এলচে লেডি’ একটি বিখ্যাত নারী মূর্তি। মূর্তিটির বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি এবং রহস্যময় চেহারা – মানব মনে কৌতূহল সৃষ্টি করতে বাধ্য। এই আবক্ষ মূর্তি সম্পর্কে বিশদভাবে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি বলে আজ এটি এক রহস্যময় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। ১৮৯৭ সালে এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত এস্টেট থেকে চুনাপাথর দিয়ে সুক্ষ্মভাবে খোদাই করা এই মূর্তিটি আবিষ্কৃত হয় । খ্রীস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে ঐ সাইটটি স্পেন থেকে কয়েকমাইল দক্ষিণে অবস্থিত অ্যালুসিডিয়া নামক এক প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলে ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা ঐ অঞ্চলটি পিউনিক আইবেরিয়ানদের তৈরি।
আমরা জানি ফিনিশিয়ানরা ৮১৪ খ্রীস্টপূর্বাব্দে কার্থেজে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। আর কার্থেজের মানুষরা ফিনিশিয়ানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেবী ট্যানিটকে তাদের নিজেদের দেবী হিসেবে গ্রহণ করেন। ট্যানিট ছিলেন একজন কুমারী দেবী । তাকে যুদ্ধ ও উর্বরতার দেবী হিসেবেও পূজা করা হতো। ধারণা করা হয় এই লেডি এলচেই ছিল ‘দেবী ট্যানিট’। তবে লেডি এলচে কিন্তু আমাদের আজকের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু নয়। বরং এই মুহুর্তে আমরা চলে যাবো ভারতের চন্দ্রকেতুগড়ে। আমাদের আজকের উদ্দেশ্য হচ্ছে চন্দ্রকেতুগড়ের কিছু প্রত্নসামগ্রী নিয়ে গল্প করা।
আর এই চন্দ্রকেতুগড় ও গঙ্গারিডির ইতিহাস তো আমাদের মোটামুটি জানা। কলকাতা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে উত্তর পূর্বের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। মনে করা হয় গঙ্গারিডির অংশ হচ্ছে চন্দ্রকেতুগড় । এই গঙ্গারিডির সাথে জড়িত রয়েছে ম্যাসিডোনিয়ান রাজার ভারত অভিজানের গল্প। প্রাচীন গ্রীক, রোমান লেখকেরা গঙ্গারিডি এবং আলেকজান্ডারের সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ লিখে রেখেছেন। তাদের লেখায় বিপাসা নদীর পূর্ব দিকের দুটি শক্তিশালী রাজ্যের কথা উঠে আসে। একটি প্রাচ্য বা প্রাচী, অন্যটি গঙ্গারিডি। শুধু রোমান বা গ্রীক লেখনিতেই না চীনা সাহিত্যেও আমরা এই গঙ্গারিডি নাম খুঁজে পাই। আরও কিছু লেখকের নাম এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। মেগাস্থিনিস, ডিওডোরাস, স্ট্র্যাবো, প্লুটার্ক, টলেমি, প্লিনি, ক্লটিয়াস, সলিনস প্রমুখ গ্রিক ও রোমান লেখকেরা শক্তিশালী এই ‘গঙ্গারিডির’ বর্ননাও দিয়েছেন। এই গঙ্গেয় বন্দর বা গঙ্গারিডি সম্পর্কে তাদের বর্ননা গুলো প্রায় অভিন্ন। আর বিশাল গঙ্গারিডি রাজ্যেই বিভিন্ন বন্দর গুলোর মধ্যে একটি বন্দর ছিলো হয়ত এই চন্দ্রকেতুগড়। রোমানদের সাথে ভারতীয়দের বাণিজ্যের যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে। আর সাতবাহনের রাজত্বকালে অত্যন্ত শক্তিশালী রূপ নিয়েছিল এই বাণিজ্য। সড়ক এবং সমুদ্র উভয় পথেই এই বাণিজ্য চলতো। আর চন্দ্রকেতু থেকে পাওয়া প্রত্নবস্তু অ্যামফোরা, মৃৎপাত্রের ভাঙা অংশ, ছাপাঙ্কিত নকশাযুক্ত মনোরম লোহিত মৃন্ময়, ধূসর মৃত পাত্র, অ্যাম্বারের অলঙ্কার ও পুঁতি, পোড়ামাটির মূর্তি ইত্যাদি দেখে বাংলার সাথে রোমান বাণিজ্যের অত্যন্ত শক্তিশালী যোগসূত্র ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
এখন ফিরে আসি এক যাদুঘরে। গিমিট জাদুঘর। সেখানে ভারতীয় দক্ষ কারুশিল্পীর হাতে তৈরি একটি ছোট হালকা আগুন কমলা রঙের পোড়ামাটির ফলকে একটি নারী মূর্তির অবয়ব খোদাই করা রয়েছে। তার পোশাক, গয়নার নকশা, শরীরের খাঁজ, সমস্ত কিছুই খুব নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় নকশার স্পষ্ট প্রমাণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেই প্রত্নবস্তুটিতে। মনে করা হচ্ছে তিনি একজন ভারতীয় দেবী। ঐ দিকে এই প্রত্নবস্তুটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময় প্রত্নতাত্ত্বিকদের মনে প্রশ্ন জাগে যে এই লেডি অফ এলচের আবক্ষ মূর্তিটির সাথে চন্দ্রকেতুগড়ের মূর্তির কি কোনও সাদৃশ্য রয়েছে?
মনে তো হচ্ছে তাই । প্রথমত বোঝাই যাচ্ছে দুজনেই দেবী। এ ছাড়া এদের দুজনেরই মাথার পাশে বিরাট চাকার আকৃতিতে তৈরি অলঙ্কার রয়েছে। মাথায় রয়েছে হেডব্যান্ড। দুজনেরই কানের মধ্যে বিশাল আকারের ঝুলন্ত গয়না দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গলায় তাদের অসাধারণ সুন্দর নেকলেস। এদের মাথায় রয়েছে কাঁটার মতো অস্ত্র। হ্যা, দুই মূর্তির মধ্যে সাজের এই মিল চমকপ্রদই বটে। এমন মিল পাবার কারণ কি হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ না। এমন কি হতে পারে, চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া এই মাটির মূর্তিটি বিদেশি কোন দেবীর মূর্তির অনুকরণে তৈরি হয়েছিল। সত্যিই তো পোড়ামাটির তৈরি নারী মূর্তি গুলোর পোশাক, শারীরিক বৈশিষ্ট্য গুলোতে খ্রিষ্টীয় ৩য় শতাব্দীর গ্রীক ও রোমান মূর্তিগুলোর মধ্যকার সাদৃশ্য রয়েছে । এই মিল দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক যোগাযোগের প্রত্যক্ষ প্রমাণ বহন করে কি? এর উত্তরে বলা যেতে পারে সাত সমুদ্র তের নদী পারি দিয়ে রোমান বা গ্রিক বণিকেরা যখন এই উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে আসতো হয়তো তখন তারা সাথে নিয়ে আসতো তাদের দেব দেবীর মূর্তি।
আর ঐ মূর্তি গুলোকে দেখেই হয়তো ভারতীয় কারুশিল্পীরা এলচের গয়নার ডিজাইন পরিয়ে চন্দ্রকেতুগড়ের এই মূর্তি গুলোকে তৈরি করেছিল। এমনও হতে পারে রোমান বা গ্রীক বণিকেরা মূর্তিগুলোকে এলচের মূর্তির কাছাকাছি করে তৈরি করিয়েছিল। এই কারণেই দুই মূর্তির সাজসজ্জার মধ্যে এতো মিল আমরা খুঁজে পাচ্ছি।
তবে এখানে একটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রোমান বা গ্রিক লেখকদের লেখনীতে প্রাচীন ভারতের সাথে এই রোমানদের বাণিজ্যের সম্পর্কে বলতে গিয়ে চন্দ্রকেতুগড় এই নামটি একবারও উচ্চারিত হয়নি কেনো? কাবেরিপট্টাম, মুজরিজ এই নাম গুলোতো বেশ কয়েকবারই উচ্চারিত হয়েছে। এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটু ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হলো। আমরা দেখেছি কাবেরিপট্টাম বা মজুরিজের বিভিন্ন অঞ্চলে চন্দ্রকেতুগড়ের বহু প্রত্ন সামগ্রী পাওয়া গিয়েছিল। এই থেকে গবেষকেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে চন্দ্রকেতুগড়ের বন্দরের সাথে রোমানদের সরাসরি কোন যোগাযোগ না থাকলেও চন্দ্রকেতুগড়ের সাথে ভারতীয় ঐ বন্দর গুলোর মধ্যে গভীর যোগাযোগ ছিল। চন্দ্রকেতুগড় থেকে দক্ষিণ ভারতে নৌপথ বা সড়কপথে পণ্য পৌঁছানোর পর সেখান থেকে সে গুলো রোমের উদ্দেশ্য রওনা দিত। সুতরাং কোন না কোনভাবে উপমহাদেশের এ অঞ্চলের সাথে রোমানদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল।
রেফারেন্স:
Spain’s Lady of Elche Reveals New Links with Indian Goddess