“আমি কোনো দেশ নই যে তোমরা আমায় জ্বালিয়ে দেবে কোনো দেওয়াল নই আমি যে আমায় তোমরা ভেঙ্গে ফেলবে অথবা সীমান্তও নই যে মুছে ফেলবে তোমরা। … … মানুষ যখন মানুষের রক্ত শোষে, লুণ্ঠন যখন সীমা ছাড়ায়, অত্যাচার যখন সহ্যের অতীত হয় তখন হঠাৎ কোন একটি কোণায় কোন একটি হৃদয় থেকে উঠে আসতে দেখবে তোমরা আমাকে। …” – বাংলাদেশ, মূল কবিঃ কাইফি আজমি, অনুবাদঃ শিশির ভট্টাচার্য, ১৯৭১।
১৯৭১ সালের জুলাই মাস। ঢাকা তখন হানাদার পাকবাহিনীর বৃহত্তম ঘাঁটি। বিশ্ববাসীর চোখে ধুলা দিতে তখন পাকশাসক আর তার সহযোগীরা প্রবলভাবে তৎপর; একটাই লক্ষ্য- বাইরের লোক যেনো দেখে ঢাকার নাগরিক জীবনযাত্রা স্বাভাবিক, যুদ্ধ এখানে অনুপস্থিত। ঠিক এসময়টাতেই পাকবাহিনীর সমস্ত আয়োজন ছিন্নভিন্ন করে দিতে মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া একদল তরুণ ঢাকায় প্রবেশ করলেন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অসীমসাহসী যোদ্ধাদের সেই দলে ছিল অত্যুজ্জ্বল কিছু নাম – কাজী, বদি, আলম, জুয়েল, স্বপন, চুল্লু, রুমী, প্রমুখ। সেক্টর ২ এর অধীনে গেরিলাদের এই দলটিকে খালেদ মোশাররফ ভালবেসে নাম দিলেন ক্র্যাক প্লাটুন। অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের মানুষের জন্য এই তরুণেরাই প্রথম মুক্তির বার্তা নিয়ে এলেন। নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রেইড আর এম্বুশের মাধ্যমে ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়ের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের তেজোদীপ্ত অপারেশন অব্যাহত রাখলেন।
শহীদ শাফী ইমাম রুমী- ক্র্যাক প্লাটুনের এই নক্ষত্রের নাম প্রথম জানতে পারি ১৯৮৯ সালে। তখন গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। জন্মদিনে শ্রেণীশিক্ষক শ্রদ্ধেয় আউয়াল স্যারের উদ্যোগে চাঁদা তুলে বন্ধুরা বই উপহার দিল- আন্থনি মাস্কারেনহাসের ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’ আর জাহানারা ইমামের ‘বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। প্রথম বইটা বয়সের তুলনায় বেশ ভারীবোধ হওয়ায় তখন পড়া হয়নি। দ্বিতীয় বইটা আকারে ছোট, মূল বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’র কিশোর সংস্করন এটি; এক বসাতেই পড়ে ফেললাম। আর সাথে তৃষ্ণা বেড়ে গেলো মূল বইটি পড়বার। প্রায় ১০বছর পর ১৯৯৯ এ বহুলচর্চিত মূল বইটি আমার হাতে এলো।
মহাকালের সমুদ্রে ১৯৭১ তখন তার সুবিশাল, সুতীব্র স্রোতরাশি নিয়ে আছড়ে পড়ছে এই ভূ-খণ্ডে। বইটির শুরু ৭১ এর মার্চ মাসের ১ তারিখে, খুব সাদামাটা ভাবে- “আজ বিকেলে রুমী ক্রিকেট খেলা দেখে তার বন্ধুদের বাসায় নিয়ে আসবে হ্যামবার্গার খাওয়ানোর জন্য। গোসল সেরে বারোটার দিকে বেরোলাম জিন্না এভিনিউয়ের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিন্যু) পূর্ণিমা স্ন্যাকবার থেকে ডিনার-রোল কিনে আনার জন্য। … বাড়ি ফিরতে দেড়টা।”
এই সহজ প্রাণবন্ত লেখনীর শক্তিতে আমি অভিভূত হই। মুহুর্তেই আমি হয়ে যাই ৩৫৫, এলিফ্যাণ্ট রোড, ধানমণ্ডির ‘কণিকা’ বাড়িটির একজন। বটতলা, শহীদ মিনার কিংবা পল্টন ময়দানের মিছিল মিটিং এর বিবিধ খবরে বাড়িটির অন্য বাসিন্দাদের মতো আমিও আন্দোলিত হই। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি মার্চের ৭ তারিখের। শহরে চলে তুমুল জল্পনা-কল্পনা, বাক-বিতণ্ডা, তর্ক-বিতর্ক- কী বলবেন বঙ্গবন্ধু রমনা রেসের মাঠে? ৭ তারিখের মিটিং শেষে দুই ছেলেকে নিয়ে ঘরে ফেরেন বাবা শরীফ ইমাম। মা জাহানারা ইমাম দরজা খুলতেই বড় ছেলে রুমী দু’হাত তুলে শ্লোগান জুড়ে দেয়- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। সময় এগিয়ে যায় অনিবার্য পরিণতির দিকে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হৃদয়কে পাথর করে দুঃখের গভীর অতলে ডুব দিয়ে তুলে এনেছেন মুক্তোদানার মতন যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতার সকল নির্যাস আর তা ঢেলে দিয়েছেন বইটির পাতায় পাতায়। ২৫শে মার্চের কালরাত্রি, অবরুদ্ধ ঢাকার জীবন, রুমীর যুদ্ধে যাওয়ার কথা এখানে যেমন এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে বিবিধ পরিচিতজনের অভিজ্ঞতায় যুদ্ধকালীন ঢাকার বাইরের খণ্ড খণ্ড চিত্রও। ঢাকার গেরিলা যুদ্ধের বিশদ ও বিশ্বস্ত চিত্রের উপস্থিতি এই বইয়ের পরম সম্পদ। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের বিভিন্ন অভিযানের কথা তাদের বয়ানেই জানবার এক অপূর্ব সুযোগ করে দিয়েছে ‘একাত্তরের দিনগুলি’। আগস্ট মাসের ২৯ তারিখ রুমীসহ গেরিলা দলের অনেক সদস্য পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। সে রাতের ঘটনারও আশ্চর্য বাহুল্যবর্জিত উপস্থাপন পাই এই বইতে। অকল্পনীয় ধৈর্য্যর সাথে তিনি লিখছেন- “আমি রুমীর মাথার কাছে বসে ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলাম; সাইড টেবিলে রেডিওটা খোলা রয়েছে। একের পর এক বাংলা গান হচ্ছে। খুব সম্ভব কলকাতা। হঠাৎ কানে এল খুদিরামের ফাঁসির সেই বিখ্যাত গানের কয়েকটা লাইন।
“একবার বিদায় দেয় মা ঘুরে আসি। ওমা হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী।“
রুমী বলল, “কি আশ্চর্য আম্মা! আজকেই দুপুরে এই গানটা শুনেছি। রেডিওতেই, কোন স্টেশন থেকে- জানি না। আবার এখনো- রেডিওতে। একই দিনে দু’বার গানটা শুনলাম, না জানি কপালে কি আছে।”
এই অসামান্য বইখানির জন্ম কিভাবে হল? সরদার ফজলুল করিম একবার শহীদ জননীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছে তিনি বলেছিলেন – “এটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। নিজের খাতায় টুকিটাকি লিখে রাখা। দিনাদিনের ঘটনা।” কিন্তু যুদ্ধের সময় ঢাকায় বসে এসব লেখার বিপদ তিনি জানতেন। তাই আজেবাজে খাতার পাতায়, আঁকাবাঁকা লাইনে, নানা রঙের কালিতে, বিভিন্ন সাঙ্কেতিক শব্দে ঘটনাগুলো লিখে রাখতেন। যেমন রুমীর নাম লিখতেন ‘মীরু’, মুক্তিযোদ্ধাদের যদি পাঁচশ টাকা পাঠাতেন তো লিখতেন পাঁচটি কাপড় ধোপায় দেয়া হয়েছে ইত্যাদি। হানাদারদের হাতে পড়লেও তারা এটাকে পাগলের আঁকিবুঁকিই ঠাওড়াবে এটাই ছিল আশা। দেশ স্বাধীনের পরে পুত্র আর স্বামী শোকে জাহানারা ইমাম যখন বিপর্যস্ত তখন ১৯৮৪ সালের দিকে ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী ও ‘সচিত্র সন্ধানী’র সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দীনের অনুরোধে সেই ডায়েরির ভিত্তিতে তিনি আবার লিখতে শুরু করলেন রুমীর কথা, নিজের কথা, ৭১ এর কথা। কিছুদিন ‘সচিত্র সন্ধানী’তে প্রকাশিত হবার পর বই আকারে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রথম বের হয় ১৯৮৬ সালে। ২০১৮ তে বইটির সুবর্ণ সংস্করনও প্রকাশিত হয়েছে।
লেখার এই অংশে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়বার পর শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদের পাঠ-প্রতিক্রিয়াটি তুলে ধরতে চাই। আরও অনেকের মত এটা আমারও মনে কথা-
“ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তিনি দেখছেন। কিন্তু দেখছেন দূর থেকে। যদিও এই গল্প একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত গল্প। জননীর তীব্র শোক ও বেদনার গল্প। নিজের গল্প দূর থেকে দেখতে পারেন তাঁরাই, যাঁরা বড় শিল্পী। গভীর আবেগকে সংযত করবার জন্য প্রযোজন হয় একটি পাষাণ হৃদয়ের। সত্যিকার শিল্পীদের হৃদয় হয় পাথরের, নয়ত এত দুঃখকে তাঁরা কোথায় ধারণ করবেন? জাহানারা ইমাম হৃদয়কে পাথর করে লিখলেন তাঁর ডায়রি। কী অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গেই না তাঁর গল্প বলে গেছেন। সেই গল্প তাঁর একার থাকেনি। কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে গেছে আমাদের সবার গল্প।”
প্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ম্যাগনাম ওপাস উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিম’ এর দ্বিতীয় ভাগ উৎসর্গ করেছেন জাহানারা ইমামকে। লেখিকার সাথে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে সুনীল বলছেন-
“ মুক্তিযুদ্ধের ছেলেরা আপনাকে ‘আম্মা’ বলে ডাকে। আমিও আপনাকে ‘আম্মা’ বলবো। আমি কতোবার পড়েছি আপনার ‘একাত্তরের দিনগুলি’। যতবার পড়েছি চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে, আবেগ আর বেদনার অশ্রুতে।”
১৯৭১ কে জানতে আমরাও তাই বার বারই ফিরে যাই এই বইটির কাছে। যেখানে পাতায় পাতায় রুমী, বদি, জুয়েলদের বীরত্বগাঁথা এই দেশটাকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখায়, কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়-
“… তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর। সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া : তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।”