সত্যিকারের সৃজনমূলক অথবা গঠনমূলক কাজ করে মানুষ অর্জন করে যে খ্যাতি, তা হেঁটে যায় চিরকালের দিকে। সম্রাট শাহজাহান তাইই ছিলেন-স্বপ্নের তাজমহলের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তাঁকে দিয়েছিল চিরকালের খ্যাতি। সোজা টানের সরল একটি রেখাকে শিল্প বলে মানতে চাইবেন না, অনেকেই। কিন্তু রেখাটা বেঁকে গোল বা নানা ছাঁদের ত্রিভুজ হয়ে উঠলেই আমরা বলে উঠবো-বা!

নওলক্ষ মণ্ডপে পশ্চিমদিকের দেয়ালে মাখসুরাহ- পাথরের জালির খিলান পর্দা যা সম্রাট শাহজাহানের ঝরোখা দর্শনের জন্য ব্যবহৃত হত

সম্রাট শাহজাহান স্থাপত্যকে কোন দিনই সোজা টানের সরলরেখা ভাবেন-নি, তাই তাঁর স্থাপত্যিক নান্দনিকতায় বঙ্কিম রেখার চঞ্চল ও গতিময় শিল্প মুঘল স্থাপত্যে প্রকাশ পেয়েছিল। সম্রাট ছিলেন রক্তে-মাংসে ও হাড়ে মজ্জায় একজন শিল্প-প্রেমিক। শিল্প স্থাপত্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সুররিয়ালিজমের মতো স্বপ্ন-স্মৃতি ঝংকৃত স্বতন্ত্র পৃথিবী। তাঁর শিল্পচর্চা ছিল-শিলাবৃষ্টি অথবা ইলশেগুঁড়ির মতো এক আকস্মিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত বর্ষণ-যেখানে ইমারতে মিশে ছিল পাগল ছন্দ, যার তালে তালে মুঘল স্থাপত্যে ঘটে গিয়েছিল বিপ্লবের মতো আমূল রূপান্তর। জীবিতকালে তিনি ছিলেন প্রশ্ন আর মৃত্যুর পরে হয়েছিলেন মুঘল স্থাপত্যের উত্তর।

নওলক্ষ মণ্ডপের পূর্বমুখী ফাসাদ ও পশ্চিমদিকে দেয়ালের কেন্দ্রে মাখসুরাহ- পাথরের জালির খিলান পর্দা যা সম্রাট শাহজাহানের ঝরোখা দর্শনের জন্য ব্যবহৃত হত

জোসেফ রুডিয়ার্ড কিপলিং (১৮৬৫-১৯৩৬) ও ওয়ালকট ব্যালেস্টেয়ার তাঁদের ‘দ্য নওলক্ষ-এ স্টোরি অব ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট’ উপন্যাসে, রত্ন খচিত নেকলেসের নাম রেখেছিলেন-নওলক্ষ। শুধু তাই নয় উপন্যাসিক রুডিয়ার্ড কিপলিং আমেরিকায় ভারমন্ট শহরে তাঁর বাড়ির নাম দিয়ে ছিলেন নওলক্ষ। রুডিয়ার্ড কিপলিং কবে লাহোর দুর্গে এসেছিলেন তা জানা যায়-না। কিন্তু মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর ১৬৩১ সালে লাহোর দুর্গে চর্তুভূজ শাহ বুরুজের উপর মাকরানা মার্বেল পাথর দিয়ে সম্রাট শাহজাহান গড়ে তুলেছিলেন নওলক্ষ মণ্ডপ। ওই একই সময়ে গড়ে ওঠা শিশ মহল ও নওলক্ষ মণ্ডপ সহ সমস্ত প্রাঙ্গন সম্রাটের ব্যক্তিগত হারেম হিসাবে ব্যবহৃত হত।

নওলক্ষ মন্ডপের পুর্বদেয়ালে পিয়েত্রা ড্যুরা (পরচিনকারী শৈলী)

সম্রাট শাহজাহানের সান্ধ্যকালীন অবসর সময় কাটানোর জন্য যে কোন দুর্গের শাহ বুরুজে উদ্যান ও জলের ফোয়ারা সহ চতুর্ভুজ প্রাঙ্গন গড়ে তোলা আবশ্যিক ছিল। ১৬৩১ সালে লাহোর দুর্গে ওই প্রজেক্টের কাজ শুরু হলেও শেষ হয়েছিল ১৬৩৩ সালে। ত্রিশ বছরের শাসনকালে সম্রাট চারবার লাহোর সহ কাশ্মীর ভ্রমণ করেছিলেন, ১৬৩৪ সালে সম্রাট হিসাবে তিনি প্রথম লাহোর দুর্গ ও কাশ্মীরে এসেছিলেন। ফিতে কেটেছিলেন নওলক্ষ মণ্ডপ ও শিশ মহলের। প্রায় একই সময়ে (১৬৩০) আগ্রা দুর্গে দেওয়ান-ই আম তৈরী করা হয়েছিল। ১৬৩৮ সালে সম্রাট আগ্রা দুর্গ ত্যাগ করে শাহজাহানবাদে (দিল্লি, লাল কেল্লা) রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং মমতাজ মহলের মৃত্যর পরে মুঘল স্থাপত্যের পরচিনকারী (পিয়েত্রা ড্যুরা) শিল্পে পার্সিয়ান শৈলীর ফ্লোরাল মোটিফে চীনা শৈলীর উড়ন্ত মেঘের নকশা প্রবেশ করে।

বাংলা চার-চালার নওলক্ষ ভবন, লাহোর দুর্গ

মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর রোম্যান্টিক সম্রাট একজন ডাকসাইটে লেডি কিলার হয়ে উঠেছিলেন। মমতাজ মহলের ছোট বোন ফরজানা বেগম অর্থাৎ শ্যালক জাফর খানের স্ত্রী এবং তৎকালীন দিল্লি শহরের গভর্নর খলিলল্লাহ খানের (পরবর্তী সময়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শিবিরে যোগ দিয়ে ছিলেন) বেগম ছিলেন তাঁর দুই প্রণয়িনী। সম্ভবত কাশ্মীরের প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্রাটের মনে ও স্থাপত্যে প্রভাব ফেলেছিল। তাই মুঘল স্থাপত্যে পরচিনকারী শিল্পে পার্সিয়ান শৈলীর পরিবর্তে চীনা শৈলীর উড়ন্ত মেঘের নকশা দেখা গিয়েছিল। এযেন উজ্জ্বল রঙের ক্রমাগত চাপে চোখ জলে যাওয়ার দৃশ্য। যেখানে মিশে আছে সম্রাট শাহজাহানের কবিতা- অতীতকালের পিকটোগ্রাফ আর নকশায় মিশে থাকে সাতরঙ্গের রামধনু।

লাল কেল্লার ফ্লোরাল মোটিফে চীনা শৈলীতে উড়ে যাওয়া মেঘে (বামদিক ও ডানদিকের উপরে) সম্রাট শাহজাহানের কল্পনা