ মসনদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরই সেখানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহ দমন করার জন্য হারসামাকে পাঠান। হারসামার অসাধারণ রণনৈপুণ্যে সেখানে বিদ্রোহ দমন করেন এবং ইব্রাহিম ইবনে আগলাবকে সেখানকার শাসক হিসেবে নিয়োগ করেন।পরে সেখানে বংশানুক্রমিকভাবে আগলাবি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাতেরবেলা ছদ্মবেশে তিনি ঘুরে ঘুরে প্রজাদের অবস্থা দেখতেন।তার রাজ্যে কেউ অপরাধ করলে তিনি খতিয়ে দেখার পর যদি নিজের বা রাজ্য অব্যবস্থার দায় খুঁজে পেতেন তাহলে সেই অপরাধের সাজা মাথা পেতে নিতেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামের আইনে ন্যায়বিচার। রাজনীতিতেও তিনি রেখেছিলেন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা।

Image Source: Google

তাকে নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত গল্প হলো ক্ষুধার্ত মহিলাকে খাবার সরবরাহ করা ———-

একরাতে খলিফা বেরিয়েছেন রাজ্যের নাগরিকের সুখ-দুঃখের খোঁজ নিতেন। কিছু দূর যেতেই বাচ্চাদের কান্নার শব্দ শোনা গেলো, বেশ কিছুদুর বালুময় পথ পার হওয়ার পর কান্নার আওয়াজ আসা জায়গায় পৌঁছে দেখলেন এক মহিলা চুলায় কিছু রান্না করছেন আর তার পাশে দুই শিশু ক্ষুধায় খাবারের জন্য কাঁদছে, মহিলাটি বাচ্চাদের খাবার দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন কিন্তু খাবারের দেখা নাই। খলিফা ও তার সঙ্গী দুজনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন এই বাচ্চাগুলি কারা?এবং বাচ্চারা কাঁদছে কেন? মহিলা জানালেন, বাচ্চাদুটি তার সন্তান, তার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তিনি অনেক চেষ্টা করেও তাদের জন্য কোনো খাবার যোগাড় করতে পারেননি, তাই তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য পাতিলের মধ্যে পাথর দিয়ে নীচে আগুন জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছে কখন বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়বে। খলিফা খুব মর্মাহত হলেন এবং পাশের যুবককে তাদের খাবারের জন্য নিজ কাঁধে করে আটা এবং খেজুর নিয়ে আসার জন্য পাঠালেন। কিছুক্ষন পরে সেই যুবক নিজে খাবার বয়ে নিয়ে ফিরে এলেন…. তিনি ছিলেন খলিফা হারুন অর রশিদের পুত্র মুহতাসীম।

হারুন অর রশিদ ৮০৯ সালে তুস নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন।সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।তার ইচ্ছা অনুযায়ী পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনীত হন তার ছেলে আমিন। তার প্রশাসনিক দক্ষতার কারণেই আব্বাসীয় খিলাফতের শাসন দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ছিলো। আর এ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই তার পরবর্তীতে আব্বাসীয় খিলাফত দীর্ঘদিন শাসন ক্ষমতায় টিকে ছিল। হারুন অর রশিদের অন্যতম উত্তরাধিকারী আল মামুনের হাত ধরে তা আরও সুসংগঠিত হয়। এসব কৃতিত্বের দাবিদার অবশ্যই হারুন অর রশিদ, তার কারণেই আব্বাসীয় খিলাফত দীর্ঘ সময়, প্রায় পাঁচশ বছর শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ছিলো।