প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর উপত্যকায় জন্মেছিল এক অপূর্ব স্থাপত্য—জিগুরাত। বাইরে থেকে এগুলো অনেকটা মিশরের পিরামিডের মতো মনে হতো, কিন্তু তাদের নির্মাণের কৌশল ও উদ্দেশ্য ছিল একেবারেই ভিন্ন। রাজাদের চিরনিদ্রার সমাধি ছিল পিরামিড। আর জিগুরাত ছিল দেবতাদের পার্থিব আবাস। মন্দির, পাঠশালা, এমনকি আকাশের রহস্য খুঁজে বের করা, জ্যোতির্বিদদের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ছিল সেখানে।
প্রথম দিকে সুমেরীয়রা দেবতাদের জন্য ছোট ছোট টাওয়ার বানাতেন। এগুলো ছিল মাটির উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়ানো সাদামাটা গৃহ। সময়ের সাথে সেই টাওয়ারই রূপ নিল জিগুরাতে। মানুষের বিশ্বাস—এগুলোই দেবতাদের পৃথিবীর আবাসস্থল, আর আকাশছোঁয়া সেই টাওয়ার ছিল দেবতার স্বর্গীয় পাহাড়ের প্রতীক।

গ্রেট জিগুরাত অফ উর; Image Source: 1milyarbilgi.com
খ্রিস্টপূর্ব ২১ শতকে সুমেরীয় উর-এর তৃতীয় রাজবংশের সময় গড়ে ওঠে প্রথম প্রকৃত জিগুরাত। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো উরের জিগুরাত। রাজা উর-নাম্মু চন্দ্রদেব সিন-এর জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন। এর বিশাল ভিত্তি ছিল ১৯০ বাই ১৩০ ফুট, উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। বহু সহস্রাব্দ পেরিয়েও আজও এর দুটি তলা দাঁড়িয়ে আছে, ইতিহাসের নীরব প্রহরী হয়ে।
উর রাজবংশ পতনের পরও এই ধারা থেমে যায়নি। ব্যাবিলনের আকাশ ছুঁতে চাওয়া অনেক জিগুরাত হয়তো আজ কৃষিজমি আর নগরের নিচে চাপা পড়ে গেছে, তবে ইলাম আর আসিরিয়ার মাটিতে এখনো পাওয়া যায় তাদের চিহ্ন।
দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে ইলামাইট রাজা উন্টাশ-নাপিরিশা গড়ে তুলেছিলেন এক নতুন শহর—চোগা জানবিল। এই শহরের গর্ব ছিল এক বিশাল জিগুরাত। এটি উৎসর্গ করা হয়েছিল দেবতা নাপিরিশা ও ইনশুশিনাককে। লক্ষ লক্ষ পোড়ামাটির ইট দিয়ে গড়া এই টাওয়ার এখনো নিকটপ্রাচ্যের প্রায় অক্ষত জিগুরাত।
আসিরীয় রাজারাও আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। রাজা আশুরনাসিরপাল দ্বিতীয় নিমরুদ নগরে তাঁর প্রাসাদের পাশে দাঁড় করালেন এক মহাজিগুরাত। আর রাজা সারগন দ্বিতীয় তাঁর রাজধানী দুর-শারুকিনে বানালেন ১৪৩ ফুট উঁচু সাততলা জিগুরাত—প্রাসাদ আর জিগুরাতকে এক করে দিয়ে স্থাপত্যে সৃষ্টি করলেন এক নতুন ধারা।

চোগা জানবিল জিগুরাত; Image Source: charismaticplanet.com
ব্রোঞ্জ যুগ শেষের দিকে এল এক বিস্ময়—এ-টেমেনানকি জিগুরাত। ব্যাবিলনের মহারাজা নেবুচাদনেজার দ্বিতীয় নির্মাণ করেছিলেন এই মহাটাওয়ারকে, উৎসর্গ করেছিলেন দেবতা মারদুককে। নামের অর্থ—“আকাশ ও পৃথিবীর সীমান্তের গৃহ”। অনেকে বলেন, বাইবেলের বিখ্যাত Tower of Babel-এর কাহিনি জন্ম নিয়েছিল এ জিগুরাত থেকেই।
এভাবেই আকাশছোঁয়া ইটের টাওয়ারগুলো শুধু স্থাপত্য নয়, ছিল প্রাচীন মানুষের স্বপ্ন আর বিশ্বাসের প্রতীক—যেখানে পৃথিবী আর স্বর্গের মধ্যে গড়ে ওঠে এক সেতুবন্ধন।

