চলুন ঘুরে আসি লোধি বাগানে। এই বাগানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে এর চারপাশের সজীবতা। কী নেই এখানে! সবুজ ঘাস, সবুজ গাছ, সবুজ লতাপাতা, সবুজ পানিতে শাপলা, আর আছে গাছে সবুজ টিয়া পাখির কলকলানি। চারদিকে ভালোলাগার আমেজ তৈরি করে রাখে এই রঙ-বেরঙের পাখিগুলো। মুহূর্তে নিস্তব্ধতা ভেঙে আপনাকে সচকিত করে তুলবে তাদের কিচিরমিচির। বেশ বিরাট এলাকা জুড়ে এই লোধি বাগান তৈরি হয়েছে। প্রায় ১০০ একর ভূমিজুড়ে এই বাগান। চারদিকে রমরমা বাজার, একদিকে সফদরজং টম্ব—সবকিছু মিলিয়ে মনটা কেমন যেন আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে। এত ব্যস্ত শহরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ লতাপাতায় ছাওয়া এই লোধি বাগান। এখানে শুয়ে আছেন মুহাম্মদ শাহ কিংবা সিকান্দার লোধি। এটি তাঁদের স্মৃতি ধারণ করে রেখেছে। তাঁরা ১৪৫১ থেকে ১৫২৬ সময়কালে দিল্লিকে শাসন করেছিলেন।
কিন্তু তাঁদের নিশ্চিন্তে থাকতে দিল না জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। প্রথমে তাঁরা খুব একটা পাত্তা দেননি বাবরকে। তাঁদের মতে, তাঁর বিজয়ের ইতিহাস মোটেও সুখকর নয়। চরম ভুল করেছিলেন তাঁরা—বিশেষ করে শেষ শাসক ইব্রাহিম লোধি। বাবরের আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। এই অজ্ঞতা প্রথম পানি পথের যুদ্ধে লোধির ভাগ্যে চরম বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল। ইতিহাস অনুযায়ী প্রায় ১ লক্ষ সৈন্য নিয়ে ইব্রাহিম লোধি যুদ্ধক্ষেত্রে যান। বেশ টানটান বুক, অতিরিক্ত মনোবল—কারণ, শুনতে পেয়েছিলেন বাবর নাকি মাত্র ৮ হাজার সৈন্য নিয়ে তাঁর বাহিনীকে মোকাবিলা করতে আসছে। কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা।
শিশ গুম্বাদ, লোদি উদ্যান, নতুন দিল্লি © wikipedia
এখানে আরও কিছু গোলমেলে বিষয় ছিল। এর দায়িত্ব যাকে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর নাম ছিল দৌলতখান। একসময় দৌলতখান উপলব্ধি করেন, ইব্রাহিম লোধি আসলে কাউকে বন্ধু ভাবেন না, বিশ্বাস তো করেনই না। প্রয়োজনে যে কোনো সময় তাঁকে তাঁর চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারেন। এসব অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির জন্য তিনি কাবুলে তাঁর বিশ্বস্ত চর পাঠালেন। তাঁদের মাধ্যমে পৌঁছে দিলেন বাবরকে দিল্লিতে প্রবেশের নিমন্ত্রণবার্তা। এই কাঙ্ক্ষিত বার্তা বাবরের কাছে পৌঁছানো মাত্রই অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো সংগৃহীত হল। কোন পথে, কোন পদ্ধতিতে ইব্রাহিম লোধিকে আক্রমণ করবেন—তা স্থির করলেন তাঁরা।
সময়টি ১৫২২ সাল। নিজেকে গুছিয়ে নিতে কয়েক বছর সময় নিলেন তিনি। তারপর ১৫২৬ সালে ঘটে গেল সেই পানি পথের যুদ্ধ। যেখানে এক বোকা বলেছিল—জলপথে সুবিধা করতে পারেনি বলে পানি পথে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল! যাক, হাসি-তামাশা একদিকে রেখে বাবরের যুদ্ধকৌশল বর্ণনা করি। তাঁর দুর্ধর্ষ কামান এবং “তুফান” নামে এক অত্যাধুনিক বন্দুকের সামনে ইব্রাহিম লোধি নিমেষেই ভেনিস হয়ে গেলেন, দাঁড়াতেই পারলেন না। তাঁর ২০ হাজার সেনা প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইহলোক ত্যাগ করল। দিল্লি তো জয় হয়ে গেল।
এরপর বাবর গেলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায়। সেখানে প্রার্থনা করলেন বাবর, মাজারে গিয়ে জানালেন তাঁর মনের কথা। তিনি বললেন, “আমি হিন্দুস্থানে থাকতে এসেছি এবং আমার বংশধরেরা যেন এই হিন্দুস্থানে বিনা বাধায় রাজত্ব করতে পারে।”
ইব্রাহিম লোধির এই পরাজয়ের পরবর্তী ফলস্বরূপ ভারতবাসী পরিচিত হলো ৩০০ বছরের এক জাঁকজমকপূর্ণ সাম্রাজ্যের সঙ্গে। এভাবেই মোগলরা ভারতের সঙ্গে তাদের চিরস্থায়ী বন্ধন গড়ে ফেলল।

বড় গুম্বাদের পাশে তিন গম্বুজ মসজিদ, লোদি উদ্যান, নতুন দিল্লি। © wikipedia
লোধির স্মৃতিকে খুঁজতে অনেকেই আসেন লোধির এই বাগানে। সকাল, দুপুর, বিকাল—কোনো সময়ই জায়গাটি খালি থাকে না। এত বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, চারদিকে সবুজ আর গাছগুলো ক্রমাগত অক্সিজেন বিলিয়ে চলেছে মানুষের মধ্যে। এই তো তার জাদুকরী প্রভাব! তাই এই প্রকৃতির কাছে ছুটে আসার জন্য মানুষ ব্যাকুল থাকে, ছুটে আসে ব্যস্ততম জীবনকে ছেড়ে। দিল্লির দূষণ, কঠিন জীবন—সবকিছুকে অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে রাখতে পারে লোধি গার্ডেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেখানে বেড়াবার।