প্রায় ৫,০০০ বছর আগে, প্রাচীন মিশরের মরুভূমির মাঝে জন্ম নেয় এক জাদুকরী রঙ মিশরী নীল। এটি শুধু একটি রঙ নয়, বরং এক ধরনের বিস্ময়কর আবিষ্কার। ফারাওরা এই রঙকে এতটাই পছন্দ করতেন যে তাদের মন্দির, কবর, মূর্তি, এবং আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান সবই মিশরী নীলের উজ্জ্বল আলোতে ঝলমল করত। এই রঙের প্রতি মানুষের আগ্রহ আজও কমেনি, বরং আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতেও এটি নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলছে।
প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় মিশরী নীলকে বলা হতো hsbd-iryt, অর্থ “কৃত্রিম ল্যাপিস লাজুলি।” প্রকৃত ল্যাপিস লাজুলি বা আজুরাইট পাথর সংগ্রহ করা কঠিন এবং ব্যয়বহুল ছিল। তাই মিশরীয়রা নিজ হাতে কৃত্রিম নীল তৈরি করতে শিখেছিল। তারা এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল যা হাজার বছর ধরে টিকে আছে। মিশরী নীল প্রথম তৈরি হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ সালের দিকে, মিশরের চতুর্থ রাজবংশের সময়। এই রঙের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার হতো বালি বা সোডিয়াম কার্বনেট, ক্যালসিয়াম, আর তামা বা ব্রোঞ্জের খনিজ। কারিগররা প্রথমে এগুলোকে মিশিয়ে আটা সদৃশ তৈরি করত। এরপর ছোট ছোট গোলা তৈরি করে ১,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় চুলায় বসাত। তাপের কারণে এগুলো কাঁচ সদৃশ নীল পদার্থে পরিণত হত, যা পেষণ করে রঙ তৈরি করা যেত।
মিশরী নীলের উজ্জ্বলতা এবং স্থায়িত্ব অসাধারণ ছিল। এটি কবরের প্রাচীরচিত্রে, মূর্তিতে, গহনায় এবং আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত হত। প্রতীকী অর্থে এই নীল রঙ ছিল দেবত্ব, সুরক্ষা, আকাশ এবং নীল নদীর প্রতীক। বিশেষ কর্মশালার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেখানে শুধুমাত্র মিশরী নীল তৈরির কাজ হতো। এ থেকেই বোঝা যায়, প্রাচীন মিশরীয়রা রঙের রসায়ন নিয়ে কতটা জ্ঞানী ছিল।
মিশরীয় নীল’ ফেরেন্স দিয়ে তৈরি পাইক্সিস: এটি উত্তর সিরিয়া থেকে ইতালিতে আমদানি করা হয়েছিল এবং খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০–৭০০ সালের মধ্যে উৎপাদিত হয়েছিল। © wikipedia
মিশরী নীলের জনপ্রিয়তা মিশরের সীমানার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন প্রাচীন শহরে এর চিহ্ন পাওয়া গেছে। রোমানরা এটি ব্যবহার করত তাদের মোজাইক ও প্রাচীরচিত্রে। রোমান সাম্রাজ্যের নানা প্রান্তে মিশরী নীল তৈরি এবং বাণিজ্যিকভাবে প্রচলিত ছিল, যা দূরদেশ থেকে আমদানি করা ইন্ডিগোর সহজলভ্য বিকল্প হিসেবে কাজ করত। রোমান শিল্পীর কবর এবং পম্পেই শহরের ধ্বংসাবশেষেও কিছু অপ্রয়োগ করা মিশরী নীল পাওয়া গেছে।
মধ্যযুগে মিশরী নীলের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সম্ভবত উৎপাদন প্রক্রিয়া হারিয়ে যাওয়ায় তা ঘটে। তবে রেনেসাঁ যুগে গ্রেকো-রোমান শিল্পকলা অনুকরণ করতে গিয়ে এটি কিছু সময়ের জন্য পুনরায় ব্যবহৃত হয়। ইতালিয়ান রেনেসাঁ শিল্পকর্মে, যেমন জিওভানি ব্যাটিস্টা বেনভেনুটোর St. Margaret এবং রাফায়েলের The Triumph of Galatea-এ মিশরী নীলের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
১৯শ শতকে রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিশরী নীল তৈরির প্রাচীন প্রক্রিয়া কিছুটা উদঘাটিত হয়। আজও ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা স্মিথসোনিয়ান ও কার্নেগি মিউজিয়ামের সঙ্গে যৌথভাবে মিশরী নীলের জটিল রচনা পুনঃনির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। তারা ১২টি ভিন্ন রেসিপি তৈরি করেছে, যেখানে সিলিকন ডাইঅক্সাইড, তামা, ক্যালসিয়াম, এবং সোডিয়াম কার্বনেট বিভিন্ন অনুপাতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি মিশ্রণ প্রায় ১,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১১ ঘন্টা ধরে চুলায় রাখা হয়েছে।

নেবামুনের সমাধি থেকে পাওয়া মিশরীয় নীল রঙের দেওয়ালচিত্র (অষ্টাদশ রাজবংশ, খ্রিস্টপূর্ব ১৫৬৭ থেকে ১৩২০ অব্দ পর্যন্ত) © wikipedia
আজকের দিনে মিশরী নীল শুধু সৌন্দর্যের কারণে নয়, বরং বিভিন্ন ব্যবহারিক কারণে গুরুত্ব পাচ্ছে। এটি চিহ্নিত ও মানচিত্রায়ন করে, শিল্প ইতিহাসবিদরা প্রাচীন শিল্পের বিবর্তন বোঝার সুযোগ পান। হারানো অলঙ্কার বা প্রাচীরচিত্র পুনর্গঠনের কাজেও এটি সাহায্য করে। এছাড়া মিশরী নীল অন্য রঙের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে না, আলোতে দীর্ঘ সময় থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ন্যানোস্কেল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এটি ইনফ্রারেড আলোতে উজ্জ্বল হয়। সৌর শক্তি, দূরসংযোগ প্রযুক্তি, জৈবচিকিৎসা চিত্রায়ন এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যবহার সম্ভাব্য।
প্রাচীন মন্দিরে সজ্জিত হোক বা আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সহায়ক, মিশরী নীল মানব সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনের এক অনন্য নিদর্শন। এই রঙের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করায়, কিভাবে শিল্প ও বিজ্ঞান একসঙ্গে সময়ের প্রাচীর অতিক্রম করে এবং পৃথিবীর বোঝাপড়াকে নতুন দিশা দেয়।

