অনেক অনেক দিন আগের কথা।বার্ণি ডাফি নামে একজন লোক ছিল। তার আকৃতি ছিল বিরাটাকার ।অন্য দুজন সৈনিকের পাশে তাকে সুউচ্চ টাওয়ারের মত মনে হচ্ছিল। সৈনিক দুজন তাকে বন্দী করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। বন্দী অবস্থায় লোকটি অসহায়ভাবে তাদের কেবলই অভিশাপ দিয়ে চলেছে। তার অভিশাপের ভাষাও বড় বিচিত্র-সে ক্রমাগত বলে চলেছেঃ ওরে ছোট আত্মার উকুনেরা তোরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিস, আমার সম্বন্ধে তোরা যাই বলিসনা কেন, ওরা আমাকে ঠিকই ফাঁসীর দড়িতে ঝুলিয়ে দেবে-কিন্তু আমার কথা শোন, আমায় তোরা ছেড়ে দে, নইলে আমি এমন অভিশাপ তোদের দেব যে জন্যে তোদের চিরদিন অনুতাপ করতে হবে-।ছাড়বি নাতো ? তবে শোন আমি তোদের অভিশাপ দিচ্ছি-তোরা আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া মাত্র অন্যান্যের মত কিংস্টাউনের ফাঁসিকাষ্ঠে আমাকেও তারা ঝুলিয়ে দেবে। সাতদিন পর্যন্ত তারা মৃত দেহ ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেবে। আমার যদি সত্যিই এই পরিণতি হয় তবে তোরাও কিন্তু রেহাই পাবিনা। আমি অভিশাপ দিচ্ছি তোদের ঠিক এই পরিণতিই হবে…।
অষ্ট্রেলিয়ার অন্তর্গত সিডনী বন্দরের নয়শত মাইল উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ছিল নরফোক দ্বীপটি । ডাফি নামে একজন আইরিশ লোককে ইংরেজরা ধরে এনে বন্দী করে সেই দ্বীপে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দ্বীপটি সত্যিই ছিল অপূর্ব। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এর যতই মনোরম হোকনা কেন এর অতীত ইতিহাস বলে বহু নিরাপরাধ লোকের রক্তে রঞ্জিত এর মাটি।
নরফোকের বর্তমান অধিবাসীদের অনেকেই দাবী করে থাকেন যে তারা প্রায় ভূতের সাক্ষাত পান। পিটকেইরন দ্বীপে স্থান সঙ্কুলান না হওয়াতে উনিশ শতকে বহু লোক নরফোকে গিয়ে বসতি স্থাপন শুরু করেন। এরা বলেন যে আইরিশ বিপ্লবীদের বন্দী করে সুদূর অষ্ট্রেলিয়ায় পাঠান হত। বটানী উপসাগর দিয়ে নৌপথে এইসব বিপ্লবীদের নরফোকে নিয়ে গিয়ে ইংরেজ ই সরকার নির্মমভাবে তাদের ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দিতেন। যেসব ভূতের সাক্ষাত তারা পান এরা সেই আইরিশ বিপ্লবীদের প্রেতাত্মা। এইসব অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জীবন ছিল ভয়াবহ যন্ত্রণাময়। কেউ গান গাইবে কিংবা কারোর কাছে সামান্য পরিমাণ তামাক পাওয়া গেলে তার শাস্তি ছিল পঞ্চাশ ঘা বেত্রাঘাত। কাঁটা চামচের ব্যবহার তাদের জন্য নিষিন্ধ ছিল। হাত দিয়েই তাদের খাওয়ার পর্ব সারতে হতো। পানি পানের জন্য কোন গ্লাস ব্যাবহারের তাদের কোনরূপ অনুমতি ছিলনা। জন্তুর মত বালতি থেকেই তাদের পানি পান করতে হত। প্রভু বা রাজকর্মচারীদের অত্যাচারে তাদের জীবন ছিল দুঃখ ও হতাশায় ভরপুর। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্তরা এই দুর্বিষহ যন্ত্রণার হাত থেকে একদা রেহাই পাবে বলে আশায় থাকতো। তারা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতো মৃত্যুরূপ মুক্তি এসে তাদের সব যন্ত্রনা হয়তবা মুছে দেবে বলে। বন্দীরা প্রার্থনা করতো ঈশ্বর-আমরা মুক্তি চাইনা-মৃত্যু দাও-আমাদের মৃত্যু দাও, তবেই আমাদের সকল জ্বালার অবসান ঘটবে। এই বন্দীদশার নরকযন্ত্রণা থেকে বাঁচার আশায় ডাফি একদিন পালিয়ে গেলেন। তিনি রেইন গাছের গভীর অরণ্যে আত্মগোপন করে থাকলেন। পাইন গাছের গুঁড়ির গর্তে তার রাত কাটতো। মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে নতুন বসতকারীদের শব্জিবাগান শাকশব্জি ফল মূল চুরি করে জীবন ধারন করতেন। চুল দাড়ি তার বাড়তে বাড়তে বেশ লম্বা হয়ে উঠলো ।অজত্নে তাতে অচিরেই জট পাকিয়ে গেল। শতচ্ছিন্ন কয়েকটুকরো কাপড় তার দেহে ঝুলত আর তাতেই যেন তার লজ্জা নিবারন হত। দুইজন সৈনিক একবার ঐ বনের এক জলাশয়ে মাছ ধরতে যায়। সেখানে গিয়ে তারা বার্ণির খোঁজ পায়।
তারা পলায়ন পর বার্নি ডাফিকে বন্দি করে নিয়ে আসে।তাকে নিয়ে আসবার সময় সে উপরে উল্লেখিত অভিশাপগুলো দিতে থাকে আর আপ্রান চেষ্টা করে পালিয়ে যেতে। কিন্তু অনাহার , অর্দ্ধাহার অনিদ্রায় দুর্বল ডাফি সৈনিক দুজনের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে কেন ? তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল।
ডাফির অভিশাপকে উপেক্ষা করে সৈনিক দুজন তাকে আবার বন্দীখানায় নিয়ে গিয়ে কয়েদ করলো। বন্দুকের ভয়ে ডাফির পালান আর হলনা। ফাঁসীর দড়িতে তাকে প্রাণ দিতেই হলো। ডাফির আর্তক্রন্দন আজো যেন নরফোকের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধবনিত হচ্ছে।
ডাফির প্রাণদণ্ডের দুই দিন পর সেই সৈনিক দুজন ডাফির পরিত্যক্ত আবাস্থল সেই পাইন গাছের ফোকরের কাছে আবার মাছ ধরতে যায়। কয়েকদিন পর একজন পাহারাদার তাদের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ নিকটবর্তী জলাশয়ের কাছে ভাসমান আবস্থায় আবিষ্কার করে।
আজও নরফোক দ্বীপের মানচিত্রে বার্নি ডাফি উপসাগর তার নামের স্বাক্ষর বহন করছে। এখান থেকেই বার্নির অভিশাপকে উপেক্ষা করে সৈনিক দুজন বার্নিকে ধরে নিয়ে যায় এবং এখানেই দুজনে জীবন দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যাবার ফলস্বরূপ প্রায়শ্চিত্ত করে। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস !
Images Collected From Google