মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়বিতে ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপনের প্রথম দিনগুলোর বর্ণনা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ১৬০৮ সালে মে মাসে বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় সরিয়ে এনে ইসলাম খান চিশতিকে সুবাদার নিয়োগ দেয়া হয়। তবে প্রশাসনিক ও সামরিক লোকজন নিয়ে ঢাকায় আসতে আরো দুটো বর্ষাকাল কেটে যায়। গৌড় হয়ে ঘোরাঘাটে আসেন। ঘোড়াঘাট থেকে ঢাকায় আসেন ১৬১০ সালের জুলাই মাসে। স¤্র্টা জাহাঙ্গীরের নামে তিনি ঢাকার নাম জাহাঙ্গীরনগর রাখেন। এরপর ১০০ বছর মুঘল শাসনের অধীনে ছিল বাংলা। এসময় মোট ২৫ জন সুবাদার ছিলেন। ১৬৮৮ থেকে ১৬৯৭ সাল পর্যন্ত সুবাদার ছিলেন ইবরাহিম খান। তার আমলে বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেন। যার বর্তমান নাম জিনজিরা প্রাসাদ। বাংলার মুগল সুবাদার দ্বিতীয় ইবরাহিম খান প্রমোদকেন্দ্র হিসেবে প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। প্রাসাদটির চারদিকে ছিল নদী ও পরিখা।

তাই একে একটি দ্বীপের মতো দেখা যেত। এ কারণেই এর নামকরণ হয় কসর-এ-জাজিরা বা দ্বীপের প্রাসাদ। মনে হয় জাজিরা থেকেই পরে জিনজিরা নাম হয়। জিনজিরা প্রাসাদে ছিল মূল ভবন, আয়তাকার হাম্মামখানা, প্রহরী-কক্ষ সহ দুইতলা বিশিষ্ট প্রবেশ দরজা। প্রাসাদের বাইরের দিকের দেয়াল ছাড়াও সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য পরিখা ছিল। যা প্রাসাদ-দুর্গেও মত। প্রাসাদটি এখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সাক্ষী হিসেবে প্রাসাদের সাতটি কক্ষ এখনও ভগ্নপ্রায় অবস্থায় টিকে আছে। এটি এখন স্থানীয় লোকদের নিকট হাওলি নামে পরিচিত। বর্তমানে এর চারপাশে গড়ে উঠেছে ঘিঞ্জি বসতি ও বাণিজ্যিক বড় বড় ভবন। যা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছে। এ প্রাসাদে মুর্শিদকুলী খান বসবাস করেন। তারপর নায়েব নাযিম নওয়াজিশ মুহাম্মদ খানের প্রতিনিধি হোসেন কুলি খানের পারিবারিক আবাসস্থল ছিল এ প্রাসাদ। এই প্রাসাদ বেদনাবিধুর ঘটনার নীরব সাক্ষী। ১৭৪০ সালে নবাব সরফরাজ খানের পতনের পর তাঁর মাতা, স্ত্রী, ভগ্নি, পুত্রকন্যা এবং তাঁর হারেমের কতিপয় মহিলাকে এ প্রাসাদে আটক রাখা হয়। মুর্শিদাবাদের রাজপথে হোসেন কুলি খানের হত্যাকান্ডের (১৭৫৪) পর এ প্রাসাদে বসবাসরত তাঁর পরিবার পরিজনকেও বন্দিজীবন যাপন করতে হয়। অদৃষ্টের এক নির্মম পরিহাস যে, সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর আলীবর্দী খানের মহিষী শরীফুন্নেসা, কন্যা ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগম, সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম ও তাঁর কন্যা কুদসিয়া বেগম ওরফে উম্মে জোহরাকে জিনজিরা প্রাসাদে এনে কড়া পাহারায় রাখা হয়।এরূপ জনশ্রæতি আছে যে, নবাব মীর জাফর আলী খানের পুত্র মীর সাদেক আলী খান ওরফে মিরনের নির্দেশে জমাদার বকর খান ১৭৬০ সালের জুন মাসে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়ার অজুহাতে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে প্রাসাদ থেকে নৌকায় তুলে ধলেশ্বরী নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করে। অবশ্য এ ঘটনা মিথ্যাও হতে পারে। কারণ, যাদেরকে হত্যার কথা বলা হয়েছে তাদের কবর মুর্শিদাবাদের খোশবাগে রয়েছে। বুড়িগঙ্গায় তাদের সলিল সমাধি আসলে বৃটিশদের একটি প্রপাগান্ডা।

সিরাজ-উদ-দৌলা এবং ঘষেটি বেগম

তথ্যসূত্রঃ মির্জা নাথান, বাহারিস্তান-ই-গায়বী, খালেকদাদ চৌধুরী (অনুবাদ), ২০০৪, দিব্য প্রকাশ, ঢাকা। খন্দকার মাহমুদুল হাসান, বাংলাদেশের পুরাকীর্তি কোষ (মধ্যযুগ), ২০১৭, পার্ল পাবলিকেশন্স, ঢাকা। বাংলাপিডিয়া (বাংলাদেশের জাতীয় কোষ গ্রন্থ)।