১৭৮২ সালের শেষের দিকের কথা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিযুক্ত ইজারাদার দেবী সিংহের বিরুদ্ধে রংপুরের কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। প্রথমে কৃষকরা দেবী সিংহের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও পরবর্তীতে তা দ্রোহের রূপ নেয়। কাজিরহাট, কাকিনা, টেপা ও ফতেপুর চাকলা অঞ্চলের কৃষকরা বিদ্রোহ শুরু করলে তাদের সাথে কুচবিহার ও দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকরা যোগ দেয়।
কৃষকদের আন্দোলনের মূল কারণ ছিল অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় যার সূচনা করে ওয়ারেন হেস্টিংস। তার নিয়োজিত ইজারাদাররা তখন গরিব খেটে খাওয়া কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত কর আদায়ের জন্য জোর করে। একে অতিরিক্ত কর, তার উপর নির্মম অত্যাচার কৃষকদের মনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এ আত্যাচারিত কৃষকদের পাশে আশার আলো হয়ে যে মানুষটি পাশে দাঁড়িয়েছিল সে আর কেউ নয়, নুরুলদীন। তিনি সকল অত্যাচারিত কৃষকদের একত্রিত করতে থাকেন জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে।
দেবী সিংহ শেষ সময় বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠেন। প্রথমে পূর্ণিয়া জেলার শাসন করা শুরু করেন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ জনগণ দুনিয়া থেকে চলে যেতে থাকে। দিকে দিকে তার অত্যাচারের বর্ণনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পুলিয়ার মত রংপুর ও দিনাজপুরের কর আদায়ের নিজস্ব পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন। সাধারণ কর ছাড়াও আরো নানা ধরনের কর ছাপানো হত এই অসহায় কৃষকদের উপর। কর জমা দিতে না পারলে একসময় নিজেদের জমি চলে যেত এই দেবী সিংহের দখলে। এই পরিস্থিতিতে রংপুরের কৃষক সম্প্রদায় টেপা গ্রামে এসে সংঘবদ্ধ হন। তারা নিজেরা এক স্বাধীন সরকার গঠন করে। এই সরকার দলের নেতা ছিলেন নুরুলদীন। বিদ্রোহীদের এই সরকার ৫ সপ্তাহের মত টিকে ছিল।
প্রথম দিনে তাদের আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তাদের এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হেস্টিং আমলে না নিলে কঠোর প্রতিরোধের দিকে যেতে থাকে।১৭৮৩ সালে জানুয়ারি মাসে নুরুলদীনের নেতৃত্বের কৃষকরা চূড়ান্ত বিদ্রোহ শুরু করে। তাদের এই আন্দোলন দেবী সিংহ কে ক্ষমতা থেকে সরানো নয় বরং ইংরেজদের শাসন মেনে নিবেন না, এমন সিদ্ধান্তে কৃষকরা বিদ্রোহ করেন। কৃষকরা দেবী সিংহের সব কর্মচারীদের রংপুর থেকে বিতাড়িত করে। দেবীসিংহ একপর্যায়ে ভয়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে দেবী সিংহ রংপুরের ইংরেজ কালেক্টর ল্যান্ডের নিকট আশ্রয় নেয়।
নুরুদ্দিন কে দমনে রংপুরে লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোল্যান্ড এর নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। তার সাথে যোগ দেয় গুডল্যান্ডের নিজস্ব বাহিনীও। নির্বিচারে তারা নারী-শিশু বৃদ্ধদের হত্যা করতে থাকে। বিদ্রোহীদের কাছে লাঠি, দা, কাঁচি ছাড়া তেমন কোন অস্ত্র ছিল না। এদিকে ইংরেজ সেনাবাহিনীর কাছে ছিল ভারী কামান, গোলা, বারুদ। কিন্তু তারা সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে কুটকৌশল অবলম্বন করলেন। রাতের আধারে ঘিরে ফেলে বিদ্রোহীদের ঘাটে পাটগ্রাম। দিনটি ছিল ১৭৮৩ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি। ভোরবেলা মুক্তিকামী কৃষকদের ওপর ভারী অস্ত্রসহ হামলে পড়ে লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড ও তার বাহিনী। অতর্কিত হামলায় মারা যায় অনেক কৃষক। সেই হামলায় নুরুলদীন গুরুতর আহত হন। সেই অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
লড়াইয়ে কৃষকদের পরাজয় হলেও তারা ইংরেজদের কোন খাজনা দিত না। সাগরের খাজনা বাকি পড়লে ইংরেজ সরকার পিটারসন নামের একজন অফিসারকে দিয়ে তদন্ত করায়। সব সত্য তুলে ধরলে দেবী সিংহ কে বরখাস্তে করা হয়। কিন্তু সে বড় অংকের অর্থ দিয়ে ইংরেজদের বশ করেন। যদিও সাধারণ কৃষক সমাজ তাকে রংপুর থেকে বের করে দেয়। জেনারেল হেস্টিং ইন এ সময় দেশে ফিরে যান আর গুডল্যান্ডকে ডেকে নেয়া হয় কলকাতায়। এরপর আসেন লর্ভ কর্ণওয়ালিস। দেবী সিংহ তাকে বশে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। নিজের মতো সাধারণ জীবন যাপন করে ১৮০৫ সালে দেবীসিংহ মারা যায়।
লর্ভ কর্ণওয়ালিস রাজত্ব আদায়ের ইজারা প্রথা বন্ধ করে দেন। নুরুলদীনের এইযে আত্মত্যাগ আহত সফলতা পায়নি, কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে রেখে গিয়েছে এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাইতো অত্যাচারিত, নিপীড়িত বাঙালি জাতি আজও নুরুলদীনকে মনে রেখেছে। যতবার বাঙালি শোষণের শিকার হয়েছে, ততোবারই নুরুলদীনরা ছুটে এসেছে শোষিত মানুষের পাশে।