প্রাচীন বাংলার প্রথম নির্বাচিত রাজা পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল। এটা নিয়ে অবশ্য অনেকের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। আবার গোপালের বংশ পরিচয় ও তাঁর উৎপত্তি সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা যায় না। কারণ, আমাদের কাছে তেমন কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই। শুধুমাত্র তার ছেলে ধর্মপালের সময়কালের খালিমপুর তাম্রলিপিতে বাবার বিষয়ে সামান্য কিছু তথ্য ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে কিভাবে আমরা পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালকে বাংলার প্রথম নির্বাচিত রাজা বলছি? এখানে সেটাই বলার চেষ্ঠা করা হলো।
পাল বংশের আদি পুরুষ বাস করত ভারতীয় উপমহাদেশের মগধ রাজ্যে। আধুনিক পন্ডিতদের মতে, পাল বংশের আবাস্থল ছিল বরেন্দ্রভূমি অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ। একমাত্র ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রলিপিতে গোপালের বাবা, দাদা ও স্ত্রীর নাম উল্লেখ রয়েছে। গোপালের বাবার নাম ছিল বপ্যট। শত্রূ ধ্বংসকারীকে বলা হয় বপ্যট। আর দাদার নাম ছিল দয়িতবিষ্ণু, যার মানে হচ্ছে যার সর্ববিদ্যা-বিশুদ্ধ । গোপালের স্ত্রীর নাম ছিল দেদ্দাদেবী। পাল রাজাদের বংশ পরিচয় সম্পর্কিত সমস্যার মতোই পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল যে বাংলার প্রথম নির্বাচিত রাজা সে সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। খালিমপুর তাম্রলিপি ছাড়া লামা তারনাথের গ্রন্থ এবং রামচরিত গ্রন্থে এসব বিষয়ে কিছুটা বর্ণনা পাওয়া যায়। রামচরিত গ্রন্থে বরেন্দ্রভূমিকে পাল রাজাদের জনকভূমি বা পিতৃভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে করে মনে করা হয় যে, উত্তরবঙ্গেই পাল রাজাগণ তাদের আদি রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পূর্ব ভারত ও উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল।
বাংলার গৌড় রাজ্য এবং উত্তর-পশ্চিম বাংলায় প্রথম গোপালের উত্থান হয়েছিল বলে কেউ কেউ বলে থাকেন। ঐতিহাসিক তারনাথের মতে, গোপাল মগধ বা বর্তমান দক্ষিণ বিহারও জয় করেছিলেন। গোপাল ছিলেন একজন শত্রূ দমনকারী যোদ্ধা এবং তিক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি । “পাল” শব্দটির অর্থ “রক্ষাকর্তা”। গোপাল বাংলার জনগনের জন্য একজন রক্ষাকর্তা হিসেবেই এসেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এবং অন্য ধর্মের প্রতিও সহানুভূতিশীল। খালিমপুর লিপিতে তাকে “পরম সৌগত” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আরো বলা হয়েছে যে, রাজা গোপাল ছিলেন সূর্য বংশের সন্তান। যদিও এর জোড়ালো কোনো প্রমানপত্র আজ আর আমাদের হাতে নাই।
যাইহোক, ৬৩৭ সালে বাংলার স্বাধীন শাসক শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শুরু হয় রাজ্য দখল নিয়ে বিশৃঙ্খলা-সংঘর্ষ-অরাজকতা। বড় বড় রাজারা ছোট ছোট রাজাদের পরাজিত করে তাদের সব এলাকা দখল করে নিতে থাকে। প্রায় একশত বছর ধরে বাংলাই এই ঘোর অরাজকতা চলছিল। সেই সময় কোন স্থানে স্থায়ী কোনো শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেতে পারে নি। নিজেদের অভ্যন্তরীণ গোলযোগতো ছিলই, তার উপরে বিদেশীদের আক্রমণে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা আরো বেড়ে যায়। এই রূপ বাংলার বিশৃঙ্খলা অবস্থাকে কবি সন্ধাকর নন্দী “মাৎস্যন্যায়” বলে অভিহিত করেছেন
মাৎস্যন্যায় -এর মানে হলো বড় মাছ ছোট মাছগুলোকে গোগ্রাসে গিলে খেয়ে ফেলে। আসলে এটির মধ্য দিয়ে সেই সময়কার রাজনৈতিক অরাজকতা অবস্থার কথা বোঝানো হয়েছে। বাংলার এই বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা নির্মূল করেই রাজা গোপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন এবং পালবংশের প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে স্থায়ী কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় আবার শান্তি ফিরে আসে। যার ফলে, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গোপাল বিভিন্ন কর্মচারী এবং সামন্ত রাজাদের আনুগত্য লাভ করেন ও জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। টাইম মেশিন থাকলে হয়তো সেই সময়ে চলে গিয়ে দেখে আসা যেত, আসলে কী ঘটেছিল।
যাইহোক, গোপাল সিংহাসন বসে সর্ব প্রথম বঙ্গদেশ রাজত্ব করেছেন তার পর তিনি মগধ জয় করেছেন । কোন কোন পন্ডিত মনে করেন -গোপাল মগধ জয় করেন নি বরং পাল বংশের লোকেরা মগধে বসবাস করতো। আর তাছাড়া, গোপালের ছেলে ধর্মপাল মগধ জয় করেছিলেন এবং রাজধানী করেছিলেন পাটলিপুত্রে। সেকারণই পাল বংশের বেশির ভাগ লিপি মগধে পাওয়া গেছে। গোপাল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন বলে বহু বৌদ্ধ মঠ তৈরী করে দিয়েছেন ।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আব্দুল মমিন চৌধুরীর মতে, গোপাল ৭৫৬ সাল থেকে ৭৮১ সাল পর্যন্ত মোট ২০ বা ২৫ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তবে তার ক্ষমতালাভ সম্বন্ধে খালিমপুরে তাম্রলিপিতে যে শ্লোকটি আছে তা হলো- ‘তাহার ছেলে শ্রী গোপালকে, যিনি রাজাদের মধ্যে মুকুটমণি ছিলেন, মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটাইবার জন্য প্রকৃতিগণ লক্ষীর হাত গ্রহণ করাইয়াছিল।
এখানে ‘প্রকৃতিগণ’ বলতে ‘জনগণ’ বা ‘প্রধান কর্মচারীদের’ বুঝাচ্ছে । কিন্তু খটকা থেকেই যায় যে, তৎকালীন অরাজকতা ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে জনগণের একমত হওয়া ও নির্বাচন করার কথা অস্বাভাবিক কিনা? যেখানে বাংলায় কোন গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ আমরা দেখতে পাই না সেখানে নির্বাচন এর কথা ভাবাটা বাতুলতা মাত্র। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনের পক্ষেই মত প্রকাশ করেছেন । এমনকি বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার নির্বাচনের ব্যাপারটিতে সন্দেহ পোষণ করলেও গোপাল যে অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে জনগণের মন জয় করে তাদের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাই মত দিয়েছেন । আসলে সেইসময় একজন সুদক্ষ যোদ্ধা হিসেবে অরাজকতা পরিস্থিতিতে বুদ্ধিদীপ্ত গোপাল তার কিছু অনুসারী নিয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করেছিলেন । পরবর্তীতে তার ছেলে ধর্মপাল এই পাল বংশকে পুরো ভারতের মধ্যে এক শক্তিশালী রাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করলে সকলে তাদের মহিমা প্রচার করতে শুরু করেন ।
পাল বংশের উত্থানের ফলে, বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির এক বিরাট পরিবর্তন আসে। ৪০০ বছরের শাসনামলে বাংলার সভ্যতায় তাদের অপরিসীম অবদান রয়েছে। যেমন- ধর্মপাল তার নিজ নাম বিক্রমশীলদেব অনুসারে বিক্রমশীল বিহার প্রতিষ্ঠা করেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়।
এছাড়া তিনি বাংলাদেশের নওগা জেলার পাহাড়পুর অঞ্চলে সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এই পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারটি এখন ইউনেস্কোর একটি বিশ্ব ঐতিহ্য সাইট। পাল যুগের নিদর্শণ থেকে পাওয়া যায় যে, ভাত ও মাছ ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। মৌরাল মাছের তরকারি সুগন্ধ ভাত, নলিতা শাকের ঝোল ছিল উৎকৃষ্ট খাবার। এছাড়া হরিণ ও পাঠার মাংস ছিল খুবই প্রিয়। বাঙ্গালি ব্রাহ্মণ ছাড়া সকল সম্প্রদায় সুরা পান করত। এই যুগের সমাজ ব্যবস্থায় নারী -পুরুষ সকলেই অলংকার ব্যবহার করত। নারীরা প্রসাধনী হিসেবে সিঁদুর,কাজল মাখতো, খোঁপা বাঁধত এবং পায়ে রং দিত। নারীরা সোনা ও রুপার তৈরি অলংকার ব্যবহার করত। শিল্পের মধ্যে বস্ত্র শিল্প ছিল বিখ্যাত। বাংলার মিহি সুতার কাপড়ের বিষয়ে আরব ও চীনা পর্যটকরা উচ্চ প্রশংসা করেছেন। চর্যাপদ থেকে জানা যায় যে, বাংলায় “দুকুল” নামে রেশমের কাপর তৈরি হতো। এছাড়া বাংলার অন্যতম প্রধাণ শিল্প ছিল চিনি শিল্প। সেই সময় বাংলার জাহাজ নির্মাণ ছিল বেশ বিখ্যাত। আর টেরাকোটা শিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরে, যা আজও বিস্ময়। পাহাড়পুরের ভাস্কর্যের ও টেরাকোটা শিল্প দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে পালযুগের দুই শেষ্ঠ ভাস্কর ছিলেন বীতপাল ও ধীমান। শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রেও ছিল উন্নত। পাল যুগে বাংলায় শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছিল। পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হয়েছিল। এগুলো ছিল শিক্ষাকেন্দ্র। এ যুগের বিখ্যাত বৌদ্ধ দর্শন ধর্মশাস্ত্রের পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর ছাড়াও ভবদেব ভট্ট, চক্রপানি দত্ত, শূরপাল ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত। এসব ছাড়াও আরো বহু ক্ষেত্রে তাদের অবদান রয়েছে । আসলে গোপালের প্রতিষ্ঠিত পাল বংশের মাধ্যমে বাঙালী সংস্কৃতির ও ধর্মের এক নবজন্মের সূচনা হয়েছিল।
তথ্যসূত্রঃ
খালিমপুর তাম্রশাসন থেকে, গৌড়লেখমালা ।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহাস, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৮ ।
নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস – আদি পর্ব, কলকাতা-৭৩, ২০০৮ ।
Ramesh Chandra Majumder, History of Ancient Bengal, 1971।
Abdul Momin Chowdhury, Dynastic history of Bengal, c. 750-1200 CE.।