দাঁড়িয়ে আছি টেমস নদীর তীরে। অসংখ্য না দেখা স্মৃতিরা যেনো আজ একসাথে জড়ো হয়েছে। হ্যাঁ, এই স্মৃতিগুলো অদেখা। আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে এই ইংল্যান্ডের মাটিতেই পদচিহ্ন রেখে যাওয়া আমার পূর্বপুরুষের স্মৃতি।
হঠাৎ-ই একদিন আমার দাদার একটি নোট খুঁজে পাই আমি। সেই থেকেই ইচ্ছে জাগে আমার পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানবার। অনেক চেষ্টার পর পূর্বপুরুষের লেখা একটি পঞ্জিকা খুঁজে পেলাম। আর সেখান থেকেই জানতে পারলাম দাদার ( দাদার) কিছু নিদারুণ কষ্টের অভিজ্ঞতার গল্প। ‘গল্প’ বলছি ঠিকই, তবে এটি শুধুই গল্প নয়, তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া চরম বাস্তব ঘটনা।
ভারতবর্ষের সাথে (পাশ্চাত্যের) বাণিজ্যের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। প্রায় তিন হাজার বছরের ইন্দো-রোমান বাণিজ্যের আরও অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবার পর আবারও শুরু হয় (এই উপমহাদেশের) সাথে বহিঃর্বিশ্বের যোগাযোগ। বিশ্বায়নের পথ ধরে একে একে এই ভূখন্ডে আসে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসিরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় জিতে যায়। এক পর্যায়ে শুরু হয় নৌবাণিজ্য তথা সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল। (আর এই) নৌবাণিজ্যের নামে তখন থেকেই মূলত স্থায়ীভাবে পাচার হতে শুরু করেছিলো দেশের সম্পদ।
জাহাজে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু হবার পর থেকে নাবিকের প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতে শুরু করে। প্রয়োজন দেখা দেয় ভারী কাজ করতে সক্ষম কর্মচারীর। এ উদ্দেশ্যেই জাহাজে নিয়োগ দেয়া শুরু হয় দরিদ্র ও খাটতে সক্ষম তরুণদেরকে।
সেই সময়কার ব্রিটিশ জাহাজগুলোতে বড় বড় পদে ইংরেজরাই নিয়োগ পেতো। (অন্যদিকে) শ্রমসাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করাবার জন্য নিযুক্ত করা হতো উপনিবেশের শ্রমিকদেরকে। বর্ণবাদী ব্রিটিশরা এই শ্রমিকদেরকে ছোট করে দেখাবার উদ্দেশ্যে তাদের ডাকতে শুরু করলো ‘লস্কর’ নামে।

ইন্ডিয়ার জাহাজে তিনজন লস্কর। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
‘লস্কর’ শব্দটি ফারসি ও উর্দু ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে, যার আভিধানিক অর্থ হলো ‘সৈনিক’। সেনাদলে যারা রসদ গাড়িতে তুলে দিতো, অর্থাৎ কুলিদের মতো নিচু মানের কাজ যারা করতো, তাদেরকেই লস্কর বলা হতো।
ইংরেজদের জন্য লস্কর ছিলো কেবল ভারতীয়রা। (যদিও) চীনসহ অন্য অনেক দেশের গরীব লোকেরাও লস্করদের সমতুল্য কাজ করতো, কিন্তু ‘লস্কর’ শব্দটি ইংরেজরা শুধুমাত্র ভারতীয়দের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতো। ভারতীয় শ্রমিকদের তুচ্ছ করে দেখানোই ছিলো তাদের মূল উদ্দেশ্য।
বলছিলাম আমার পূর্বপুরুষের কথা। তাদের নিদারুণ কষ্টের অভিজ্ঞতার গল্প জানবার পর এ কথা ভাবতেই অবাক লাগে যে, ঋষি সুনাক আজ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। ইংল্যান্ডে আজ সব বর্ণ ও জাতির ব্রিটিশ নাগরিকরাই সমান অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছে। কিন্তু একটা সময় ছিলো, যখন এমন পরিস্থিতি ছিলো কল্পনার অতীত।
একটা লম্বা সময় ধরে (এই) ‘লস্কর’ নামের ভারতীয় শ্রমিকদের উপর অবর্ণনীয় নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে সাদা চামড়ার ব্রিটিশরা। আমার পূর্বপুরুষের (অভিজ্ঞতা) থেকে অনুধাবন করেছি, কি পরিমাণ কষ্টের কাজ করতে হতো তাদেরকে।

লন্ডনের রয়েল অ্যালবার্ট ডকে লাস্কার। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
(মানুষগুলোকে) জাহাজে চাকরি দেয়া হতো ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে থাকতে হতো ভীষণ গাদাগাদি করে। জাহাজের বেশিরভাগ অংশ থাকতো সাদা চামড়ার উচ্চপদস্থ কর্মীদের দখলে। (ঐ দিকে) জাহাজের ডেক ও ইঞ্জিন রুমের দেখভাল করতে হতো লস্করদেরকে। সেই সাথে খাবার-দাবারের তদারকিও করতে হতো। ঘষাঘষির কাজ, ধোয়ার কাজ, নোঙর ফেলা, টেনে তোলা, রং করাসহ সমস্ত পরিশ্রমের কাজ লস্করদের দিয়েই করানো হতো। ইঞ্জিন (ঘরেতো খাটুনি ছিল অমানুষিক)। প্রায় ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাজ করতে হতো তাদেরকে।
অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে হতো বলে অসুস্থ হয়ে যেতো লস্কররা। কিন্তু তাদেরকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেয়া হতো না। জাহাজের কর্মীদের দিয়েই চলতো ভাঙ্গাচোরা চিকিৎসা। এ ছাড়াও লস্করদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবারের মান ছিলো খুবই বাজে। পচা-বাসি ও কম পুষ্টিকর খাবার গ্রহণও লস্করদের মাঝে অসুস্থতার প্রকোপ বাড়ার এক অন্যতম কারণ।
এক সময় হাসপাতালগুলোতে লগ-বই খোলার রীতি চালু হয়। সেই লগ-বইয়ের রেকর্ড থেকে জানা যায়, জাহাজের শ্রমিকদের মধ্যে লস্করদের মৃত্যুহার ছিলো সবচেয়ে বেশি। অসুস্থ লস্করদেরকেও কাজ করতে বাধ্য করা হতো। খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম –কোনোটিই ঠিকভাবে নেবার সুযোগ ছিলো না তাদের। এমন পরিস্থিতিতেও কাজে দেরি হলে ভয়াবহ পরিণাম অপেক্ষা করতো তাদের জন্য।
হতভাগা এই লস্কররা কাজে সামান্যতম ভুল করলেও তাদেরকে পেতে হতো কঠিন শাস্তি। পিটিয়ে সারা শরীর জখম করে বেঁধে রাখা তো ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা। জখমে আবার লবণও ছিটিয়ে দেয়া হতো। ‘কাঁটা ঘাঁয়ে লবণের ছিঁটা”- প্রবাদ বাক্যটি এই লস্করদের জীবন থেকেই পাওয়া। ব্রিটিশদের এমন অকথ্য নির্যাতনে বহু ভারতীয় লস্করের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। ভুলের শাস্তির পদ্ধতি ছিল অদ্ভুত। মুসলমানদেরকে খাওয়ানো হতো শুয়োরের মাংস, আর হিন্দুদেরকে খেতে দেয়া হতো গরুর মাংস। জাত চলে যেতো, ধর্মনাশ হতো, তবুও টিকে থাকার জন্য নিরন্তর শ্রম দিয়ে যেতো তারা।
লস্করদের মধ্যে বাঙালিদের অবস্থা ছিলো আরও শোচনীয়। বেতনের ক্ষেত্রে হোক, কিংবা খাবারের ক্ষেত্রে হোক, বাঙালিদের সব সময়ই ঠকানো হতো এবং তাদের ওপর শোষণও চলতো অন্যদের তুলনায় অনেকগুণ বেশি।
ব্রিটিশ জাহাজের ভারতীয় কর্মীদের মধ্যে লস্করদের উপরে আরও দুটি পদবী ছিলো- টেন্ডল এবং সারেং। টেন্ডলরা লস্করদের এক ধাপ উপরের ভারতীয় শ্রমিক। আর সারেং-দের কাজ ছিলো লস্কর সংগ্রহ করা এবং তাদেরকে জাহাজের কাজে নিয়োগ দেয়া। সাদা চামড়ার ইংরেজরা তো লস্করদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতোই, তবে ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও সারেং-রা কোনো অংশে কম ছিলো না। উপনিবেশিক যুগে জাহাজের চাকরি ভারতীয়দের জন্য বেশ লোভনীয় ছিলো। দরিদ্র ভারতীয়রা কেউ অ্যাডভেঞ্চারের আশায়, কেউবা কোনোমতে ইংল্যান্ডে গিয়ে সেখানে স্থায়ী হবার লোভে, কেউবা নিজেদের দুরবস্থা পরিবর্তনের আশায় জাহাজে কাজ পেতে আগ্রহী হতো। নিজেদের স্বার্থের জন্য সারেং-রা হতদরিদ্র ভারতীয়দেরকে জাহাজে চাকরি দিতো। আবার চাকরি যোগাড় করে দেবার জন্য লস্করদের কাছ থেকে তারা ঘুষও নিতো। লস্করদের প্রাপ্য সামান্য বেতন থেকেও কিছু অংশ অনেক সময় কৌশলে সরিয়ে ফেলতো তারা। এভাবে লস্কররা ব্রিটিশদের কাছে তো লাঞ্ছিত হতোই, সেই সাথে স্বজাতীয় সারেং-দের জন্যও তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো।

লস্কর দের কাজ জাহাজে। ছবি: www.ourmigrationstory.org.uk
ইংরেজরা জাহাজের কর্মীদের জন্য অদ্ভূত এক নিয়ম বানিয়েছিলো, শুধুমাত্র লস্করদেরকে বঞ্চিত করবার উদ্দেশ্যে। তাদের মতে, একজন ব্রিটিশ কর্মী তিন জন লস্করের সমান কাজ করতে পারে। আর এই মনগড়া যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই লস্করদের বেতন হতো ইংরেজ কর্মীদের তুলনায় অনেক কম। অথচ বাস্তবে লস্করদেরকে খাটানো হতো দাসের মতো। আর সেই তুলনায় ব্রিটিশ কর্মীরা তেমন কোনো পরিশ্রমের কাজই করতো না। এভাবেই স্বেচ্ছাচারী ব্রিটিশরা অল্প খরচে লস্করদের এই শ্রমটাকে কিনে নিয়েছিলো।
জাহাজে ব্রিটিশদের অমানষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক লস্কর সুযোগ বুঝে জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যেতো। এদের মধ্যে অনেকেই সাধারণ ব্রিটিশ জনগণের ভিড়ে মিশে নতুন জীবন গড়তে সক্ষম হয়েছিলো। ব্রিটিশ নারী বিয়ে করেও কষ্ট করে জীবনযাপন শুরু করতো তারা। এরই মধ্যে একজন ছিলেন আমার পূর্বপুরুষ, আমার প্রপিতামহ।
এই উপমহাদেশের অসহায় মানুষেরা ব্রিটিশ শোষকদের কবলে পড়ে যে পরিমাণ কষ্ট ভোগ করেছে, তা আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য কল্পনা করাও সম্ভব নয়। সে সময় অবশ্য লস্করদের মধ্যে অনেকে বিদ্রোহও করেছিলো। তবে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করা লস্করদের পরিণাম হতো ভয়াবহ। আর যারা বিদ্রোহে অংশ নিতো না, তাদেরকে ‘বীর’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতো ব্রিটিশ শোষকরা।
আমরা সবাই-ই ব্রিটিশ শোষণের ইতিহাস অনেক ভাবেই জেনেছি। তবে ব্রিটিশ নৌবাণিজ্যে ‘লস্কর’ তথা তৎকালীন উপমহাদেশীয় স্বজাতির নিদারুণ কষ্টভোগের কাহিনীগুলো সাধারণের কাছে কেনো যেনো আজও চাপাই পড়ে আছে। আমার পূর্বপুরুষ যে নিকৃষ্টতম ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন, সেই ইতিহাস প্রত্যেকেরই জানা থাকা উচিৎ।