নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নেসার অমর প্রেম কাহিনীর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার এক করুণ ইতিহাস। ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা ও রাজনীতির বেড়াজালের মধ্যেই তাদের প্রেম আজও অমলিন। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেসার সেই প্রেম নিয়ে শ্রীপারাবতের বই অবলম্বনে “আমি সিরাজের বেগম” টিভি সিরিয়ালের মাধ্যমে কমবেশি আমরা সবাই পলাশীর ইতিহাস জানি। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় সিরাজউদ্দৌলা ও বেগম লুৎফুন্নেসার জীবনের বিরাট ট্রাজেডি এবং লুৎফুন্নেসার বিষয়ে রয়েছে অনেক কৌতুহল্লোদ্দীপক গল্প। হয়তো আমরা তা অল্পই জানি। তাই আজকে আমরা বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার দ্বিতীয় স্ত্রী লুৎফুন্নেসার সেই গল্প বলবো।
চলুন আগে জেনে আসি, কে ছিলেন এই লুৎফুন্নেসা?
লুৎফুন্নেসা প্রথম জীবনে ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবেব হারেমের একজন সাধারণ হিন্দু পরিচারিকা। তার নাম ছিল রাজকুনোয়ার। সে কি বাঙ্গালী ছিল নাকি উত্তর প্রদেশের? তা জানা যায়নি। তার শৈশবের ইতিহাস আমরা জানতে পারেনি। রাজকুনোয়ার নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার মা আমিনা বেগমের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর রূপ-সৌন্দর্য এবং মধূর ব্যবহারে সিরাজউদ্দৌল্লার আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সিরাজের অনুরোধে মা আমিনা বেগম রাজকুনোয়ারকে ছেলের সেবায় নিয়োজিত করেন। একপর্যায়ে সিরাজউদ্দৌল্লা তাঁকে বিয়ে করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে নবাব তার নাম রাখেন লুৎফুন্নেসা বেগম।
লুৎফুন্নেসা
অবশ্য, সিরাজউদ্দৌল্লার প্রথম বিয়ে হয়েছিল ১৭৪৬ সালে ইরাজ খানের মেয়ে উমদাতুন্নিসার বেগমের সাথে। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে সিরাজউদ্দৌল্লার কোন সন্তান ছিলনা। উমদাতুন্নেসা বেগম সবসময় আনন্দ-বিলাসেই মগ্ন থাকতেন। ঠিক এই সময়, নবাব আলীবর্দী খাঁ নাতি সিরাজকে লুৎফুন্নেসার সাথে আবার বিয়ে দেন কোটি টাকা খরচ করে ও বিপুল উৎসব আয়োজন করে। তাঁদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় একমাত্র কন্যা সন্তান যোহরা। ধীরে ধীরে লুৎফুন্নেসা বেগম সিরাজউদ্দৌল্লার প্রধান স্ত্রীতে পরিণত হন। তবে তার এই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। চারদিক থেকে ঝড় শুরু হলো। জীবন উলোট পালোট হয়ে গেল।
মীরজাফ
১৭৫৭ সাল, বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌল্লা পরাজিত হলে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একা যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু লুৎফুন্নেসা তাঁকে সঙ্গী করার জন্য আকুল আবেদন জানান। পরে সিরাজউদ্দৌল্লা তাঁর বিশ্বস্ত স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, মেয়ে যোহরা এবং একজন অনুগত খোজা সহ গভীর রাতে নিভৃতে মুশির্দাবাদ শহর ত্যাগ করেন। হতভাগ্য সিরাজউদ্দৌল্লা ও তার পরিবারসহ মীরজাফরের ভাই মীর দাউদের হাতে রাজমহলে ধরা পড়েন। পরে সিরাজউদ্দৌল্লাকে হত্যা করেন, আর স্ত্রী লুৎফুন্নেসাকে প্রথমে মুর্শিদাবাদ কারাগারে ও পরে ঢাকার জিনজিরা প্রাসাদে সাত বছর বন্দি করে রাখেন।
বুড়িগঙ্গার পাড়ে জিনজিরা প্রাসাদ। বাংলার মুঘল সুবহাদার ২য় ইব্রাহিম খান (১৬৮৯-১৬৯৭) তাঁর প্রমোদ কেন্দ্র হিসেবে প্রাসাদটি নির্মান করেন। ১৭৫৮ সালে মীরজাফর নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের মহিলা সদস্যদের ঢাকায় নির্বাসিত করে এই জিনজিরা প্রাসাদে থাকার নির্দেশ দেন।
ঢাকার জিনজিরার প্রাসাদ কয়েদখানার আরেক নাম। এই প্রাসাদের প্রতিটি ইটে মিশে আছে লুৎফুন্নেসা, আমেনা বেগম, সরফুন্নেসা বেগমের বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস, আর্তনাদ ও গোঁঙ্গানির আওয়াজ, যা আজও শুনতে পাওয়া যায়। সেই ইতিহাস আমাদের পূর্ব-পুরুষদের এক অব্যক্ত করুণ-বেদনার ইতিহাস। কারাগারে লুৎফুন্নেসা ও তাঁর ৪ বছরের শিশুকন্যা যোহরা বন্দি জীবন কাটান। সাত বছর পর ১৭৬৫ সালে ঢাকার জিনজিরার বন্দীখানা থেকে মুক্তি পেয়ে মুশির্দাবাদ গেলেন লুৎফুন্নেসা।
বাংলাদেশের আজকের রাজধানী ঢাকার গা ঘেঁষে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গার ওপাড়ে জিনজিরা প্রাসাদটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে অযত্নে আর অবহেলায়।
সিরাজের মৃত্যুর পরে লুৎফুন্নেসা বেগম প্রায় ৩০ বছর আরো বেঁচেছিলেন। নবাবি রাজঅন্তঃপুরের নিষ্পেশন ও জীবনের বাকি দিনগুলির নিদারুণ সংগ্রাম ও সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছিলেন। যা বর্ণনা করা খুবই অসাধ্য ব্যাপার। নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যার পর মীর কাসিম লুকানো সোনা-রুপার সন্ধান চেয়ে লুৎফুন্নেসার ওপর অমানবিক অত্যাচার করেন। এদিকে মীরজাফরের ছেলে মীরণ লুৎফুন্নেসাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং মুশির্দাবাদ নগরে অত্যন্ত অপমানজনক অবস্থায় ফেলেন। কিন্তু স্বামীর শাহাদতের পর লুৎফুন্নেসা মীরজাফর ও মীরণের বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সারাজীবন স্বামীর কবরে পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করে সময় অতিবাহিত করে গেছেন।
মীর জাফর (বামে) এবং তাঁর পুত্র মীর মিরন (ডানে)
আসলে নবাব সিরাজের চরিত্রের বিরাট প্রভাব পড়েছিল লুৎফুন্নেসার উপর, ফলে তিনি উন্নত চরিত্র গুণাবলীর অধিকারিনী হয়েছিলেন এবং সারাজীবন সিরাজউদ্দৌলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। লুৎফুন্নেসা খোশবাগে সিরাজউদ্দৌলার কবরের পাশে একখানি কুঁড়ে ঘর তৈরী করে বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেন। তিনি ছিলেন বড় বিদূষী ও মহীয়সী নারী, যে কারণে জীবনের সব লোভ ও আয়েশ-আরাম পরিত্যাগ করে প্রিয় স্বামীর ধ্যানে কাটিয়ে দেন। তিনি মাসিক যে মাসোহারা পেতেন সেটা দিয়ে প্রতিদিন কাঙালী ভোজের ব্যবস্থা করতেন। তিনি সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এভাবে স্বামীর কবরের সেবা-যত্ন করে গেছেন।
যাইহোক, নবাব আলীবর্দী এবং সিরাজউদ্দৌলার সমাধিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোম্পানি প্রতি মাসে মাত্র ৩৫০ টাকা অনুদান দিত। তা দিয়েই সমাধিস্থলে লুৎফুন্নেসা প্রতিদিন পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং সন্ধ্যায় সেখানে মোমবাতি জ্বেলে দিতেন। লুৎফুন্নেসার একনিষ্ঠ প্রেম, ভালোবাসা এবং ত্যাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালে সমুজ্জল হয়ে থাকবে। নারী বলে পলাশীর ইতিহাসে তাঁর অস্তিত্বের উপস্থিতি তেমন বলা হয় না, কিন্তু পলাশী কখনো তাঁকে পাশ কাটিয়েও যেতে পারেনি। পলাশীর ২৫০ বছর পরেও দুর্ভাগা নারী লুৎফুন্নেসা উপেক্ষিতা থাকেনি।
খোশবাগে শায়িত বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবর
জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর মেয়ের ভরণ পোষণের জন্য মাসিক ৬০০/- টাকা বরাদ্দ করেন। ক্লাইভের নির্দেশে লুৎফুন্নেসা ও তাঁর মেয়ে যোহরাকে মুশির্দাবাদে আনা হয়েছিল। মুর্শিদাবাদে আসার কয়েক বছর পর একদমই ভেঙে পড়েন লুৎফুন্নেসা। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে কিন্তু বিয়ে দেয়ার কোনো সামর্থ ছিল না তাঁর। অবশেষে, যোহরার বিয়ে হয়েছিল ১৭৬৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সিরাজের ছোট ভাই ইকরাম-উদ-দৌলার ছেলে মুরাদ-উদ্-দৌলার সাথে। তবে তাঁর দুঃখ ফুরাই না। হঠাৎ জামাই মুরাদ মারা গেলেন । এরপর আরেকটি বড় আঘাত এলো ১৭৭৪ সালে, মেয়ে যোহরাও তাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গেলেন। কন্যার মৃত্যুতে এবার তিনি একদমই ভেঙে পড়লেন। পাঁচ পাঁচটি নাতি ও নাতনীকে নিয়ে কীভাবে জীবন চালাবেন? শুধু তাই নয়, একে একে চারজন বিবাহযোগ্য নাতনী নিয়ে দেখা দিল সমস্যা।
কোথায় তিনি টাকা-কড়ি পাবেন? কে তাকে সাহায্য করবে?
উপায়ন্তর না দেখে, ১৭৮৭ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের কাছে ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আবেদন করলেন। আবেদনে বললেন- নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুতে এবং তাঁর যাবতীয় মালামাল ও সম্পদ লুণ্ঠিত হওয়ায় এবং বার বার চরম নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আমি নিস্ব হয়ে গিয়েছি। লুৎফুন্নেসার আবেদন নাকচ করে দিলেন লর্ড কর্নওয়ালিস। ১৭৯০ সালে লুৎফুন্নেসার মৃত্যু হয়। খুশবাগে সিরাজউদ্দৌলার কবরের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এই দুর্ভাগা নারীর অসহায় এক নাতী ও চার নাতনীর আর কোনো খোঁজ-খবর রাখেনি ইতিহাস।
আজও মুর্শিদাবাদ নগরের এরকম অনেক স্থাপত্য লুৎফুন্নেসা বেগমের জীবনের শূন্যতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
তথ্যসূত্রঃ
বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ, (ইকবাল শাহরিয়ার, ‘লুৎফুন্নেসা বেগম’)।
জিনজিরা প্রাসাদ, প্রথম আলো পত্রিকা।
সংবাদ টুডে পত্রিকা, শিয়ালদহ, কলকাতা।
রজনীকান্ত রায়, ‘পলাশির ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ’, কলকাতা।
বাঙ্গালার বেগম’, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্ধ্যোপাধ্যায়, সোম পাবলিশিং, কলকাতা।
উইকিপিডিয়া ।