রোজ মেরী ব্রাউন। গায়ক আইগর স্ট্র্যাভিন্ স্কির আত্মা তার কাছে আনাগোনা শুরু করলো। মাত্র চৌদ্দ মাস আগে স্ট্র্যাভিন্ স্কিন মারা গেছেন। তার আত্মা রোজ মেরির কাছে এসে ষাট পংত্তি গান লিখে নেবার জন্য রীতিমত আদেশ করলো। রোজ মেরী কিন্তু এতে খুব একটা অবাক হলেন না। তিনি বলেন, তার জীবনে স্ট্র্যাভিন্ স্কিই প্রথম মৃত সঙ্গিত রচয়িতা নন। এর আগে আরও ২০ জন মৃতসঙ্গীতজ্ঞ মেরীর অসাধারণ সঙ্গিত প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন।
রোজ মেরীকে মাত্র সাত বছর বয়স থেকে পরলোকগত কিছু সঙ্গীতজ্ঞের মাঝে পরিচিত করে তোলা হয়। তাকে মাধ্যম করে তার আত্মীয় স্বজনরা মৃত সঙ্গীতজ্ঞদের আত্মাকে এ জগতে আনবার চেষ্টা চালান। এর ফলে মেরী একদিন দেখতে পেলেন দীর্ঘ পাকাচুল বিশিষ্ট একজন বৃদ্ধ লোক তার সামনে আবির্ভূত হলেন। পরিধানে তার ধর্ম যাজকদের মত কালো ঢোলা আলখাল্লা। বৃদ্ধ তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে সম্বোধন করে বললেন ,তিনি একজন সঙ্গীত রচয়িতা। রোজ মেরীকে তিনি বিখ্যাত সঙ্গীত রচয়িতা হিসাবে জগতের সামনে তুলে ধরবেন। রোজ মেরীর তখন মাত্র সাত বছর বয়স। আর এ বয়সে তার পক্ষে আগন্তুককে চিনবার কথা নয়।পরবর্তী দশ বছর পর্যন্ত রোজ মেরী তার পরিচিতি জানতে পারেন নি। তারপর অনেক বছর অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় । হঠাৎ একদিন ফ্রাঞ্জ লীজের একখানা ছবি দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে ঐ বৃদ্ধটি ছিলেন ফ্রাঞ্জ লীজ , যিনি তাকে দেখা দিয়ে সুরের জগতে বিচরণ করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
রোজ মেরীর মা ও নানী মৃতের আত্মা আনার ব্যাপারে নিজেদের ব্যাপৃত রেখে বহু সময় ব্যয় করতেন। প্ল্যানচেট করে আত্মা আনার চেষ্টায় তারা বেশ কৃতকার্য ও হন। আর আত্মা আনার মাধ্যম করতেন তারা রোজ মেরীকে। পরলোকগত লোকের আত্মা এসে এই ছোট্র মেয়েটির উপর ভর করতো। এত অল্প বয়স থেকে আত্মা আনার কাজে ব্যবহৃত হয়ে তিনি এ ব্যপারে বেশ বোদ্ধা হয়ে ওঠেন। তিনি তার জন্মের বহু পূর্বের ঘটনাবলী তার মা বাবার কাছে বর্ণনা করতেন। তারা যখন জানতে চাইতেন রোজ মেরী কিভাবে এগুলো জানলো-তিনি জবাব দিতেন তার কাছে বিভিন্ন পরিদর্শক আসে এবং তারাই তাকে এগুলো জানিয়ে যায়।
এই পরিদর্শকদের মধ্যে লিজ কিন্ত ছিলেন না। তিনি ১৯৬৪ খৃষ্টাব্দের আগে পুনরাবির্ভূত হন নি। রোজ মেরীর বিবাহের পর তিনি দুটি সন্তানের জননী হন। তারপর লীজের আগমন ঘটে। তিনি তাকে দেখা দেন।
লন্ডনের সমতল ছাদ বিশিষ্ট ভিক্টোরিয়ান আমলের একটি বাড়ীতে তিনি বাস করেন। এখন তিনি আর দশজন মধ্য বয়সী মহিলার মতই দেখতে।
১৯৬৪ খৃষ্টাব্দের আগে সঙ্গীত সম্বন্ধে তার তেমন কোন উৎসাহ ছিল না। আর এ সস্মন্ধে তার তেমন কোন জ্ঞান ও ছিলনা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তিনি একটি সেকেন্ড হ্যান্ড পিয়ানো কিনেছিলেন। এক বছর ধরে তিনি পিয়ানো বাজানো শিখলেন। রোজ মেরীর এক প্রতিবেশী গির্জায় অর্গান বাজাতেন। তিনি তার বাজনা শুনে একটুও খুশী হতে পারেননি ।তিনি মন্তব্য করেন, ‘রোজ মেরী ধর্ম সঙ্গীতের সঙ্গে রীতিমত কুস্তি লড়ছেন’।
১৯৬৪ খৃষ্টাব্দে লিজ যেন নতুন করে কন্ট্রাক্ট সই করে মেরীকে দেখা দিতে লাগলেন। অতীতের বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞদের কাছ থেকে বন্যার স্রোতের মত নতুন নতুন সুর তার কাছে ভেসে আসতে লাগলো।
মিসেস ব্রাউন ,বিটোভেন ,ব্যাচ চপিন,শুবার্ট র্যাকম্যানিনফ-সেই সঙ্গে অবশ্যই লিজেরও সুরের পর সুরের প্রতিলিপি মেরী তৈরি করতে থাকেন।
৪০ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট শুবার্টের সোনাটা ,চপিনের তিন খণ্ডে ফ্র্যানটেইজি ইম প্রম্টু, শুবার্টের বারোটি গান, বিটোভেনের গাওয়া দুইটি সোনাটা, আর সেই সঙ্গে তার দশম ও একাদশ সিম্ফনি –যেগুলো আজও অসমাপ্ত –রোজ মেরী লিপিবদ্ধ করেন।
প্রত্যেক রচয়িতা নিজস্ব ভঙ্গীতে মিসেস ব্রাউনকে শ্রুতলিপি দিতেন। এই শ্রুতলিপি দেবার প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভঙ্গি ছিল। লিজ রোজ মেরীর হাত দুটো কিছুক্ষণ ধরে থাকতেন। তার পরেই তিনি পিয়ানোর সুর তুলতে শুরু করতেন। অন্যান্যের মত চপিন তাকে রীতিমত সুর বুঝিয়ে দিতেন। সময় সময় তার হাতের আঙ্গুল গুলো সঠিক স্থানে ঠেলে দিয়ে সঠিক সুর তুলতে সাহায্য করতেন। শুবার্ট নিজেই তার সুরগুলো রোজ মেরীর কাছে গেয়ে শোনাতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু শুবার্টের গলা ভাল ছিল না। বিটোভেন ও ব্যাচ সুরগুলো শুধু মাত্র ডিক্টেট করতেন। আর এদের এই শুধু মাত্র ডিক্টেশন মেরীর কাছে কিন্তু ভাল লাগতো না। কারণ যেহেতু মেরীর সুর সম্বন্ধে খুব একটা ভাল জ্ঞান ছিল না-শেষ পর্যন্ত এসে কি দাঁড়াবে তাই নিয়ে তার ভাবনা ছিল।
এরা সবাই রোজ মেরীর সঙ্গে ইংরেজী ভাষায় কথা বলতেন। রোজ মেরী কিন্তু এতে খুব একটা অবাক হতেন না। তিনি মনে করতেন অন্য ভাষায় জ্ঞান থাকা তাদের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কোন কারণ বশতঃ যদি তারা উত্তেজিত হয়ে উঠতেন ; তখন তারা নিজ নিজ মাতৃ ভাষায় চেঁচিয়ে উঠতেন। একবার বিটোভেন ‘মেইন গট’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন-যখন রোজ মেরিও তিনি আপ্রাণ চেষ্টায় কোন একটা সুর তুলতে ব্যস্ত ছিলেন, আর ঠিক সেই সময় দরজার ঘণ্টা বেজে ওঠে।
সমালোচকদের দৃষ্টিতেঃ
রোজ মেরীর প্রতিলিপি গুণগত মানের বিষয়ে সঙ্গীত সমালোচকেরা বিভিন্ন মত পোষণ করতেন। কিন্তু এটা তারা স্বীকার করেন যে রচয়িতাদের প্রকাশিত কাজগুলোর সঙ্গে রোজ মেরীর প্রতিলিপি গুলোর রচনাশৈলীতে প্রচুর সামঞ্জস্য রয়েছে।
অতীতে নকলের ও প্রতারণার প্রবণতা ছিল ঠিকই কিন্তু তার জন্য সঙ্গীত সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান ও বিদ্যা থাকারও প্রয়োজন হত। রোজ মেরীর সঙ্গীত ও সুরের জ্ঞান এত সীমিত ছিল যে তার কাছে গাওয়া অনেক সুরেই তিনি ধরতে পারতেন না। বাজানো তো দূরের কথা ! যদিও ব্রাহাম্স এর কাছে শিখে শিখে তিনি পিয়ানোতে বেশ কিছুটা পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। ব্রাহাম্স আঙ্গুলের মাধ্যমে মেরীকে রীতিমত চর্চ্চা করাতেন। কিন্তু র্যাকম্যানিহফ ও লিজ মেরীর নিজস্ব ভঙ্গিমার উপরে নির্ভর করে শেখাতেন।
মনোবিজ্ঞানী ও বিভিন্ন সংগীতজ্ঞ রোজ মেরীকে নানা ভাবে প্রশ্ন করেন ও তার সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান চালালেন। তাদের কেউই কোন ভাবে মেরীকে ঠক বা প্রতারক হিসাবে প্রমান করতে পারলেন না। যারা মেরীকে প্রতারক মনে করে তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মানসে মিলিত হন, তারাই তার সঙ্গে দেখা হবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের অভিযোগ বাতিল করতে বাধ্য হন।
তার কর্ম পন্থাঃ
‘লন্ডন বেইজ্ড সাইকিক নিউজ’ পত্রিকার সম্পাদক মরিস বার্বানেল বলেন, রোজ মেরী এমন একজন মাধ্যম যিনি কেবল মাত্র অতীন্দ্রিয় বিষয়ের শ্রোতাই নন, তিনি একজন অতীন্দ্রিয় বিষয়ক দর্শকও। অন্যান্য শত শত মাধ্যমের মতই তিনি কাজ করেছেন,- পার্থক্য শুধুমাত্র এই যে তিনি বেশ কিছু সংখ্যক বড় বড় সুরকারের সংস্পর্শে এসেছেন।
এ ব্যাপারে আরো অনেক ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করা হল।দেখা গেল সুরকারগণ অজানা গানের সুর রোজ মেরীর মাধ্যমে লিখিত ভাবে রেখে গেছেন আর রোজ মেরী এ সব পৃষ্ঠায় লিখিত বিষয় বস্তুগুলো সহজেই পাঠ করতে পারছেন। যদিও তার পাঠ খুব একটা জ্ঞানদীপ্ত নয়। তিনি যেন টেলিপ্যাথির মাধ্যমে সে গুলোর ব্যাখ্যা করছেন ও পিয়ানোতে সুর তুলেছেন।
অন্য একটি ব্যাখ্যায় বলা হয় যে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে তিনি অন্যান্য সুরকারদের কাছ থেকে হয়ত সুর সংগ্রহ করে থাকবেন। যাই হোক তিনি নিশ্চয়ই এমন কোন সুরকারের সংস্পর্শে আসেননি ।যারা ব্যাচ ও বাহাম্স্ এর মত অভিজ্ঞ ও পারদর্শী।
বৃটিশ সুরকার রিচার্ড রডনি বেনেটের অভিমত ছিল এই যে ভুড়ি ভুড়ি লোক মুখে মুখে ছড়া বাঁধতে পারে কিন্তু বছরের পর বছর অনুশীলন ছাড়া কারুর পক্ষে নকল করে সুর তোলা কেবল অসাধ্যই নয় –রীতিমত অসম্ভব ব্যাপার ।বিটোভেনের কিছু কিছু সুর নকল করা আমার পক্ষেও সম্ভবপর নয়।
সংগীতজ্ঞ বা সুরকারদের অনুভূতিঃ
ইয়েহুদির ভগ্নি কন্সার্টপিয়ানো বাদিকা হেফজিবাহ্ মানুহিন রোজ মেরীর কৃতিত্বে রীতিমত চমৎকৃত হন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, রোজ মেরী অত্যন্ত বিশ্বস্ত মহিলা। তার বিশ্বস্ততায় কোন রকম প্রশ্নের অবকাশ নেই। সুরগুলো অতি অবশ্যই উল্লেখিত সুরকারের নিজস্ব ভঙ্গিমার।
‘নিউ ইয়ক’ ম্যাগাজিনের সঙ্গীত সমালোচক এলান বীচ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার কথা বলেন। যখন তিনি শুনলেন যে ব্যাচ, বিটোভেন, চপিন, ডিবাসী, লিজ, শুবার্ট-ইত্যাদির আত্মাদ্বারা সম্পাদিত হয়ে তাদের শ্রেষ্ঠ সুরকর্মের রেকর্ড রূপে বের হয়ে বাজার জাত হয়েছে-তখন তিনি সে গুলোকে ভুয়া বলেই উড়িয়ে দিলেন। তিনি এ গুলোকে আসল সুর বলে মোটেই মেনে নিতে পারলেন না। তার মতে এ গুলো পরলোকগত সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকারদের বহুল পরিচিত গানের ও সুরের নকল ছাড়া আর কিছুই নয়। যাই হোক ঐ সব নামীদামী সুরকারদের সহজ সূরগুলোই সাধারণঃ রেকর্ডকৃত হয়েছিল। মাঝে মাঝে কিছু কিছু কঠিন সুরও যে রেকর্ডকৃত হতনা, তা নয়-। আর সে গুলো রিচার্ড রড্নী বেনেটের কাছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কারুকার্য ময় ও জটিল বলে মনে হত।
Images Collected From Google