শেষ অক্টোবরের এক বিকেলবেলায় হালকা শীতের আমেজ গায়ে মেখে হাঁটছি চিলা ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে। ঋষিকেশে। আমি, রুস্তম আর ইগর। রুস্তম পার্সি ছেলে, ঋষিকেশে জোস্টেল চালায়। আমার পূর্বপরিচিত। আর ইগর রাশিয়া থেকে এসেছে যোগা শিখবে বলে। রুস্তমের জোস্টেলে উঠেছে সে। ইগর ওর দেশের স্পোর্টস হিস্টোরিয়ান, স্পেশালাইজেশন দাবার ওপরে! তাই হাঁটতে হাঁটতে আমরা দাবা নিয়েই কথা বলছিলাম।
ইগর বললো: “দাবার উৎপত্তি তো ভারতে। সম্ভবতঃ গুপ্তযুগে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য থেকে ভাইকিংদের মাধ্যমে ভোলগা-কাস্পিয়ান বাণিজ্যপথ ধরে তা রাশিয়ায় প্রবেশ করে। সে যুগ অর্থাৎ মোটামুটি 1000 খ্রিস্টাব্দ থেকেই রাশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা দাবা। 1584 সালে রুশ জার ‘ইভান IV দ্য টেরিবল’ নাকি দাবা খেলতে খেলতেই মারা গিয়েছিলেন। ভাবা যায়!”
“কিন্তু ভারত থেকে বাইজেন্টাইনেই বা দাবা পৌঁছলো কিভাবে?” — আমি জিজ্ঞেস করি।
“সে তো অনেক পরের কথা। পারস্য থেকে ইউরোপের দিকে দাবার জয়যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমি একাদশ শতকে লেখা ফেরদৌসির শাহনামার একটা গল্প না বলে পারছি না। সত্য মিথ্যা জানি না, তবে এ গল্পে ভারত থেকে পারস্যে দাবার প্রসার সম্পর্কে খানিকটা আভাস পাওয়া যায়।“ — রুস্তম বলে ওঠে।
তারপর আমাদের সম্মতির অপেক্ষায় না থেকেই শুরু করে সে:
“হিন্দের কোনো এক রাজ্যের রাজদূত পারস্যরাজ খসরুর (531—579 A.D.) দরবারে বহু উপঢৌকন সহ হাজির হন। সেই বহুমূল্য উপহার রাজির মধ্যে একটি ছক কাটা কাঠের বোর্ড এবং অনেকগুলি হাতির দাঁতের তৈরি মূর্তির মতো দেখতে ঘুঁটিও ছিল। রাজদূত ঘুঁটিগুলি সাজিয়ে খেলার নিয়ম শেখাবার পর বললেন, হে মহান পারস্য অধিপতি, আপনার সভার গুণীজনদের আহ্বান করে এ রহস্যময় খেলায় আমাকে পরাজিত করতে বলুন। তাঁরা সফল হলে ভারত সম্রাট তাঁদের পান্ডিত্যকে স্বীকার করে নেবেন, আর বিফল হলে পারসিকদের বিদ্যাচর্চার ঘাটতি প্রমাণিত হবে।
পুরো একদিন ও রাত চিন্তা করার পর দার্শনিক ও ঐতিহাসিক Bozorgmehr এই রহস্যময় খেলায় জয়লাভ করে সাসানীয় রাজদরবার থেকে প্রচুর পারিতোষিক লাভ করেন। কিন্তু ব্রিটিশ ঐতিহাসিক Edward Laskar বলেন, Bozorgmehr ভারতীয় দূতকে ঘুষ দিয়ে ওই খেলায় জিতেছিলেন।“
ইগর গল্প শুনে ভারী খুশি হয়। সে বলে, “ঐসময়েই “পঞ্চতন্ত্র” ‘klileh va Demneh’ নাম অনূদিত হয়ে ভারত থেকে পারস্যে যায়। এই বইতে গল্পচ্ছলে দাবা খেলার নিয়ম কানুন-এর বিবরণ আসে।। কিন্তু পারসিক ভাষায় চ এবং গ এর সঠিক উচ্চারণ না থাকায় অপভ্রংশ হয়ে শব্দটি শতরঞ্জ নামে পরিচিতি পায়।“
আমি ইগরের কথায় সায় দিয়ে বলি: “’চতুরঙ্গ’ শব্দটির সাথে যুদ্ধক্ষেত্রের একটা যোগ আছে। প্রাচীন ভারতীয় সেনায় অশ্বারোহী, হস্তিবাহিনী, রথারোহী ও পদাতিক সেনা মিলে চতুরঙ্গ বাহিনী তৈরি হতো। ষষ্ঠ শতাব্দী বা তারও আগে উত্তর-পশ্চিম ভারতে চতুরঙ্গ নামে খেলার প্রবর্তন হয়। প্রধানতঃ যুদ্ধের ব্যূহ রচনার কৌশল হিসেবে এই খেলার উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। শূন্য আবিষ্কারের পরে গাণিতিক সমস্যা সমাধানেও যে চতুরঙ্গ ব্যবহার হতো তা সে যুগের আরবীয় লেখক আবু আল হাসান আলী আল মাসুদিও বলে গেছেন। তাঁর কথায়, ভারতীয়রা চতুরঙ্গ খেলতো যুদ্ধের রণকৌশল, গণিত, জুয়া এমনকি মহাকাশবিদ্যার উন্নতির জন্য। প্রথমদিকে চতুরঙ্গ খেলা হতো তিনভাবে, তিনরকম বোর্ডে। দশপদ বা 10×10 ঘরকাটা বোর্ড, শতুরংকম বা 9×9 বোর্ড এবং অষ্টপদ বা 8×8 বোর্ড। পরে অষ্টপদ বোর্ডেই কেবলমাত্র খেলা হতে থাকে।“
রুস্তম বলে ওঠে, ইতিহাস যাই বলুক শাহনামার আরেকটি গল্পও আমার খুব প্রিয়, যেটা থেকে জানা যায় খেলাটির উদ্ভব কিভাবে হলো।
আমি আর ইগর দুজনেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রুস্তমের দিকে তাকাই। ইঙ্গিত পেয়ে রুস্তম শুরু করে:
“তালহান্দ্ ও গাভ নামে দুই সৎ ভাই হিন্দের সিংহাসন দখল করার জন্য যুদ্ধে রত হয়। যুদ্ধ চলাকালীন তালহান্দ আহত না হওয়া সত্ত্বেও হাতির পিঠে বসেই মারা যায়। গাভ খুবই বিব্রত হয়ে পড়ে। সে তার সৎমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে যে, সে বা তার সেনারা তালহান্দকে মারেনি, তালহান্দ্ কিভাবে মারা গেল তা গাভও বুঝতে পারছে না। সৎমা তার কথা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করেন না। তখন গাভ তার পার্ষদদের সাথে আলোচনা করে কিছু মূর্তি তৈরি করে তার বাহিনী কিভাবে ব্যূহ রচনা করে যুদ্ধ করেছিল, কিভাবে তালহান্দ্ পরাজিত হলো ইত্যাদি “চতুরঙ্গের” মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করে। প্রমাণিত হয়, তালহান্দ্ আহত হয়ে নয়, বরং অতিরিক্ত ক্লান্তিতেই মারা গেছে। আবিষ্কার হয় চতুরঙ্গ কৌশল।“
“বেশ মজাদার গল্প তো! কিন্তু ইগর, চতুরঙ্গ থেকে শতরঞ্জ হয়ে পুরো পৃথিবী জুড়ে দাবার এই মাইগ্রেশনটা ঠিক কিভাবে হলো তুমি যদি একটু সংক্ষেপে বলো তো ভালো হয়।“ — আমি মন্তব্য করি।
ইগর ডানদিকের জঙ্গলে গাছের ডালে একটা ময়ূরের দিকে তন্ময় হয়ে চেয়ে ছিল। আমার ডাকে চমক ভাঙে তার। সে বলতে শুরু করে:
“চতুরঙ্গের Chess এ পরিণত হবার অভিযান মূলতঃ সিল্ক রুট ধরে হয়েছে, পূর্ব পশ্চিম দুদিকেই। সাসানীয় বংশের শাসনকালে চতুরঙ্গ পারস্যে গিয়ে শতরঞ্জ হলো। তারপর পারস্যে মুসলিম আক্রমণের সময় (633—644 A.D.) মুসলিম শাসকদের হাত ধরে শতরঞ্জ নবম শতকের মধ্যেই উত্তর আফ্রিকা ও সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেন উম্মায়েদ শাসনের সময় ইউরোপে দাবার gateway হয়ে দাঁড়ায়। মোটামুটি একই সময় ভারত থেকে চীন হয়ে কোরিয়া, জাপান—সমগ্র পূর্ব এশিয়াতে জনপ্রিয় খেলা হিসাবে দাবা পরিচিতি পেতে থাকে। এই সময় কিন্তু একটা বড় পরিবর্তনও হয়। আগে চতুরঙ্গতে ঘুঁটিগুলো মূর্তি আকারে নির্মিত হতো, যেমন- রাজা, মন্ত্রী, হাতি, ঘোড়া, সৈন্য ইত্যাদি। কিন্তু মুসলিম শাসকদের হাতে পড়ে তা বিমূর্ত ঘুঁটিতে পরিণত হয়। আবার পার্সিরা রাজাকে শাহ বলতো। তো সেই শাহ থেকে বিবর্তিত হয়ে Chess এবং Check শব্দদুটি এসেছে, একইভাবে দাবাখেলায় হারিয়ে দেয়াকে পার্সিতে ‘শাহ মাৎ’ বলা হতো যার অপভ্রংশ চেকমেট।“
“বাঃ দারুণ ব্যাপার তো!” রুস্তম বলে ওঠে।
ইগর বলতে থাকে: “প্রাচীন আফরাসিয়াব এ যা বর্তমানে উজবেকিস্তানের সমরখন্দ – ওখানে 760 A.D. বা তারও আগের হাতির দাঁতের তৈরি দাবার ঘুঁটি পাওয়া গেছে। প্রাচীনতম দাবার বই বলতে 840—850 সালে লেখা আল- আদলি আর-রুমির লেখা ‘কিতাব আশ শতরঞ্জ’। আর ইউরোপের কথা বললে বলতে হয়, রেনেসাঁ যুগে chess was a part of noble culture। 15th century কে তো বলাই হয় Romantic Chess era। মোটামুটি 1475 সাল নাগাদ chess আজকের রূপ ধরে।
ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপ জুড়ে দাবা এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, লন্ডনের এসেক্সে একটা খেলাকে ঘিরে দু-দল সমর্থকের মধ্যে মারামারি এমনকি খুন খারাপিও হয়। আবার ফরাসি সম্রাট নবম লুই দাবায় জুয়া খেলার যোগে অতিষ্ঠ হয়ে 1254 সালে ফ্রান্সে দাবা নিষিদ্ধ করে দেন, যা নিয়ে জনতার অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ড ও স্পেনের একাধিক রাজা দাবা পাগল ছিলেন। এমনকি দশম শতকে ল্যাটিন ভাষায় দাবাকে নিয়ে “de scachis” আর ত্রয়োদশ শতকে “Libro de los juegos” নামে কবিতাও লেখা হয়।
চীনের দাবার নাম Xiangqi, যার বৈশিষ্ট্য ছিল, ঘুঁটিগুলি দাগের মাঝে মাঝে রেখে খেলা হতো এবং দু লাইন ঘুঁটির মাঝে নদী ইত্যাদি রাখা থাকতো।“
শুনতে শুনতে আমি গল্পে মশগুল হয়ে যাচ্ছিলাম। “সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এবার আমাদের একটু পা চালিয়ে ফিরতে হবে। চিলার জঙ্গলে হাতির খুব উপদ্রব।“ রুস্তম আমার হাতে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে মন্তব্য করে। কিন্তু আমাকে যেন দাবায় পেয়ে বসেছিল।
“আচ্ছা ইগর রুশ ভাষায় তোমরা chess কে কি বলো?” আমার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলে ইগর। বলে, শুধু রুশ ভাষায় নয়, চাইলে পৃথিবীর বহু ভাষায় chess এর নাম আমি বলে যেতে পারি গড়গড় করে, শুনবে?
রুস্তম বিরক্ত হয়। অন্ধকার নির্জন জঙ্গলে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ বোধ করে না সে। কুয়াশাও ঘন হচ্ছে ধীরে ধীরে। পা চালানোর জন্য আবার তাড়া লাগায় রুস্তম। এ জঙ্গলকে নিজের হাতের তালুর মতো চেনে সে। কিন্তু আমার তখন রোখ চেপে গেছে। শুনবই। দেখি ইগর কতগুলি ভাষায় দাবার নাম জানে।
ইগর বলে চলে: “রাশিয়ানে শাখমাতে।
স্প্যানিশ ভাষায় আজেদ্রেজ।
পর্তুগিজে সাদ্রেজ।
কোরিয়ার লোকেরা বলে জাংগী।
জাপানে শোগী…….”
“হাতি!” অন্ধকারে রুস্তমের চাপা গলা পাই।
মানে? কোথায়?
“বাঁদিকে, একটু দূরে। চুপ!”
মাথায় থাক দাবা! বাবার দেওয়া প্রাণটা নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি! তিনজনে সন্তর্পনে জায়গাটা ছেড়ে এগিয়ে যাই। পেছনে পড়ে থাকে কুয়াশা মাখা আদিম জঙ্গল, দাবার প্রতি অফুরান ভালোলাগা আর ভারতীয় হিসেবে এক প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ!
তথ্যসূত্র:
The History of Chess: From the Time of the Early Invention of the Game in India Till the Period of Its Establishment in Western and Central Europe by Forbes, Duncan
Chess, The History of a Game by Eales, Richard.