জহির রায়হান ছিলেন— ঔপন্যাসিক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা, বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত পরিচালক, চিত্রগ্রাহক এবং প্রযোজক।

১৯৬০ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ প্রকাশিত হয়। তার অন্য উপন্যাসগুলি ‘বরফ গলা নদী’ ‘হাজার বছর ধরে’ ও আরেক ফাল্গুন। ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। এ উপন্যাসে গ্রামের প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রাকে তিনি সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। শহুরে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনী তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন ‘বরফ গলা নদীর’ তে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি রচনা করেন ‘আরেক ফাল্গুন’ এবং ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামের দুটি উপন্যাস।

সাধারণ মানুষের কাছে জহির রায়হান লেখকের চেয়ে চলচ্চিত্রকার হিসেবেই বেশি পরিচিত। তার ‘আর কতদিন’ উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ শেষ হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তখন তিনি ভারতে চলে যান। সেখানে তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গনহত্যা নিয়ে তৈরী করেন প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘বার্থ অব আ নেশন’। সেখানে তার তত্ত্বাবধানে বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’ এবং আলমগীর কবীরের ‘লিবারেশন ফাইটারস’ নামে প্রামাণ্যচিত্র দু’টিও তৈরি হয়।

কখন আসেনি সিনেমার সেটে জহির রায়হান (১৯৬১)

জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ শে আগষ্ট ফেনী জেলার সেনাগাজি উপজেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বাবা কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার কাজ করতেন তাই সে সময় তারা কলকাতায় ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তারা সবাই ঢাকায় ফিরে আসেন।  ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেক বাংলায় স্নাতক করেন। এরপর তার তার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬১ সালে তিনি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ১৯৬৮ সালে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুচন্দাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।

হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য ১৯৬৪ সালে তাকে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়। বাংলা সাহিত্যের গল্প শাখায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পান। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে মরণোত্তর সম্মামনা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে তাকে মরণোত্তর ‘বিশেষ পুরস্কার’ দেয়া হয়।হয়।

চলচ্চিত্র পুরস্কার হাতে জহির রায়হান

জহির রায়হান ১৯৫২ সালে ফটোগ্রাফি শিখতে কলকাতা যান, এজন্য তিনি প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৫৭ সালে জাগো হুয়া সাভেরা ছায়াছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন, ছবিতে তিনি সহকারী হিসেবে কাজ করেন।তিনি সালাউদ্দীনের ছবি ‘যে নদী মরুপথে’ ছবিতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

১৯৬১ সালে তার প্রথম ছবি “কখনো আসেনি” মুক্তি পায়। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি “সঙ্গম” তৈরী করেন, ছবিটি উর্দু ভাষার এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি “বাহানা” মুক্তি পায়। ১৯৬৪ সালে “কাঁচের দেয়াল” ছবির জন্য তিনি নিগার পুরস্কার পান। তার নির্মিত ছবিগুলি —- বেহুলা, সঙ্গম, আনোয়ারা ও জীবন থেকে নেয়া।

প্রথম স্ত্রী সুমিতা দেবী ও ছেলের সাথে জহির রায়হান

তিনি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নামে একটি ইংরেজি ছবির কাজ শুরু করেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তা শেষ করতে পারেন নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় চলে যান, এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। সেখান থেকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যার চিত্র সম্বলিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণ করেন। ছবিটি পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৭১ সালে এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম প্রামান্যচিত্র। অনেকে ‘স্টপ জেনোসাইড’–এ ব্যাবহার করা টেকনিককে আলভারেজ নির্মিত ‘হাস্তা লা ভিক্টোরিয়া সিয়েম্প্রে’–এর (১৯৬৭) সঙ্গে তুলনা করেন।

প্রতিটি বাক্যের শেষে টেলিগ্রাফের মতো ‘স্টপ’ বলা যেন আইয়ুব শাহিসহ আর দুনিয়ার তামাম শোষক, গণহত্যাকারীকে সাবধান করে দেওয়া, থামো; নয়তো পরিণতি ভালো হবে না। এই ছবিটি নির্মাণের সময় মৃণাল সেনও তাকে সহায়তা করেন। সে সময় কলকাতায় “জীবন থেকে নেওয়া”র কয়েকটি প্রদর্শনী হয়।সামাজিক এই ছবিটিতে তিনি তৎকালীন বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন।

একটি দেশ

একটি সংসার

একটি চাবির গোছা

একটি আন্দোলন

একটি চলচ্চিত্র

জহির রায়হানের সর্বাধিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ এর পোস্টার

এই ছবিটি সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, তপন সিনহা, ঋত্বিক কুমার ঘটকের প্রসাংসা কুড়ায়।সেইসব প্রদর্শনী থেকে উপার্জিত সমস্ত টাকা তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা ফিরে আসেন এবং তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ্ কায়সারের খোঁজ শুরু করেন। ঠিক দেশ স্বাধীনের আগে আগে শহীদউল্লাহ্ কায়সারকে পাকিস্তানি আর্মির দোসর আল বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়।১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি খবর পান যে, শহীদুল্লা কায়সারকে ঢাকার মিরপুরে রাখা হয়েছে। তিনি তাঁকে উদ্ধারের জন্য সেখানে যান, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। ঐ দিনটি জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া,  উইকিপিডিয়া