ক্রিকেট সারাবিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে একটি। ক্রিকেট নিখুঁত এক শিল্প। অর্থোপার্জন, মনোরঞ্জন এমনকি যুদ্ধ তৈরির জন্যও হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে এই খেলাটি। বলা হয় সাহেব সুবাদের হাত ধরেই এই উপমহাদেশে ক্রিকেটের প্রবেশ। ১৮৫৭ সালে ঘটে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, যদিও ভুল করে একে সিপাহী বিদ্রোহ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর সিপাহিদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া একটি বিদ্রোহ ক্রমশ গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতে তথা উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উত্তর মধ্যপ্রদেশ ও দিল্লি অঞ্চল ছড়িয়ে পড়েছিল।
ভারতবর্ষের এক প্রান্তে দিল্লি, অন্য প্রান্তে রয়েছে বাংলা। স্বাধীনতা যুদ্ধের এই রেশ বাংলায় যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং বাংলার মানুষকে যাতে বিদ্রোহী করে তুলতে না পারে তাই ১৮৫৮ সালে প্রচুর সৈনিকের সমাগম ঘটে বর্তমান বাংলাদেশে। তারা কিছুতেই চায় না এই আন্দোলনের ছোঁয়া যাতে এই অঞ্চলের মানুষগুলোকে প্রতিবাদী করে তোলে। তাই যুদ্ধের পাশাপাশি শাসকেরা বাংলার মানুষের মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখার জন্য নানা রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তারা ভাবল, বিনোদনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে বাংলার মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা যায়। আর এই বিনোদনের এক উৎকৃষ্ট মাধ্যম হচ্ছে খেলাধুলা।
ব্যস! হয়ে গেল বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের সংযোজন। ১৮৫৮ সালে ঢাকার মানুষেরা অভিজ্ঞতা অর্জন করল ক্রিকেট নামের একটি খেলার। আর এর সাক্ষী হয়ে থাকল ঢাকাবাসী। ঢাকার জীবনে খেলাধুলার ক্ষেত্রে শুরু হলো আরেকটি অধ্যায়। আজও তা সমান তালে চলছে। সেই সময়কার ক্রিকেটের নানা রকম গল্প চার্লস স্টুয়ার্টের লেখা থেকে পাওয়া যায়। তার লেখায় উল্লেখ রয়েছে যে ১৮৬৬ সালে ঢাকায় ছিল এক বিশাল ক্রিকেটের মাঠ। বিভিন্ন সময় ইংরেজরা সেখানে ব্যাট-বল হাতে নেমে যেত। নববর্ষ ও বিভিন্ন উৎসবেও চলত তাদের এই খেলা। তিনি ইন্টার-সিটি ম্যাচ নামে একটি ম্যাচের কথা উল্লেখ করেন, খেলাটি ছিল কলকাতা বনাম ইস্টার্ন বেঙ্গল। ওই খেলায় কলকাতা তার প্রতিপক্ষকে ৩১৭ রান করে প্রায় বোকা বানিয়ে দিয়েছিল।
আনন্দ নেওয়ার ইচ্ছেটা একটু একটু করে জাগরিত হতে শুরু করল ভারতবাসীর (নেটিভদের) মধ্যেও। তবে ইংরেজরা খুব একটা গুরুত্ব দিত না এই নেটিভ খেলোয়াড়দের। সম্মান তো দিতই না। তারপরেও ১৮৭৬ সালে প্রথমবার নেটিভদের ক্রিকেট খেলা হয়। একেবারে আন্তর্জাতিক এক ম্যাচ যেখানে ইউরোপীয় এবং নেটিভরা পরস্পর একে অপরের বিরুদ্ধে খেলায় নামে। ৬৯ রানে তোলার পরে হতভাগ্য নেটিভরা কাবু হয়ে পড়ে। বোঝাই যাচ্ছে এই খেলায় কারা জিতেছিল।
পরাজয়ের পরেও এই খেলার একটি সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল। দেশের মানুষেরা তখন ক্রিকেটটাকে বেশ গুরুত্বের সাথে নেয়। ঢাকা ও পূর্ববঙ্গের অন্যান্য অংশে ক্রিকেট খেলা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন কলেজে শুরু হয়ে যায় ক্রিকেট ম্যাচ, আন্তঃকলেজ ম্যাচ। কলেজগুলোর মধ্যে সংগঠিত হতে থাকে। তখন রমরমা ঢাকা কলেজ। ঢাকা কলেজে তৈরি হল এক ক্লাব। ক্রিকেট শিখতে শুরু করল ঢাকা কলেজের গুণী ছাত্ররা।
১৮৮৭ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সির এবং ঢাকা কলেজের মধ্যে ইডেন গার্ডেনে সংগঠিত হয়ে গেল এক ম্যাচ। তখন ঢাকার ক্যাপ্টেন কে ছিল জানেন? আর কেউ না, সত্যজিৎ রায়ের বড় দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় ভাই সারদারঞ্জন। ঢাকা এবং কলকাতার মধ্যে সংগঠিত খেলায় উভয় অঞ্চলের আবহাওয়া হয়ে উঠল বেশ গরম। সংবাদপত্রগুলোও রসিয়ে রসিয়ে সংবাদগুলো উপস্থাপন করে মানুষের মধ্যে এক প্রতিযোগিতা তৈরি করে। যেনতেন ম্যাচ হয়নি। লেফটেন্যান্ট গভর্নরও এসেছিল সেই খেলাটি দেখতে।
তবে খুব ভালোলাগার বিষয় ছিল, ম্যাচে প্রেসিডেন্সিকে হারিয়ে দিয়ে ঢাকাবাসী জয়লাভ করেছিল। খেলা শেষ হলে শুরু হয়ে যায় দুই অঞ্চলের খবরের কাগজের মধ্যে বাকযুদ্ধ। নানা রকম বিতর্ক ও তর্কবিতর্কের পরে ঘোষণা করা হলো ঢাকার দলটি জয়ী হয়েছে।
খেলা যত আকর্ষণীয়ই হোক না কেন, শুরুর দিকে অভিভাবকেরা খুব একটা আনন্দের সাথে এই ম্যাচগুলোকে গ্রহণ করেননি। তাদের কথা ছিল, পড়াশোনা করার সময় ক্রিকেট খেলে বাংলার মানুষগুলোকে অশিক্ষিত করে তোলার পাঁয়তারা চলছিল বিদেশিদের মধ্যে। তবে এর পক্ষেও অনেকে যুক্তি দেখিয়ে বলেছিল খেলাধুলার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। দৈহিক শ্রম এবং ব্যায়ামের কাজ করে দেয় এই খেলাধুলা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে ক্রিকেট অন্যতম। বোঝাই যাচ্ছে আজ যে ক্রিকেটের খেলা আমরা দেখছি তার ইতিহাস ছিল বেশ পুরোনো। বহু বছরের নানারকম চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশের এই ক্রিকেট দল আজ আমাদের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে আসছে।