গহনা বা অলংকার সব যুগেই নারীদের জন্য একটি আকর্ষনীয় জিনিস। গহনা শুধু নিজের জন্য বা অন্যের মনোযোগ আকর্ষন করার জন্য পরিধান করা হয় না। অলংকার সামাজিক অবস্থা, পদমর্যাদা ও সম্মানের চিহ্ন হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। মোঘল আমলে ভারতীয় নারীদের সোনার অলংকার ছাড়াও মণি-মুক্তা খচিত গহনার ব্যবহার দেখা যায়। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ, চিত্রাবলী ও পর্যটকদের ভ্রমনকাহিনিতে আমরা সেসবের বর্ণনা পাই। মোগল আমলের রাজমহিষী, রাজকুমারী ও অভিজাত নারীরা নানা ধরনের অলংকারে নিজেদেরকে সাজাতেন। তাঁরা অত্যন্ত সৌন্দর্য সচেতন ও বিলাসী ছিলেন। তাঁরা জাঁকালো ও চোখ ধাঁধানো অলংকার পরিধান করতেন। তাঁরা কপালে মনিমাণিক্যের অলংকার, হাতে মুক্তো ও স্বর্ণের অলংকার, কানে কানবালা, নাকে লং আকৃতির মুক্তো বা স্বর্ণের নাকফুল, গলায় হার, কোমরে স্বর্ণের তৈরী ঘন্টা আকৃতির বিছা, পায়ে স্বর্ণের তৈরী পায়েল বা নূপুর পরতেন। ঐতিহাসিক আবুল ফজলের বিবরণী থেকে জানা যায়, মোগল নারীদের মধ্যে সাঁইত্রিশ রকমের অলংকার পরার প্রচলন ছিল। সেগুলোর মধ্যে শীষফুল, মঙ্গটিকা, নথ, কানফুল, কানের ঝুমকা, হাঁসুলি, গুলুবন্দ, মোহন মালা, বাজুবন্দ, কঁঙ্গন, চুড়ি, আরশি, আংটি ইত্যাদি অন্যতম। দেহের গঠনের ভিত্তিতে এসব অলংকারকে ৭টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- মাথার অলংকার, কানের অলংকার, নাকের অলংকার, গলার হার, হাতের অলংকার, পায়ের অলংকার, এবং কোমরের বিছা।
মাথার অলংকারঃ
মোগল আমলে নারীদের মাথায় এক ধরনের অলংকার প্রায়ই দেখা যেত, যার নাম ‘শীষফুল’। অলংকারটি ছিল গাঁদা ফুলের মতো ও ভেতরটা ফাঁপা। ‘মঙ্গ’ এবং ‘কোট বিলদার’ নামক আরো দুটি গহনা মাথার মাঝখানে সিঁথিতে পরত। যাকে আমাদের দেশে টিকলি বলে।
কানের অলংকারঃ
কানের গহনার মধ্যে অন্যতম হলো কানের দুল, কানফুল ও কুন্তিলা। রাজকীয় মহিলারা বড় বড় কানের দুল পরত, যা গলা পর্যন্ত লম্বা। কানের উপরের অংশে বাউলি ও নিচের প্রান্তে কুন্তিলা পরত। লাল গোলাপের চেয়ে ছোট এক ধরনের নাকফুল পরত, যার নাম চম্পাকলি। আরেকটি অতি মূল্যবান গহনা হল ভানোয়ার, যেটা দেখতে ময়ূর আকৃতির। এসব অলংকারের মধ্যে দামী দামী রুবি পাথর বসানো থাকতো।
নাকের অলংকারঃ
ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর অলংকারে মুসলমানরাই প্রথম নথ ও নাকফুলের প্রবর্তন করেন। প্রাচীন ভারতে কোন নাকের গহনা সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। মোঘল রাজকীয় নারীরা প্রথম নাকে লং পরত, যা লবঙ্গের আকৃতির মুক্তো বা স্বর্ণের নাকফুল। এছাড়া, বেসার, ফুলি, নথ ব্যবহার করত। বেসার হল- উপরের পাশে মুক্তা আর নিচে সোনার পাতের কীলক (সরু তারের মত)। নথ হল- একটি গোল রিংয়ের সাথে দুটি মুক্তাযুক্ত অলংকার।
গলার হারঃ
জেনানা মহলের নারীরা সাধারণত রত্ন, মুক্তা খচিত সোনা-রূপার গলার বড় বড় অলংকার পরিধান করত। গুলুবন্দ নামক গলার হারে ৫ থেকে ৭ টি গোলাপ ফুলের নকশা করা সোনার লকেট থাকতো। কোন কোন গলার হার তিন থেকে পাঁচ সারির লম্বা হত, যেখানে হীরা, পান্না, নীলকান্তমণি ইত্যাদি যুক্ত করা হত। এছাড়া, হার, হান্স সহ বহু মূল্যবান অলংকার ছিল।
হাতের অলংকারঃ
হাতের অলংকারের মধ্যে রয়েছে- বাজু, গজরা, জাওয়ে, চুড়ি এবং আংটি। চুড়ি হল বাজুর চেয়ে চিকন। অলংকার ছাড়া হাতকে অশুভ মনে করা হত। তাঁরা আঙ্গুলে বিভিন্ন ডিজাইনের আংটি পরত। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে গোলাকার আয়নার চারপাশে হীরা জহরৎ খচিত আরসী বা আয়না নামক আংটির প্রচলন করেন মোঘল সম্রাজ্ঞী।
পায়ের অলংকারঃ
আমরা মোঘল মহিলাদের পায়ের অলংকারের মধ্যে তিন ধরনের সোনার আংটির কথা পাই। গুলফ নামক গহনাটি স্বর্ণের তৈরী পায়েল বা নূপুরের মত। দ্বিতীয়টি হল ঘুঙুর। আনোয়াট নামে আরেকটি পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির অলংকার ছিল।
কোমরের বিছাঃ
তাঁরা কোমরে স্বর্ণের তৈরী ঘন্টা আকৃতির বিছা ব্যবহার করত। আবুল ফজল কটি মেখলা নামক একটি কোমর বন্ধনীর কথা বলেছেন।
উপরের সবগুলো অলংকার ছিল মূল্যবান রত্ন ও স্বর্ণখচিত। ঐসব গহনার কারিগরেরাও ছিলেন অসাধারণ দক্ষ ও দামী। আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, সম্রাজ্ঞী ও রাজকীয় নারীদের স্বর্ণালংকার ছিল যেমন মূল্যবান তেমনি কারিগরদের মজুরিও ছিল অনেক। যেমন- এক তোলা সোনার কাজের মজুরি ছিল দশতোলা সোনা। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান কিছু অলংকারের নতুন নকশাও তৈরী করেছিলেন।