বহুমূল্য রত্ন, হীরা, সোনা, মুক্তার তৈরি গয়না, আসবাব, পোশাক-পরিচ্ছদ যত্রতত্র এলোমেলো ছড়ানো, অটোমান হেরেমের প্রতিটি কোণায় রক্ত আর লাশের ছড়াছড়ি, সবচেয়ে দামি অথচ ছিন্ন ভিন্ন বেশভূষায় সজ্জিত এক পৌঢ় নারীর রক্তাক্ত শবদেহটাই আলাদা করে নজর কাড়ছে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ইনিই অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী সুলতানা, ওয়ালিদে কোসেম সুলতান। সম্ভবত পুরো অটোমান সাম্রাজ্যে তিনিই একমাত্র সুলতানা, যার জীবন এতটাই ঘটনাবহুল আর চ্যালেঞ্জিং ছিল যে, একটি লেখাতে কখনোই তা পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব নয়। কিন্ত কী এমন ঘটেছিল যে জীবনের ৬২তম বছরে এমন বীভৎসভাবে হত্যা করা হলো তাকে?

‘কিশোরী আনাস্তাসিয়ার অঙ্কিত ছবি। পরে তার নাম রাখা হয় কোসেম ম্যাহপেকার; Image Source: Artmajeur

১৬০৩ সাল। তোপকাপি প্রাসাদ, ইস্তাম্বুল। জলদস্যুরা গ্রিসের টিনোস দ্বীপ থেকে অপহরণ করে আনা কিছু দাসীদের তুলে দিলেন বসনিয়ার বেয়লারবের হাতে। তিনি উপহার হিসেবে তাদের রাজকীয় অটোমান হেরেমে পাঠান। ১৫ বছর বয়সী একটি ফুটফুটে মেয়েকে নিজের দাসী হিসেবে পছন্দ করলেন তখনকার সুলতান তৃতীয় মেহমেদের সুলতানা হানদান। “নাম কি তোমার?”-“আনাস্তাসিয়া”( গ্রিক অর্থঃ মৃত্যর পর পুনর্জন্ম)। হেরেমের প্রথা অনুযায়ী নির্বাচিত দাসীদের ব্যক্তিত্ব ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে নতুন নাম দেওয়া হতো। সম্ভবত গোলাকার মুখমণ্ডল এবং ফর্সা গায়ের রঙের অধিকারী হওয়ায় মেয়েটির নাম দেওয়া হলো “মাহপেকার”  যার তুর্কি অর্থ “চাঁদমুখ”।

বসফোরাস থেকে তোপকাপি প্রাসাদের দৃশ্য

ভেনিসিয় রাষ্ট্রদূত কন্তারিনির মতে, হানদান সুলতানের একমাত্র জীবিত শাহজাদা আহমেদের সমবয়সী ছিলো মাহপেকার এবং তাকে মায়ের সেবারত দাসীদের মধ্যে দেখে আহমেদ মাহপেকারের প্রেমে পড়ে যান। ঘটনা জানতে পেরে মাহপেকারকে পিটিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন হানদান সুলতান। কিছুদিন পর সুলতান তৃতীয় মেহমেদ (রাজত্ব: ১৫৯৫-১৬০৩ সাল) মারা গেলে শাহজাদা আহমেদের সুলতান (রাজত্ব:১৬০৩-১৬১৭ সাল) হিসেবে অভিষেকের সময় মাহপেকারকে আবারও রাজকীয় হেরেমে আনা হয় এবং তাদের পুরানো প্রেম পূর্ণতা পায়। ইতালিয় পর্যটক পিয়েত্রো দেলা ভালে বলেন, দ্রুতই সুলতান আহমেদের প্রিয় হয়ে ওঠায় এবং হেরেমের অন্য দাসীদের ছাড়িয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে পারায় মাহপেকার নিজের  নাম পরিবর্তন করে রাখে “কোসেম”, যার তুর্কি অর্থ “দলের নেতা”। অন্য সূত্র মতে, সুলতান আহমেদ নিজেই মাহপেকারের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বগুণ দেখে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার সময় তাকে “কোসেম” নামকরণ করেন।

তৃতীয় মুহাম্মদ

কোসেমের উত্থানের পথ মোটেও সহজ ছিল না। তবে ১৬০৪ সালে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতি করায় সুলতান আহমেদের দাদি প্রাক্তন ওয়ালিদে সাফিয়ে সুলতানের পুরানো প্রাসাদে নির্বাসন ও ১৬০৫ সালে নতুন ওয়ালিদে হানদান সুলতানের আকস্মিক মৃত্যু হেরেমে কোসেমের জন্য শাপে বর হয়ে দেখা দেয়। শীঘ্রই কোসেম প্রধান হাসেকি হয়ে ওঠেন এমনকি হাসেকি হুররাম সুলতানের পর তিনিই প্রথম সাম্রাজ্যের সুলতানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি একে একে সুলতান আহমেদের সম্ভবত ১২ জন বা ৯ জন সন্তানের জন্ম দেন। তাদের মধ্যে শাহজাদাই ছিল ৬-৭ জন। কোসেম সুলতানের এক অভূতপূর্ব দয়ার দৃষ্টান্ত হলো, তিনি সুলতানকে বহুবার অনুরোধ করে ভ্রাতৃহত্যার নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ করেন। এর ফলে সাময়িকভাবে নিজের সন্তানদের এবং আহমেদের বৈমাত্রেয় ভাই মুস্তাফার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও পরে তা কি আদৌ ফলপ্রসূ হয়েছিল? আস্তে আস্তে আমরা তা জানব।

সাফিয়ে সুলতান

হাসেকি হিসেবে তিনি দৈনিক ১০০০ অ্যাসপার অর্থাৎ রৌপ্যমুদ্রা পেতেন। তিনি রাজনৈতিক প্রয়োজনে নিজের শাহজাদিদেরকে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের সাথে বিয়ে দিতেন। যতদিন সুলতান আহমেদ বেঁচে ছিলেন ততোদিন কোসেমের সাথে তার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে ভেনিসিয় রাষ্ট্রদূত কন্তারিনি বলেন, “কোসেম সুলতান সৌন্দর্য, চাতুর্য, বুদ্ধিমত্তা ও নানারকম গুণের অধিকারী একজন নারী…তিনি দারুণ গান গাইতে পারেন এবং সুলতান তাকে খুবই ভালোবাসেন…সবাই তাকে সম্মান করে শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রেই তার পরামর্শ মানা হয়। তিনি সুলতানের সবচেয়ে প্রিয় এবং তাকে সুলতান সবসময় নিজের পাশে চান।” ১৬১২ সালে কন্তারিনি আরও বলেন, কোসেমকে বিরক্ত করায় সম্ভবত শাহজাদা ওসমানের মা মাহফিরুজকে প্রহার করার আদেশ দেন সুলতান। তবে সুলতানের ওপর কোসেমের প্রভাব দিন দিন বাড়তে থাকায় একসময় সুলতান সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোসেমের মতামত নেয়া বন্ধ করে দেন।

শাহজাদা ওসমান

সুলতান আহমেদের শাসনামল রাজনৈতিকভাবে খুব একটা উল্লেখযোগ্য না হলেও সাম্রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল। ২২ নভেম্বর,১৬১৭ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে টাইফাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সুলতান আহমেদের মৃত্যু হয়। কে পরবর্তী সুলতান হবে তা নিয়ে মতবিরোধের মধ্যেই কোসেম সুলতান এবং প্রাদেশিক মন্ত্রীরা সুলতান আহমেদের বৈমাত্রেয় ভাই মুস্তাফাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে। মূলত এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোসেমের দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভ্রাতৃহত্যা বন্ধের নিয়ম অনুসারে বয়সে বড় এবং যোগ্য শাহজাদাই সিংহাসন পাবে বলে উল্লেখ ছিল। আর কোসেম জানত যে শাহজাদা মুস্তাফা (১ম রাজত্বঃ ২২নভেম্বর,১৬১৭- ২৬ফেব্রুয়ারি,১৬১৮) মানসিক ভারসাম্যহীন সুতরাং অচিরেই নিয়মানুযায়ী শাহজাদা ওসমান সিংহাসন পাবে। সৎ ছেলে হলেও ওসমানকে কোসেম খুবই ভালবাসতেন তাই এরূপ সিদ্ধান্ত নেন।

মুস্তাফা

মাত্র ৯৬ দিনের মাথায় জেনিচেরিরা সুলতান মুস্তাফাকে উচ্ছেদ করে ১৪ বছর বয়সী শাহজাদা ওসমানকে (রাজত্বঃ ২৬ ফেব্রুয়ারি,১৬১৮ -২০মে,১৬২২ সাল) সুলতান ঘোষণা করে। কিন্তু কোসেম রক্তপাত চাননি, এছাড়াও কোসেমের শাহজাদারা ছোট থাকায় ওসমানের কিছু হলেও যেন সাম্রাজ্য এবং ক্ষমতা টিকে থাকে তাই মুস্তাফাকে জীবিত রাখা হয়। একজন যোগ্য সুলতান হলেও অপরিণত বয়সী সুলতান দ্বিতীয় ওসমান কোসেম সুলতানকে নিজের সার্বভৌম ক্ষমতার হুমকি মনে করে পুরানো প্রাসাদে নির্বাসন দেন। কিন্ত কোসেম সুলতানকে ওসমান নিজেও ভালোবাসতেন, তাই সপ্তাহে তিন দিন পুরানো প্রাসাদে গিয়ে দেখা করে আসতেন। তবে সুলতানের নিজের মা আগেই মারা যাওয়ায় হেরেমে একজন শক্তিশালী ওয়ালিদে সুলতানের প্রকট অভাব দেখা দেয়। ওসমান খুব সাহসী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী সুলতান ছিলেন।

জেনিসারি

তার সৎ ভাই কোসেমের ছেলে মেহমেদের প্রতি জেনিচেরিদের অর্থাৎ সেনাবাহিনীর তুলনামূলক বেশি আনুগত্য থাকায় ১২জানুয়ারি, ১৬২১ সালে ভ্রাতৃহত্যা আইন ভঙ্গ করে মেহমেদকে হত্যা করেন। হয়তো এই পাপের জন্যই এরপরই ইস্তাম্বুলে রেকর্ড পরিমাণ তুষারপাতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে আসে বলে মনে করা হয়। ফলে তিনি জেনিচেরি এবং কোসেম সুলতানের সমর্থন পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেন। এরপর হজে যাওয়ার নাম করে জেনিচেরিদের বদলে নতুন সৈন্যবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য জানতে পেরে জেনিচেরিরা সম্পূর্ণরূপে ক্ষেপে যায়। এদিকে শাহজাদা মুস্তাফার মা হালিমে সুলতান নিজের পাগল ছেলেকে আবারও ক্ষমতায় বসানোর জন্য  ষড়যন্ত্র করে কোসেমের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয় কিন্তু কোসেমের ওসমানকে কোনোরকম ক্ষতি না করার শর্ত অমান্য করে ওসমানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তার কান কেটে নেয়। অটোমান সাম্রাজ্যে এই প্রথম এবং শেষ কোনো সুলতানের মৃত্যু এমন বীভৎস ভাবে হয়।

(২য় রাজত্ব: ২০ মে,১৬২২-১০ সেপ্টেম্বর,১৬২৩) শাহজাদা পাগল মুস্তাফা নামেমাত্র সুলতান হিসেবে আবার ক্ষমতা ফিরে পান। আসলে তার হয়ে তার মা হালিমে সুলতানই সাম্রাজ্য চালাতেন। তিনি কোসেম সুলতানের অনুগত সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে ক্ষমতা দখল করার পর কোসেমের সকল শর্ত আবারও অমান্য করেন। অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেন। ফলে সাম্রাজ্য অপশাসনে জর্জরিত হয়ে যায়।

এবার কোসেম নিজের সন্তানদের অধিকার আদায়ের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। তার আদেশে জেনিচেরিরা আবার সুলতান মুস্তাফাকে উচ্ছেদ করে এবং ১১ বছর বয়সী কোসেমের শাহজাদা মুরাদকে (রাজত্বঃ ১৬২৩-১৬৪০ সাল) সিংহাসনে বসায়। তিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় দীর্ঘদিন তার মা কোসেম সুলতান শুধুমাত্র ওয়ালিদে সুলতানই ছিলেন না বরং সাম্রাজ্যের নায়েব হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন (১০ সেপ্টেম্বর,১৬২৩-১৮মে,১৬৩২)। তিনি দিভান বা রাজসভায় পর্দার আড়ালে থেকে দীর্ঘ ৯ বছর শাসন করেন। যা অটোমান ইতিহাসে প্রথম। তবে ১৬৩২ সালে সুলতান চতুর্থ মুরাদ তার মায়ের নায়েবের পদ কেড়ে নিয়ে নিজের শাসন শুরু করেন। তিনি সুলতানের পুরানো স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনেন। পূর্ববর্তী সুলতানদের দুর্বল শাসনকালে রাজ্যজুড়ে তৈরি হওয়া দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে সাম্রাজ্যে কঠোরতম আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব শুরু করেন। তার শাসনামল অটোমান-সাফাভিদ যুদ্ধ এবং এর ফলে ককেশাসের বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করে। যা বর্তমানের তুর্কি, ইরান, ইরাক সীমান্ত রেখার সূচনা করে। সুলতান সুলেমানের স্বর্ণযুগের দীর্ঘদিন পর সুলতান চতুর্থ মুরাদের নেতৃত্বেই অটোমানরা আজারবাইজান, তাবরিজ, হামাদান, বাগদাদ ও অন্যান্য অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে বিজয়ের স্বাদ পায়। এমনকি মোগল সাম্রাজ্যের সাথেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল।

চতুর্থ মুরাদ

তিনি “মুরাদি” ছদ্মনামে বহু কবিতাও লিখেছিলেন। এসব শুনে সুলতান মুরাদকে একজন সফল ও সুখী শাসক মনে হলেও বাস্তবে তার প্রত্যেক শাহজাদা জন্মের কিছুদিন পরই মারা যায়। ফলে তার কয়েকজন শাহজাদী ছাড়া কোনো বংশধর ছিলো না। তার সাম্রাজ্যের শেষ সময়ে বেশকিছু বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ দেখা দিলে তার ভাই মৃত সুলতান ওসমানের মতো পরিণতি চিন্তা করে নিজের একচ্ছত্র শক্তি পাকাপোক্ত করতে সাম্রাজ্যে আবারও কঠোর আইন প্রনয়ণ করেন। তিনি নিজ সিংহাসন হারানোর ভয়ে আপন ভাইদের হত্যা করতে থাকেন। কোসেম অনেক কষ্টে একমাত্র জীবিত শাহজাদা ইব্রাহিমের মানসিক ভারসাম্যহীনতার কথা বলে প্রাণে বাঁচান। রাজ্যজুড়ে অনেক নিষ্ঠুরতার পর অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মাত্র ২৭ বছর বয়সে সম্ভবত লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে সুলতান চতুর্থ মুরাদ মারা যান। আবার অনেক ইতিহাসবিদের মতে, কোসেম সুলতান বিষ প্রয়োগ করে নিজপুত্র মুরাদকে হত্যা করেন।

তারপর ১৬৪০ সালে কোসেম নতুন সুলতান প্রথম ইব্রাহিমের মাধ্যমে আবার একচ্ছত্র ক্ষমতা ফিরে পান। দীর্ঘদিন নিজ ভাইয়ের হাতে মৃত্যুর আশংকায় মানসিক ভারসাম্য হারানো ইব্রাহিমকে কোসেম সুলতান শাসনকাজ থেকে দূরে রাখতে হেরেমের মহিলাদের সাথে অধিকাংশ সময় কাটাতে বাধ্য করেন। এই সময় হেরেমের জৌলুস বিলাসবহুল সুগন্ধি, পোশাক, গয়নায় নতুন মাত্রা লাভ করে। তার পশম আর মহিলাদের প্রতি প্রবল আসক্তি থাকায় একটি কক্ষ সম্পূর্ণ লিনক্স এবং সেবলের চামড়া দিয়ে ঢেকে ফেলেন। ১৬৪৭ সালে কোসেম সুলতান, উজিরে আজম সালিহ পাশা, শেইখ উল ইসলাম আব্দুররাহিম এফেন্দি মানসিক ভারসাম্যহীন সুলতান ইব্রাহিমকে সরানোর ফন্দি আঁটেন। কিন্তু পরিকল্পনা ধরা পড়ায় কোসেমকে হেরেম থেকে নির্বাসিত করা হয় আর উজিরে আজমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরের বছর জেনিচেরি আর উলামারা বিদ্রোহ করে কোসেমের সাথে পরামর্শ করে ইব্রাহীমকে আটক করে। নতুন উজিরে আজম  শেইখ উল ইসলামের ফতোয়া নিয়ে আসা হয় এই বলে যে, “দুইজন শাসক থাকলে একজনকে মেরে ফেলো”। কোসেম তাতে সায় দেয়। ১৮ আগস্ট,১৬৪৮ সালে সুলতান ইব্রাহিমের ফাঁসি দেওয়া হয়।

ইব্রাহিম

তারপর কোসেম তার সাত বছর বয়সী নাতি ইব্রাহিমের ছেলে চতুর্থ মেহমেদকে সামনে আনেন দিভানে, বলেন, “এই যে সে, দেখা যাক তোমরা তার সাথে কি করো!” তৃতীয় বারের মত নিজেকে শাসক ঘোষনা করে অটোমানদের “ডি ফ্যাক্টো” শাসক হন কোসেম সুলতান (১৬৪৮ থেকে ১৬৫১ সালের মধ্যে)। সুলতান চতুর্থ মেহমেদের মা তুরহানের সাথে কোসেমের বনিবনা না হওয়ায় কোসেম মেহমেদকে হালুয়ায় বিষ দিয়ে হত্যাচেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারপর মেহমেদ ও তুরহানকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করলে কোসেমের দাসী মেলেকি হাতুন কোসেমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তুরহানকে বলে দেয়। এবার তুরহানের প্রতিশোধ নেয়ার পালা।

১৭৬৮ সালে একজন জেনিসারি আগা।

২ সেপ্টেম্বর, ১৬৫১ সাল। রাতের অন্ধকারে তুরহান সুলতানের আদেশে লালা সুলেয়মান আগার নেতৃত্বে একটি বিশাল দল কোসেমের বাসভবনে যায়। সেখানে পাহারারত ৩০০ জন প্রহরীকে হত্যা করে ঘাতকের দল কোসেমের কামরায় যায়। কোসেম ঘাতকদের গলা চিনতে পেরে দেরি না করে কামরার পেছন দিকের “সোনালি রাস্তা” দিয়ে পালিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার আগের দরজায় পৌঁছান। কিন্তু তুরহান আগেই অনুমান করতে পেরে পালানোর সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়। নিরুপায় কোসেম দরজার আগের কামরার এক আলমারিতে লুকান।

এদিকে কোসেম কে খুঁজতে যাওয়ার পথে কোসেমের এক বিশ্বস্ত দাসী নিজেকে কোসেম বলে দাবি করে। কিন্তু ঘাতকরা বিশ্বাস না করে দাসীকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কোসেমের প্রত্যেকটা দাস দাসীকে হত্যা করে ঘোড়ার গাড়িতে যাওয়ার আগের কামরায় প্রত্যেকটা আলমারি খুঁজতে খুঁজতে কুচুক মেহমেদ পাশা কোসেমের লম্বা বেনি ধরে টেনে বের করে এবং পেটাতে থাকে। কোসেম তাদের লক্ষ্যচ্যুত করার জন্য মেঝেতে স্বর্ণমুদ্রা ছড়িয়ে দিলেও কাজ হয় না। সেই ঘটনা সম্পর্কে ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ, ঐতিহাসিক এবং অটোমান গবেষক পল রয়কাট বলেন, “আলবেনিয়ান বোস্তানজি আলি কোসেমের কানের বহুমূল্য দুলগুলো ছিঁড়ে নেয়, যেগুলোতে বাদামের আকৃতির বড় দুটি হীরার নিচে লাল রুবি পাথর বসানো ছিল।কানের দুলগুলো সুলতান আহমেদ কোসেমকে যৌবনের সুখময় সময়ে উপহার দিয়েছিলেন। তার সারা পোশাকে বসানো বহুমূল্য সব রত্ন খুলে নিতে থাকে সবাই, বিশেষ করে পোশাকে লাগানো সেবলের চামড়া। কেউ কেউ তার জামা ছিঁড়ে ফেলে।”

ছাড়া পাওয়ার জন্য চিৎকার করতে থাকায় লালা সুলেমান আগা পর্দার রশি ছিঁড়ে অথবা কোসেমের নিজের লম্বা বেনি দিয়ে গলায় ফাঁস দেয়। কোসেমকে এত বেশি কষ্ট দেওয়া হয় যে তার কান ও নাক দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে খুনিদের কাপড়ে লেগে যায়। প্রত্যেক ঐতিহাসিক একমত যে, কোসেম নিজের জীবন বাঁচানোর খুব চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি প্রথমবার ফাঁস লাগানোর পরেও তিনি বেঁচে ছিলেন। তিনি ২,৭০০ শাল বা পশমি চাদর, ২০ সিন্দুক সোনা, এবং দয়া ও ক্ষমার সম্মান রেখে যান। গুপ্তঘাতকরা তার গয়নার আধার লুট করে।

অটোমান ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী, সকলের শ্রদ্ধার পাত্রী, অসামান্য সম্ভ্রমের অধিকারী এই সুলতানার মৃত্যুতে সাম্রাজ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। তার নৃশংস মৃত্যুর খবর শুনে ইস্তানবুলের জনগণ তাৎক্ষণিক তিন দিনের জন্য সব মসজিদ ও বাজার বন্ধ করে দেয়। কোসেমকে খুন করার পর তার বিশ্বস্ত জেনিচেরিদের ও সুলতান চতুর্থ মেহমেদের শাসনামলে কোসেমের সাহায্যকারী সবাইকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়।

প্রথম আহমেদ

এভাবেই শেষ হয়ে যায় পরাক্রমশালী সুলতানা কোসেমের জীবন। ইস্তানবুলের সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মসজিদে স্বামী সুলতান আহমেদ ও বড় মেয়ে আয়শের কবরের মাঝখানে কোসেম সুলতানের কবরের শিলালিপিতে উৎকীর্ণ আছে তার জীবনের সকল উপাধি- “ওয়ালিদে-ই-মুয়াজ্জামা” (মহৎ মা), “কোচা-ওয়ালিদে”, “উম্মুল-মুমিনিন”, “ওয়ালিদে-ই-আতিকা”, “ওয়ালিদে-ই-কেবিরে”, “বুয়ুক-ওয়ালিদে”, “সাহিবেতুল-মাকাম”। এছাড়াও মৃত্যুর পর তার উপাধি হয় “ওয়ালিদে-ই-মাকতুল”(হত্যাকৃত মা) ও “ওয়ালিদে-ই-শহীদে” (শহীদ মা)। বাস্তব দুনিয়া থেকে কোসেম সুলতান চিরতরে হারিয়ে গেলেও তার সৎগুণ আর মহৎ কাজগুলো টিকে রয়েছে আজও। ইস্তাম্বুলের “ওয়ালিদে হান” মসজিদ, “চিনলি” মসজিদ, রাস্তা থেকে অনাথ মেয়েদের তুলে এনে সুন্দর জীবন দেয়ার জন্য তৈরি করা আশ্রম, সব রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ বেতন পেয়েও তিনি অধিকাংশই ব্যয় করেছেন দাতব্যকাজে। তিনি ৩ বছর সেবার পর দাস-দাসী মুক্ত করে দিতেন। তিনি মনে করতেন, যার অবস্থান প্রতিষ্ঠানে যত গুরুত্বপূর্ণ, সেরকমই মজুরি দেয়া উচিত। ১ ডলারে যেন কেউ ৭৭ সেন্ট না পায়।

কোসেম সুলতানের হত্যাকান্ড; Image Source: vestiturkey.com

কোসেমকে অনেকে বলে ক্ষমতালোভী, কথাটি তার জীবনের শেষ পর্যায়ে আলোকপাত করলে আংশিক সত্য। কিন্তু সাম্রাজ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ শাসক কোসেম সুলতান, ৬ জন সুলতানের রাজসভাসদ, তিনি না থাকলে, ভ্রাতৃহত্যা বন্ধ না করলে আহমেদের শাসনকালেই হয়তো অটোমানরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত, নিঃসন্তান মুরাদকে না থামালেও হয়তো অটোমানদের অস্তিত্ব থাকত না। তিনি একজন সুলতানের চেয়েও বেশি অবদান রেখেছেন অটোমানদের সংকটকালে। তার সমসাময়িককালে ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে রানিই ছিল তাদের প্রধান। কিন্তু অটোমানদের সুলতান নির্বাচনের পদ্ধতি ব্রিটিশদের মতো- ছেলে হোক মেয়ে হোক, বয়সে বড় সন্তানই সিংহাসনে বসবে, এমন হলে হয়তো রক্তপাত কমতো। যাই হোক, হুররাম সুলতানের যোগ্য উত্তরসূরী কোসেম সুলতানের এই মৃত্যু প্রাপ্য নয়। তাই মৃত্যুর প্রায় ৪০০ বছর পর আজও কোসেমকে নিয়ে গবেষণা হয়, নাটক- সিনেমা বানানো হয়, আমরা জানি, বুঝি, তার জীবন এবং জীবনের ভালো দিকগুলো থেকে শেখার চেষ্টা করি।