Akbar The Great

সম্রাট আকবর যা পারিনি টোডরমল ও মানসিংহকে দিয়ে, বাদশাহ জাহাঙ্গীর তা করিয়ে দেখিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে প্রেমিক, মদ্যপ,সবচাইতে ভাবুক, সাম্রাজ্য বিস্তারে যার কোন অবদান নেই, ইত্যাদি হাজার অপবাদ। অনেক ঐতিহাসিক জাহাঙ্গীরকে স্ত্রী নূরজাহান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত সম্রাটের তকমা এটে দেন। সেই বাদশাহ জাহাঙ্গীরই ভারতের সবচাইতে বেশি অর্থ রাজস্ব প্রদানকারী সুবা বাংলাকে মোঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন। কার মাধ্যমে এই বিজয় হয়? সে কে??

আমরা কম বেশি সবাই খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.) ও সেলিম চিশতির নাম শুনেছি। আমাদের অনেকেই ভারতের আজমীর শরীফ দর্শণে যাই। কিন্তু কয়জন জানি তারই বংশধরের হাত ধরে জাহাঙ্গীরনগর নাম নিয়ে রাজধানী করা হল ঢাকাকে!! আরো পরিচয় আছে তার। তিনি ছিলেন মায়ের দিক দিয়ে সেলিম চিশতির নাতি ও আকবরনামা রচয়িতা আবুল ফজলের আত্বীয়। এত ভূমিকা যার জন্যে- তিনি হলেন বাংলার মুঘল সুবাদার ইসলাম খান। তিনি সুবাদার হয়ে ১৬১০ সালের জুন-জুলাই মাসে ঢাকা আসেন। যদিও দায়িত্ব পান ১৬০৮ সালে। এ দুই বছর তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেন বাংলা বিজয়ের জন্য।

Old Dhaka

এই প্রবন্ধে আমরা খুঁজে বের করবো- বাংলার মুঘল সুবাদার ইসলাম খানের কবর হাইকোর্ট মাজার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফতেপুর সিক্রিতে নানা সেলিম চিশতির কবরের পাশে সমাহিত করা হল কি করে এবং কেন? আরো প্রশ্ন জাগে, তিনি কিভাবে মারা গেলেন? তারপর, একজন সুফি-দরবেশ হয়ে তিনি কিভাবে বাংলা জয় করলেন? এখানে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হল।

Sheik Selim Chishti

পরিচয়:
ইসলাম খান চিশতি ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছোটবেলার খেলার সাথী। তার প্রকৃত নাম শেখ আলাউদ্দীন চিশতি। তার বাবার নাম শেখ বদরউদ্দিন চিশতি। তার নানা ভারতের ফতেহপুর সিক্রির বিখ্যাত দরবেশ শেখ সেলিম চিশতি।
সমগ্র ভারতবর্ষ আকবরের দখলে কিন্তু মনে তার কোন শান্তি নেই। তাঁর প্রথম দুটি সন্তান হাসান ও হুসেন মারা যাওয়ার পর তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীশূন্যতা দেখে চিন্তায় বিমর্ষ হয়ে পড়েন। সকল সভাসদ তাকে শেখ সেলিম চিশতি দরবেশের দরগায় প্রার্থনা করতে বললে; তিনি তাই করেন। দরবেশ শেখ সেলিম আকবরকে শুধু ১টি সন্তানেরই আশ্বাশ দেননি, ৩টি সন্তানের আশীর্বাদ করেন।
 
তারপর মরিয়ম-উজ-জামানি সন্তান সম্ভবা হন এবং ১৫৬৯ সালে জন্ম নেয় পুত্র জাহাঙ্গীর, যার নাম রাখেন দরবেশের নামানুসারে ‘শেখ মুহাম্মদ সেলিম’। আদর করে আকবর ডাকতেন ‘শেখু বাবা’ বলে। রাজ্যাভিষেক হলে তিনি ‘জাহাঙ্গীর’ উপাধি ধারন করেন। সেই থেকেই মুঘল পরিবারের সাথে চিশতি পরিবারের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাছাড়া ভারত উপমহাদেশে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.) এর মাধ্যমে গড়ে ওঠা চিশতিয়া সুফিধারা বিখ্যাত। ইসলাম খান চিশতি ছিলেন সেই পরিবারের ছেলে। তার সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না কিন্তু তিনি মুঘল ঐতিহ্যের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পারিবারিক সূত্রে পেয়েছিলেন । যা তাকে বিদ্রোহী বাংলা জয় করতে সাহস যুগিয়েছিল । ১৬০৫ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসার পর, সম্রাট তাকে দু’হাজারী মনসবদারীতে উন্নীত করে “ইসলাম খাঁ” উপাধি দেন। তাকে জাহাঙ্গীর প্রথমে বিহার প্রদেশের সুবাদারের দায়িত্ব দেন, তারপর বাংলার সুবাদারিতে পাঠান এবং পাঁচ বছরেরও বেশি সময় তিনি বাংলার মুঘল সুবাদার ছিলেন।
 

Subadar Islam Khan

 
বাংলা বিজয়:
সম্রাট আকবর তাঁর বারোজন দক্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে বাংলা জয় করার জন্য অনেকবার অভিযানে পাঠালেও সামন্ত বিদ্রোহের কারণে তা সফল হয়নি। সেসময় স্থানীয় রাজা, বারো ভূঁইয়া, জমিদার ও আফগান নেতারা বাংলাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। কাজেই পিতা আকবরের ইচ্ছাপূরণের দায়িত্বটা পুত্র জাহাঙ্গীরের ওপর বর্তায় এবং সানন্দে তিনি তা গ্রহণ করেন ও তিনি বাংলা বিজয়ের লক্ষ্যে ইসলাম খানকে পাঠান। ইসলাম খানের বয়স তখন ৩৮ বছর। প্রথমেই সরাসরি যুদ্ধ না করে, তিনি বাংলার রাজনীতি ও ভৌগলিক পরিবেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করেন। তিনি বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান বাঁধার কারণ চিহ্নিত করেন। সেই মোতাবেক বারো ভূঁইয়ার ভাটি এবং খাঁজা উসমানের অধীনস্থ আফগানদের সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেন। তিনি ছোট-বড় নদী ও খালে পরিপূর্ণ ভাটি অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গঠিত করেন। যা ছিল তার সাফল্যের মূল কারণ। এছাড়া, পূর্ব বাংলা থেকে রাজধানী রাজমহলের দূরত্ব ছিল অনেক। তাই কৌশলগত দিক দিয়ে তিনি রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন এবং বাদশাহ জাহাঙ্গীরের নামানুসারে ‘জাহাঙ্গীরনগর’ নাম দেন। আধুনিক ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন ঘটে।
 
ঢাকা অবস্থিত ছিল ভাটি অঞ্চলের কেন্দ্রে এবং নদী দিয়ে যোগাযোগের জন্য সুবিধাজনক স্থান। ধারণা করা হয় এই সময়ে তিনি খিজিরপুর দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। বিখ্যাত পূর্বসূরিরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছিল সেখানে চট্টগ্রাম ছাড়া সমগ্র বাংলা জয় করে মুঘলদের নিয়ন্ত্রণে আনার সাফল্যে সুবাদার ইসলাম খান বিরাট খ্যাতি অর্জন করেন। তার সামরিক এবং নৌবাহিনীকে পুনগঠিত করে প্রথমে বারো ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। বারো ভূঁইয়াদের মিত্র যশোরের শক্তিশালী রাজা প্রতাপাদিত্য এবং ভুসনার রাজা সতরঞ্জিতকে দমন করেন। ১৬১১ সালের শেষের দিকে বারো ভূঁইয়াদের প্রধান মুসা খানও আত্মসমর্পন করেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে খাজা উসমানের মৃত্যুতে মুঘল সৈন্যরা আরো সুবিধা অর্জন করে। বাংলা বিজয়ের পর মুঘল বাহিনী অগ্রসর হয়ে সিলেটের বায়জিদ কররানীর অধীনস্থ আফগান সৈন্যদের পরাজিত করে এবং তারপর কুচবিহার, কামরূপ এবং কাছাড় রাজ্য জয় করেন।

Raja Todar-Mall

 
অন্যান্য কৃতিত্ব:
ঢাকার ইসলামপুর তার নামেই। পারসিয়ান শব্দ ‘পুর’ অর্থ যেখানে পূর্বপুরুষরা বাস করত। রমনার একাংশ একসময় তার বংশের নামে মহল্লা চিশতীয়া বলে পরিচিত ছিল। সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনের মসজিদটি ইসলাম খান নির্মাণ করেন। এখন সেটি ইসলাম খানের মসজিদ নামেই পরিচিত। ঢাকার বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি দুর্গ ছিল যা ইসলাম খান পুননির্মাণ করেছিলেন এবং টাকশাল তৈরি করেন, যা ১৭৭২ পর্যন্ত টাকা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো। যেটি জাহাঙ্গীরনগর দুর্গ নামে পরিচিত বলে মত আছে।

Raja Man-Singh

 
মৃত্যু ও তার কবর:
ইসলাম খান ঢাকা থেকে ২৫ মাইল উত্তরে বর্তমান গাজীপুরের ভাওয়ালে অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যান। জানা যায়, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন যুদ্ধ ও অভিযানের পর ইসলাম খান ভাবল তার সুবাদারীর অনেক কাজ শেষ করেছেন। এখন তার একটু আনন্দ ও বিশ্রামের প্রয়োজন। সেজন্য তিনি ভাওয়াল অঞ্চলে শিকারে যান। শিকারের সময় হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দ্রুত তাবুতে নিয়ে আসা হয়। তাবুতে অবস্থান করার সময় বুকে ব্যাথা নিয়েও বিভিন্ন রাজকার্যে ব্যস্ত হয়ে যান ঠান্ডা মাথায় স্থিরচিত্তে । তার শরীর তা সহ্য করতে পারিনি। তিনি কাজের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। হাকিম কুদসি তার চিকিৎসা করছিলেন এবং চন্দনের প্রলেপ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার জ্ঞান আর ফেরেনি। হয়তো যদি সঠিক ঔষধ দিতেন, তাহলে ইসলাম খানের অকাল মৃত্যু ঘটতো না। ততক্ষনে তিনি না ফেরারা দেশে চলে গেছেন, দিনটি ছিল ১৬১৩ সালের ২১ আগস্ট। কিন্তু তার মৃত্যুর খবর গোপন রাখা হয়।
 
পরে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সন্মান দিয়ে কফিনটি ঢাকায় এনে তাকে প্রথমে কবর দেয়া হয় ‘বাদশাহী বাগে’, যা বর্তমানে ঢাকার পুরনো হাইকোর্ট মাযার এলাকা। মুঘল আমলে ঐ এলাকায় বাদশাহী বাগান গড়ে তোলা হয়েছিল। ইসলাম খানকে সমাহিত করার পর ঐ এলাকা ‘চিশতি-বেহেশতি’ নামে পরিচিত হয়।
 
তবে মুনতাসির মামুনের হারিয়ে যাওয়া ঢাকার খোজে বই থেকে, তোইফুরের মতে, ইসলাম খানকে কবর দেয়া হয়েছিল হাইকোর্ট মাযার এলাকায়। পরে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে তার দেহাবশেষ ফতেহপুর সিক্রিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার নানা শেখ সেলিম চিশতির কবরের পাশে আবার সমাহিত করা হয়।তারপর থেকে শূন্য সমাধি অবহেলিতভাবে পড়ে ছিল। তা জঙ্গলে ঢেকে যায়। মূল ব্যাপার হল ১৯৪৩ সালেও লেখক তোইফুর সমাধিটি দেখেছিলেন। কিছুদিন পর দেখা গেল এক চতুর ব্যক্তি সমাধিটি পরিস্কার করে সেখানে মাযার সাজিয়ে বসে। পরে ভক্তেরও সমাবেশ ঘটে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠে এই মাজার। সত্য-মিথ্যা জানি না । জাহাঙ্গীর ফতেহপুর সিক্রিতে একটি সমাধি সৌধ তৈরি করেন তাঁর দুধ ভাই ও বাল্য বন্ধুর স্মৃতির স্মরণে।

Isa Khan (Baro Bhuiyan)