দিলমুন ছিলো আরব উপদ্বীপের পূর্ব অংশে অবস্থিত একটি সভ্যতা। এই সভ্যতাটি অত্যন্ত প্রাচীন হলেও বিশ্বের অন্য ৪ টি সভ্যতার মতো তেমন একটা পরিচিতি পায় নি। মেসোপোটেমিয়া, প্রাচীন মিশর, সিন্ধু উপত্যকা এবং ইয়ালো বা হলুদ রিভার সভ্যতার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পরেছিল এই দিলমুন। ঐ চারটি প্রাচীন সভ্যতা নদীর পারে গড়ে উঠলেও দিলমুনের এই সভ্যতাটি ছিল একটি দ্বীপ। এটি বর্তমানে বাহরাইন অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে এর অবস্থান থাকার কারণে একটি জনপ্রিয় বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল দিলমুন এবং দেখা গিয়েছে প্রাচীন জনপ্রিয় ৪ টি সভ্যতার মধ্যে দুটির সাথে এর ব্যাপক যোগাযোগ ছিল। মেসোপোটেমিয়া এবং সিন্ধু সভ্যতার সাথে এর যোগাযোগের বিস্তর প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও ওমানের এলম, সিরিয়ার আলবা এবং তুরস্কের হাইটানের প্রাচীন স্থানগুলোর সাথে দিলমুনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
বর্তমান বাহরাইনে গবেষণা করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে যে দিলমুনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এখানকার ঝর্ণা থেকে প্রবাহিত মিষ্টি জল। এ মিষ্টি জলের প্রাচুর্য তাকে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছিল। এই ঝর্ণার কারণেই কৃষি যোগ্য কিছু উর্বর ভূমি ছিল দিলমুনে। অনেকের মতে বাইবেলে উল্লেখিত ইডেন উদ্যান সম্ভবত এই বাহরাইনই ছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে দিলমুনের ধর্মীয় রীতিনীতি এবং বিশ্বাসের সাথে সেই সময়কার অন্যান্য উন্নত সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসের বেশ মিল ছিল। মেসোপোটেমিয়া এবং প্রাচীন মিশরের মানুষের মতন করে এরা মৃতদেরকে সমাধিস্থ করার সময় তাদের সাথে হাতিয়ার, খাদ্য, পানি, অস্ত্র ও সোনা দিয়ে দিত। এর মাধ্যমে আরো বোঝা যায় পরকালের প্রতি তাদের এক ধরনের বিশ্বাস ছিল।
মেসোপোটেমিয়ার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য হচ্ছে গিলগামেশের মহাকাব্য। গিলগামেশ তার প্রিয় বন্ধু এনকিদুর মৃত্যুর পরে অমরত্বের সন্ধান লাভে বেড়িয়ে পরে। কিন্তু কে দিবে তাকে এর সন্ধান? একমাত্র উত-নাপিষ্টিমই তাকে এই অমরত্বের খোঁজ দিতে পারবে। তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি জীবনে অমরত্ব লাভ করেছিলেন।
এই উত-নাপিষ্টিম হলেন এই পৃথিবীর একজন নিষ্পাপ মানুষ। মেসোপোটেমিয়ার মহাপ্লাবনের গ্রন্থে দেবতা এনকি তাকে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে নির্বাচিত করেন। মহাপ্লাবনের সময়ে পৃথিবীর প্রাণী কুলকে রক্ষা করার জন্য তিনি বিশাল এক নৌকা তৈরি করেন। তার কারণেই আজ এই বিশ্বে নানা রকমের বৈচিত্র্যপূর্ন প্রাণীর উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। এই উত-নাপিষ্টিম যেখানে বসবাস করে সেখানে যেতে হলে গিলগামেশকে সমুদ্র অতিক্রম করতে হবে।
তবে সমুদ্র পারি দিয়ে সেই পবিত্র স্থানে যাওয়াটা খুব একটা সহজসাধ্য ছিল না। একমাত্র সূর্য দেবতা উতুবসামাসি সেখানে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। সমুদ্রের অপর পাড়ের স্থানটি হচ্ছে দিলমুন। সেখানকার মানুষ জীবজন্তু সকলেই স্বর্গ সুখে ছিল। তাদের দুঃখ নাই, দুর্দশা নাই, কাউকে বার্ধক্যও ছুতে পারে না। এত গেলো পৌরাণিক কাহিনীতে দিলমুনের বর্ণনা।
তবে শুধু পৌরাণিক কাহিনীতেই যে দিলমুনের বর্ণনা রয়েছে তা কিন্তু নয়। সুমেরীয় এবং ব্যাবিলনীয় কিউনিফর্মেও দিলমুনের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারা যায়। একটি কিউনিফর্ম থেকে জানা গিয়েছে লাগাশের প্রথম রাজবংশের প্রথম রাজা উর-নানশেকে উপঢৌকন দেওয়ার জন্য দিলমুন থেকে জাহাজে কাঠ পাঠানো হয়েছিল।
সারগন দ্য গ্রেটের রাজত্বকালের আরেকটি শিলালিপি থেকে দেখা গিয়েছে যে দিলমুনের জাহাজগুলি আগদ নগরীর সমুদ্র বন্দর গুলোতে নোঙর করেছিল। আর এই জাহাজগুলির মাধ্যমেই সম্ভবত মেসোপোটেমিয়া এবং সিন্ধু উপত্যকার মধ্যে দিলমুন বণিকদের বাণিজ্য সম্ভব হয়েছিল। মেসোপোটেমিয়ার কিছু কিছু অঞ্চল থেকে সিন্ধু সভ্যতার কিছু বৃত্তাকার সিল পাওয়া গিয়েছিল যা দিলমুন থেকে এসেছিল বলে মনে করা হয়। এই সিলগুলো পরীক্ষা করে বোঝা যায় এই তিন সভ্যতার মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ওমানের খনি থেকে মূল্যবান ধাতু তামা মেসোপোটেমিয়ার শহরগুলোতে পাঠানো হত। মনে করা হয় তামার রপ্তানিতে একচেটিয়া অধিকার ছিল দিলমুনের ব্যবসায়ীদের।
দিলমুনের অবস্থান নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে। দিলমুন, কুয়েত, উত্তর-পূর্ব সৌদি আরব এবং ইরাকের বসরার আলকুরনায় অবস্থিত বলে কেউ কেউ মনে করেন। ১৯৫০ এর দশকে কাল’আত আল-বাহরাইনে বিজ্ঞান ভিত্তিক খনন শুরু হয়। এ থেকে বোঝা যায় বর্তমান বাহরাইনেই এই প্রাচীন বন্দর এবং রাজধানীটি অবস্থিত ছিল। খননের মাধ্যমে প্রায় সাতটি স্তরের বসতি উন্মোচিত হয়েছে। ২৩০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের আগেই সেখানে বসতি ছিল বলে মনে করা হয়। এছাড়াও কিছু সমাধিও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, সেই সাথে প্রায় ১৭০০০০ ঢিবিও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। মূল দ্বীপের প্রায় ৫ শতাংশ অঞ্চল নিয়ে অর্থাৎ ৩০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে এই সমাধি গুলো রয়েছে। এগুলো খ্রিস্টপূর্ব ২য় এবং ৩য় শতাব্দীর। অনেকে মনে করেন আরবদের সমাধিস্ত করার জন্যই এই দ্বীপটি বেছে নেওয়া হয়েছিল। হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর প্রথম কয়েক বছরে দিলমুন তাদের উন্নতির শিখরে গিয়ে পৌছায়। পরবর্তীতে জলদস্যুদের প্রার্দুভাবে ধীরে ধীরে দিলমুন তার বাণিজ্যিক সুপ্রিমেসি হারাতে শুরু করে। এরপর অ্যাসীরিয় সাম্রাজ্য নব্য ব্যবীলনীয় সাম্রাজ্য এবং পরে একামেনিড সাম্রাজ্যের কাছে তারা পরাভূত হয়ে তাদের অধীনে চলে যায়।