বর্তমান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার গুলোর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হচ্ছে লেডি অফ কাওয়ের মমি। তিনি মোচে সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ মহিলা ছিলেন। মোচে সভ্যতা ছিল ইনকা সভ্যতার আগের স্তর। মোচেদের লিখিত ভাষা না থাকাতে এই সভ্যতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তেমন বিশদ কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ রেগুলো ফ্রাঙ্কো ২০০৬ সালে লেডি অফ কাওয়ের একটি সমাধি আবিষ্কার করেন। যার মাধ্যমে মোচে সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুটা হলেও আমরা ধারণা পাই। পেরুর উত্তর উপকূল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে ব্রুজ কমপ্লেক্সে এই মন্দিরটি অবস্থিত। সেখানে প্রায় ১৭০০ বছর ধরে এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন মহিলা চিরনিদ্রায় শুয়ে ছিলেন। হয়তো এত বছর ধরে কেউ তাকে জাগাতে সাহস পায়নি।
লেডি অফ কাও অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত, উচ্চ বংশীয় মহিলা ছিলেন। অফুরন্ত ব্যক্তিগত সম্পদ, গয়নাগাটি সমেতই তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। বিশাল আকৃতির ছিল তার সমাধি কক্ষটি। প্রায় ৩০০০ বর্গফুটের মত। মোচেরা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পরবর্তীতে সুন্দর একটা জীবন আছে। সেই জীবনে চলার জন্য প্রয়োজনীয় দুইজন দেহরক্ষী, দুইজন পুরোহিত এবং একটি কিশোরী মেয়েকেও তার সাথে সমাধিস্থ করা হয়েছিল । ঐ পাঁচজন মানুষও অনন্তের পথে রওনা দিয়েছিল তার সাথে।

The Lady of Cao mummy at the El Brujo complex © SCREENGRAB/EL BRUJO
সমাধিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। প্রায় ২৩ টি বর্শা এবং দুটো যুদ্ধ ক্লাব ও অসম্ভব বড় একটি হেড ড্রেস। ঐ ক্লাবগুলো শুধু মাত্র রাষ্ট্রনায়কই ব্যবহার করতে পারতো। আর অসীম ক্ষমতাধর কেউ না হলে হেড ড্রেস পরার অনুমতি ছিল না। তার সমাধিস্থলে এই দুইয়ের উপস্থিতি তার ক্ষমতার ও শক্তির পরিচায়ক। তার অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার সময় ব্যবহৃত ২৫ স্তরের কাপড়গুলো সরিয়ে যখন একটু একটু করে মমিটির পরিচয় খোঁজার চেষ্টা হচ্ছিল তখন সেখানে এই নারী মূর্তির উপস্থিতি প্রত্নতত্ত্ববিদদের চমকে দিয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণাই ছিলনা যে ঐ স্থানে পুরুষদেরকে ছাড়া কোন নারীকে সমাহিত করা হতে পারে। রমণীর শরীর এবং হাতে নিখুঁতভাবে ট্যাটু বা উলকি আঁকা ছিল। ধর্মযাজকদের শরীরে এই ধরনের সাপের ছবি আঁকা হত। ধর্মযাজকরা ছিল সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত এক ব্যক্তি। রোগ নিরাময়ে দক্ষ এই মানুষ গুলোকে দেবতার মত সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হতো। তাছাড়াও সমাধিতে যুদ্ধের ক্লাবগুলো থেকে আরো বোঝা যায় যে তিনি শুধুমাত্র ধর্মযাজকই ছিলেন না, এই উপত্যকাকে তিনি শাসনও করেছিলেন।
ফরেনসিক পরীক্ষার থেকে জানা গেল মহিলাটির বয়স ছিল ২৫ এর কাছাকাছি। প্রসবকালীন যন্ত্রনা বা গর্ভকালীন জটিলতা থেকে তার মৃত্যু হয়েছিল। লেডি অফ কাওয়ের এই মমির আবিষ্কার পেরুর ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই আবিষ্কার মোচেদের সাংস্কৃতিক বিভিন্ন দিক ও কাঠামো সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অন্তদৃষ্টি খুলে দেয়। একসময় ভাবা হতো শুধুমাত্র পুরুষরাই ঐ সমাজে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পালন করতো। এটি ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কিন্তু এই নারীদেহ পেরুর সংস্কৃতিতে মহিলারাও যে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল তার প্রমাণ বহন করে। তাদের সমাজে এই উচ্চ পদস্থ নারীর উপস্থিতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনেক নারীকে আরো শক্তিশালী হতে উৎসাহিত করে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কঙ্কালের সাহায্য তার চেহারাটি কেমন ছিল সেটিও তৈরি করে ফেলতে পেরেছেন। মোচেদের দেওয়াল চিত্র, সিরামিকের পাত্র, মৃৎ পাত্র ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে একদিকে যেমন তাদের হিংস্রতার ছবি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, সেই সাথে সাথে তারা যে জীবনকে উপভোগ করতো তারও বহু নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনন্দঘন জীবনই তারা কাটিয়েছিল। তাদের মধ্যে যেমন বলিদানের প্রথাও ছিল, সেই সাথে প্রকৃতির নানা উপাদান সংগ্রহ করে জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও দেখা গিয়েছে । জীবন এবং মৃত্যু দুটোই তাদের কাছে সমান মূল্যবান ছিল। মূর্তি তৈরি, ধাতু , মৃৎ শিল্পে তাদের অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় আমরা আগেই জেনেছি। এ নারীর মমি আমাদের বুঝতে সাহায্য করলো মোচেরা শুধুমাত্র পুরুষ শাসিত সমাজ ছিল না। তাদের সমাজে শক্তিশালী নারী চরিত্রও ছিল।

লেডি অফ কাওয়ের মমি © Cao Site Museum, La Libertad