আনাক-সু-নামুন। একাধারে তিনি তুতানখামেনের মাতামহী, বোন ও স্ত্রী। বাবা ফারাও আখেনাতেন ও মা নেফারতিতি এর ঘরে খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৮ সালে আনাক-সু-নামুনের জন্ম। মিশরের রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের অংশ বলতেন। সিংহাসনে দেবতার অধিকার কায়েম রাখতে, খুব কাছের আত্মীয়কে বিয়ে করতেন তারা। এ কারণে বাবাই রাজকন্যা আনাক-সু-নামুনের প্রথম স্বামী। মাত্র বারো বছর বয়সেই, মা হয় মেয়ে। ক’দিন পরই আখেনাতেনের মৃত্যু, পরের ফারাও স্মেনখারে হয় তাঁর নতুন স্বামী।
আনাক-সু-নামুন রানির নাম আনাক-সু-নামুন। তুতানখামেনের বোন ও স্ত্রী
তিনিও ক্ষণজীবী। এবার দৃশ্যপটে আসবেন বালক রাজা ন’বছরের তুতানখামেন। তিনি রাজকন্যা আনাক-সু-নামুনের সৎ-ভাই। রাজমুকুট পেলেন তুতানখামেন। পরম্পরা মেনে বালক ফারাওয়ের রানী হলেন বছর ষোলোর আনাক-সু-নামুন। তখন মানুষরা জানত না যে, রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে হলে তার প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। সন্তানের শরীরে নানা রকম জেনেটিক অসুবিধা দেখা দেয়। এ কারণে বোধহয় দু’বার মরা মেয়ে হয়েছিল রানীর। শিশুদের মমি মিলেছে তুতানখামেনের বিখ্যাত মমির পাশে। এই কন্যা সন্তানগুলো যদি বেঁচে থাকত তবে হয়তো তারা শেষ পর্যন্ত রানী আনাক-সু-নামুনের জায়গাটি গ্রহণ করত, আর রক্তরেখা অব্যাহত থাকতো এবং প্রাচীন মিশরের ইতিহাস হয়তো বদলে দিত। যাইহোক, এটি ঘটেনি, এবং ভাগ্যবিড়ম্বিত রানী আনাক-সু-নামুনের জন্য জীবনে অপেক্ষা করছিল আরও সব অপ্রীতিকর ঘটনা।
প্রায় দশ বছর তুতানখামেনের সাথে তার বিবাহিত জীবনে তিনি সুখেই ছিলেন। তুতেনখামেন সেসময় মিশরের রাজা হলেও তার বয়স ছিল কম। ফলে বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য তাকে বিভিন্ন মন্ত্রী ও উপদেষ্টার সাহায্য নিতে হতো। আনাক-সু-নামুনও তার স্বামীকে রাজ্য পরিচালনায় সাহায্য করতেন। তারা দুজনে মিলে তাদের বাবা মিশরের সমাজ ব্যবস্থার যে ক্ষতি করেছিলেন তা ঠিক করার চেষ্টা করেন। তবে তুতেনখামেন তার শারীরিক কারণে খুব একটা আরামে রাজত্ব করতে পারেননি। তার একটি পা ছিল খোঁড়া। ফলে তাকে সবসময় একটি লাঠি নিয়ে হাঁটতে হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, তার বাবা-মায়ের অজাচারী সম্পর্কের ফলেই তিনি এই পঙ্গুত্ব লাভ করেন। তবে তুতেনখামেন ও আনাক-সু-নামুন দম্পতির মধ্যে বোঝাপড়া ভালো ছিল বলেই জানা যায়। প্রেমময় সম্পর্কের অনেক ছবি মিশরে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু হায়! ভাগ্য তার প্রসন্ন ছিল না। কিভাবে যেন হঠাৎ করেই মাত্র ১৯ বছর বয়সে রাজার মৃত্যু ঘটে। শুরু হয় নতুন সমস্যা। আই মন্দিরর পুরোহিত তাকে জোর করে বিয়ে করার জন্যে। তার হাত থেকে বাঁচার জন্য পত্র পাঠায় হিট্টাইট রাজাকে।
আকুতি ভরা চিঠি লিখেছিলেন রানী। ‘‘আমি বিধবা, পুত্রহীনা। আপনার ছেলেদের কাউকে আমার সঙ্গে বিয়ে দেবেন? কোনও প্রজাকে স্বামিত্বে গ্রহণ করতে চাই না।’’ রানী কী পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন যে এমন চিঠি লিখলেন? হিট্টাইট রাজা ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন দেখতে, পথেই তাঁকে খুন করান তুতানখামেন ও আনাক-সু-নামুনের দাদু আই। নাতির হত্যার নেপথ্যেও নাকি তিনি ছিলেন। রাজত্বের দাবি জোরালো করতে, আই জবরদস্তি বিয়ে করলেন আনাক-সু-নামুনকে। এর পরই ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছেন রানী বা মুছে দেওয়া হয়েছে তাঁর অস্তিত্ব। ঐতিহাসিকরা এখনও তার রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ বা কেন তিনি অদৃশ্য হয়েছিলেন তা বের করার চেষ্টা করছেন। আখেনাতেন এবং নেফারতিতি উভয়ই বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন। তারা পুরনো ধারা ভঙ্গ করে একটি ধর্মীয় বিপ্লব ঘটিয়েছিল, যেখানে তারা কেবলমাত্র এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিল।
বিশদ ভাবে বলা যায় যে, তার যখন জন্ম হয় তখন মিশর এক ধর্মীয় বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেসময় তার পিতা আখেনাতেন মিশরের প্রাচীন দেবতাদের ত্যাগ করে একক দেবতা ‘আতেন’ এর উপাসনা শুরু করেন। ফলে এতদিন ধরে পূঁজা করে আসা দেবতা ‘রা’-এর অনুসারীরা আখেনাতেনের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং এক বড়সড় বিপ্লবের শুরু হয়। কারণ, এর মধ্যদিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ধনী পুরোহিত শ্রেণীর কাছ থেকে অর্থ এবং ক্ষমতা দুটোই নিয়ে নেওয়া হয়। স্বার্থে আঘাত লাগাতে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা, অসন্তুষ্টি এবং প্রতিবাদ শুরু হয়। তাদের মৃত্যুতে আনাক-সু-নামুনের আর কোন বিকল্প থাকলো না। তিনি প্রয়াত ফেরাউন তুতানখামুনের উপদেষ্টা ফেরাউন আইয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হলেন। যদিও তিনি তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু লাভ হয় নাই। বিয়ে তাকে করতেই হয়, এবং বিয়ের প্রমাণ মেলে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা একটি আংটি খুঁজে পেয়েছিলেন যা থেকে দেখা যায় যে তিনি ফেরাউন আইয়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তার জীবনের ট্রাজিডি হ’ল যে, এই গল্পের শেষে তিনি আশ্চর্যজনক ভাবে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন। আরো আশ্চর্যের বিষয় হ’ল ফেরাউন আইয়ের সমাধির দেওয়ালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা আইয়ের স্ত্রী এবং রানী নেফারতিতির নার্স তেঁয়ের নাম পেয়েছিলেন, কিন্তু তার নাম ছিল না। রানী আনাক-সু-নামুনের নাম মোটেই উল্লেখ করা হয়নি সেখানে। মনে হয় ইতিহাস থেকে তাকে যেন ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে।
২০১৮ সালের শুরুর দিকে জানুয়ারি মাসে আনাক-সু-নামুনের সমাধি খুঁজে বের করার জন্য একটি অভিযান চালানো হয়। এ সময় প্রত্নতত্ত্ববিদরা মিশরের ‘ভ্যালি অফ দি মাংকিজ’ নামক স্থানে খনন চালান। এখানেই এর আগে ফেরাউন আইয়ের সমাধি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আইয়ের সাথে যদি আনাক-সু-নামুনের বিয়ে হয়ে থাকে তবে নিয়ম অনুসারে এখানেই তার সমাধি থাকার কথা। এই স্থানটি মিশরের ‘ভ্যালি অফ দি কিংস’ নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধি স্থানের খুব কাছেই অবস্থিত। ‘ভ্যালি অফ দি কিংস’ নামক স্থানটিতে এর আগে তুতেনখামেন সহ মিশরের নানা গুরুত্বপূর্ণ ফেরাউনের সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়।