একটি দেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন ঐ দেশের অমূল্য সম্পদ, জাতিগত ঐতিহ্যের অংশ, এবং জাতীয় গর্ব। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এমন অনেক মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যা’ বহন করছে আমাদের শত শত বছরের পূর্বপুরুষদের পরিচয়, তাদের ঐতিহ্য, এবং জাতির বিবর্তিত ইতিহাস। এমনি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কথা বলবো আজ।

সম্প্রতি আল জাজিরা টেলিভিশন এবং বাংলাদেশের টিভি সহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে লালমনিরহাটে। এলাকার লোকজন মসজিদের নাম দিয়েছে “হারানো মসজিদ”। মসজিদ থেকে পাওয়া পোড়ানো মাটির টেরাকোটাতে আরবীতে লেখা ৬৯ হিজরি লেখা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এটি সম্ভবত নির্মাণ করা হয়েছিল ৬৯১ সালে। মসজিদটির সঠিক নির্মাণকাল নিশ্চিত হতে হলে আমাদেরকে সন-তারিখ নিয়ে আরেকটু গভীরভাবে নেড়েচেড়ে দেখতে হবে।

ইতিহাস বলে, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে মুসলমানরা প্রথম এদেশে এসেছে ১২০৪ সালে, এবং তারপর থেকেই মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করা শুরু হয় বাংলাদেশে। যদি তাই-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশে প্রথম নির্মিত মসজিদ ৬৯১ সালে বলে যে ধারণা করা হচ্ছে, তা হয়তো সঠিক নয়। বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রথম মসজিদ নির্মাণ নিয়ে রয়েছে কোথাও এক ঐতিহাসিক ফাঁক। এই নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের মধ্যেও রয়েছে নানা মতভেদ। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, লালমনিরহাটের হারানো মসজিদটি ৬৯১ সালেই নির্মাণ হয়েছিল, তাহলে পেছনের ৫০০ বছরের ইতিহাস আবার নতুন করে লিখতে হবে।

আমরা বাণিজ্যের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব যে, ভারতীয় উপহাদেশের সাথে রোমান ও আরবদের যোগাযোগ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার দজলা ও ফোরাত নদীর মতো বাংলার ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা নদীর অববাহিকা পৃথিবীর প্রাচীনতম অববাহিকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। রোমান ও গ্রীক ইতিহাসবিদদের লেখায় সেকথাই সুস্পষ্ট। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকটি চলমান গবেষণায় উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকা ছিল প্রাচীন আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের নৌপথ। বাংলাদেশের এসব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জলপথ বলে দেয় অনেক ঐতিহাসিক প্রশ্নের উত্তর।

বাংলাদেশে মুসলমানদের প্রথম আগমন কখন ঘটেছে, সে বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকলেও, এ কথা সত্য যে চট্টগ্রামের জলপথে ইসলামের সুফি-সাধক ও মুসলিম বণিকরা বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের আগেই বাংলাদেশে এসেছিলেন। আর মুসলমানরা স্থলপথে আসে গৌড়-পান্ডুয়া হয়ে উত্তরবঙ্গে বরেন্দ্র এলাকাতে। এটা প্রমাণিত যে, চট্টগ্রাম পথ দিয়ে বহু মুসলিম সুফি ধর্মপ্রচারক অষ্টম থেকে দশম শতকের মধ্যেই বাংলাদেশে এসেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে চট্টগ্রামে বায়েজিদ বোস্তামি (মৃত্যু ৮৭৪ সাল), বগুড়ার মহাস্থানগড়ে সুলতান মাহি সওয়ার (১০৪৭ সালে আসেন) এবং নেত্রকোনায় মুহাম্মদ সুলতান রুমিসহ (১০৫৩ সালে আসেন) আরো অনেক সুফিদের কথা, যারা এ পথেই বাংলাদেশে এসেছিলেন। আরব বণিকরা আরব সাগর হয়ে ভারত মহাসাগর, তারপর বঙ্গোপসাগর দিয়ে যাতায়াত করতো আরো প্রাচীনকাল থেকেই। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, বাংলার এ বাণিজ্য পথ তাদের চেনা বহু আগে থেকেই। এখন প্রশ্ন হলো, এসব মুসলমানরা কি এ বাণিজ্য পথে আশা-যাওয়ার সময় বাংলায় কোন মসজিদ নির্মাণ করে নি?

বলা হয়, ভারতবর্ষে মুসলিমরা প্রথম পা ফেলে দক্ষিণ ভারতের কেরালায়। তখন কেরালার রাজা ছিলেন চেরুমন পেরুমল। মালিক বিন দিনার নামে এক মুসলিম বণিক রাজার অনুমতি নিয়ে ৬২৯ সালে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এটি বর্তমানে “চেরুমন জুমা মসজিদ” নামে পরিচিত। আরো জানা যায়, কেরালার রাজা চেরুমন পেরুমল পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। অন্যদিকে, পাকিস্থানের সিন্ধু প্রদেশে আরব সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম ৭১১ সালে রাজা দাহিরকে পরাজিত করে দেবল বন্দর জয় করেন। সিন্ধুর কাছে ভাম্বোর নামক স্থানে একটি প্রাচীন মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়, যার শিলালিপিতে ৭২৭ সাল লেখা রয়েছে। বলা হচ্ছে, লালমনিরহাটে ৬৯১ সালেই প্রথম এই হারানো মসজিদটি নির্মাণ করা হয় l আমরা আরো জানি, মহাস্থানগড়ে বাগদাদের খলিফাদের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিলো। পাল আমলে আরবের সাথে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল গভীর। এসব ঐতিহাসিক বর্ণনা বলে দিচ্ছে, ৬৯১ সালে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে এ মসজিদটি নির্মাণ করা অস্বাভাবিক নয়। কি ভাবে পাওয়া গেলো এ মসজিদটি?

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটের রামদাস গ্রামে এই হারানো মসজিদটি ১৯৮৬ সালের দিকে প্রথম পাওয়া যায়। এটি প্রায় সাড়ে তেরশ বছর আগের একটি প্রাচীন স্থাপনা। এ মসজিদটি তিস্তা নদীর কাছে অবস্থিত। অনেকদিন ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা এলাকার কিছু জমি স্থানীয় লোকজন চাষাবাদের জন্য পরিষ্কার করতে গেলে পুরনো ইটের দেয়াল বেরিয়ে আসে। জায়গাটি আরো গভীরভাবে খোঁড়া শুরু হলে, সেখানে প্রাচীনকালের তৈরি প্রচুর ইট পাওয়া যেতে থাকে। অনেক ইটের গায়ে ছিলো ফুলের নকশা আঁকানো কারুকাজ। প্রথমে লোকজন ধারণা করেছিল যে, এটি কোনো পুরনো জমিদার বা রাজার বাড়ি হবে হয়তো। তারপরে যে যার মতো দেয়ালের গাঁথুনি ভেঙ্গে ইটগুলো নিয়ে নিজেদের বাড়িঘরের কাজে লাগিয়ে দিলো। কিন্তু আইয়ুব আলী নামের এক ব্যক্তি দেখতে পান কয়েকটি ইটের উপর কিছু একটা লেখা। কিছু ইট পানিতে ভালোমতো ধুয়ে দেখতে পান একটিতে আরবীতে লেখা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ এবং হিজরি সন ৬৯। এরপর স্থানীয় লোকেরা মনে করেন, এটা কোন হারানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। পরে আরো খনন কাজ চালিয়ে মসজিদের মেহরাব, মসজিদ সংলগ্ন ঈদগাহ, খুৎবা দেয়ার মিম্বার আবিষ্কার করা হয়। তারপর থেকে সেখানকার লোকজন মসজিদের আঙিনায় টিন দিয়ে সাদামাটা একটি মসজিদ তৈরি করে প্রতিদিনের নামায আদায় করে আসছেন। তারা মসজিদটির নাম দিয়েছেন ‘হারানো মসজিদ’। উত্তরাধিকারসূত্রে জায়গাটির মালিক ছিলেন নবাব আলী। পরে তিনি জায়গাটি হারানো মসজিদের নামে ওয়াকফ করে দেন। কিন্তু তারপর এ বিষয়ে তেমন কিছু আর জানা যায় নি।

অনেক বছর পর শৌখিন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক টিম স্টিল বাংলাদেশে কাজের সূত্রে বিভিন্ন মানুষের কাছে মসজিদটির কথা শুনে লালমনিরহাটে যান। তার মনে প্রশ্ন জাগে, ৬৯১ সালে কে বা কারা এই মসজিদটি তৈরি করেছিল? অনেক ইতিহাসবিদ সন্দেহ পোষণ করেন যে, হয়ত এই মসজিদটি এত প্রাচীন নয়। টিম স্টিল পরে যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজিষ্টের সাহায্যে গবেষণা করে প্রমাণ করেন যে, এটি আসলেই ৬৯১ সালে তৈরি একটি প্রাচীন মসজিদ, এবং মসজিদটির শিলালিপিতে স্পষ্ট করে হিজরি সন ৬৯ লেখা আছে। শিলালিপিটি বর্তমানে তাজহাট জমিদার বাড়ি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এ বিষয়ে আল জাজিরা টেলিভিশনে টিম স্টিল বলেন, চীনের কোয়াংটা নদীর ধারে কোয়াংটা শহরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর একজন সাহাবী আবু ওয়াক্কাছ (রা:) -এর তৈরি মসজিদ ও সমাধি রয়েছে। হতে পারে বাংলাদেশের এই হারানো মসজিদটি সাহাবী আবু ওয়াক্কাছ (রা:)-এর, অথবা, তার সমসাময়িক অন্য কোন সাহাবী তৈরি করেছিলেন। কারণ, বাংলার এ এলাকার নদী পথ ধরেই তখন চীনে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল সবার।

আমরা জানি যে, প্রাচীনকালে এই তিস্তা নদী ছিল অনেক চওড়া। এই তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র নদীর মাধ্যমে প্রাচীন কাল থেকে বাংলার সাথে আরব, রোমান সাম্রাজ্য এবং চীনের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এ ছাড়াও সেই সময় ছিল মাৎস্যন্যায় এর যুগ। সেই সময় এই মসজিদ তৈরি করা অসম্ভব কিছু না। টিম স্টিল নিশ্চিত যে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীনতম মসজিদ বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার “হারানো মসজিদ”। অনেকে দাবী করেন, চীনের কোয়াংটা মসজিদ সবচেয়ে প্রাচীন। কিন্তু তাদের দাবীর পক্ষে কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। অন্যদিকে, টিম স্টিলের দাবীর পক্ষে বড় প্রমাণ হলো, ঐ তারিখ লেখা টোরাকোটাটি।

আল জাজিরা টেলিভিশনের রিপোর্টে হতাশার সাথে বলা হয় যে, এরকম বহু পুরোনো ইটের ও অন্যান্য প্রত্ন নিদর্শন ইউরোপ-আমেরিকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। বলা হচ্ছে, এগুলোর প্রধান এবং প্রাপ্তিস্থান হলো বাংলাদেশ। ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান বাংলাদেশের এক একটি প্রাচীন পিতলের মূর্তি বিদেশে বিক্রয় মাত্র ১০০ ডলারে। এভাবে, আমাদের বহু ঐতিহাসিক মূল্যবান সম্পদ চুরি হয়ে যাচ্ছে বাধাহীনভাবে। অবাধে চলে যাচ্ছে এসব দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী অন্য দেশে। বিজাতীয় অন্য রাষ্ট্র, ব্যক্তি, সংস্থা হয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী এসব অমূল্য সম্পদের অবৈধ মালিক।

প্রত্নতত্ত্ব একটি আধুনিক বিজ্ঞান এবং এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য অনেক রকম কৌশল, প্রক্রিয়া, কারিগরী শিক্ষা এবং টেকনোলজি রয়েছে। জাতি হিসেবে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের জ্ঞান এবং পর্যাপ্ত কারিগরী প্রস্তুতি জরুরীভাবে প্রয়োজন।

এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার, আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক-বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলো এবং সাধারণ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি অনেক প্রয়োজন। একটি দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী এক ধরণের রাষ্ট্রীয় সম্পদ, এ সম্পদ বহন করে একটি দেশের শত শত বছরের ঐতিহাসিক দলিল, নিয়ে আসে অতীতকে বর্তমানে, সবার সামনে। এমন অসংখ্য রাষ্ট্রীয় মূল্যবান সামগ্রীকে কি করে অবহেলায় হারিয়ে ফেলছি আমরা বছরের পর বছর? চলে যেতে দিচ্ছি এ সম্পদকে অন্য দেশে? ভাবনার বিষয়, তাই না? আমাদেরকে ভাবতেই হবে এ নিয়ে। সিরিয়াসলি!