পালকি একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন। পালকিতে চড়ে বউ শ্বশুরবাড়ি যায় , হুনহুনারে হুনহুনা গান গেয়ে বেহারারা দ্রুত পায়ে রওয়ানা দেয়, বউকে যথাস্থানে পৌঁছানোর জন্য। সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে হবে, পথে ডাকাতের ভয় আছে। গানের সুরে সুরে সমস্ত ক্লান্তি ভুলে গ্রামের মেঠোপথ ধরে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তারা পালকি বয়ে নিয়ে যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ইন্দিরা উপন্যাসের নায়িকা ‘ইন্দিরা’ পালকি চড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবার পথে ডাকাতদের আক্রমনের মুখে পড়ে, তখনকার সমাজ ব্যাবস্থায় তার কি অবস্থা হয় সেইসব নিয়ে কথা।
 
পালকিতে সাধারনত ১ বা ২ জন যাত্রী চড়ে, ৪ বা ৮ জন পালকিবাহক এটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করে।
সাধারনত হাড়ি, মাল, দুলে, বাগদি, বাউড়ি সম্প্রদায়ের গরীব লোকগুলি পালকি বহন করে থাকে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রথমদিকে পালকি ছিলো দেব-দেবীদের মুর্তি একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়ার জন্য ব্যাবহৃত একটি বাহন কিন্তু পরে ইউরোপীয় উঁচু শ্রেনীর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ও ভদ্রমহিলারা ভারতে রেলগাড়ি চালু হবার আগে পর্যন্ত পালকিতে চলাফেরা করতেন।
 
আধুনিককালে পালকির ব্যবহার নেই বললেই চলে। কিন্তু বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে বউকে পালকিতে করে অনুষ্ঠানের জায়গায় আনা হয়। কিছু সৌখিন লোকজন পালকি’র ঐতিহ্যেকে সামনে আনে মানুষকে চমক দেয়ার জন্য।
 
পালকি তৈরি করতে সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ, গান কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। বটগাছের বড় ঝুরি দিয়ে তৈরি হয় পালকির বাঁট বা বহন করার দন্ড। পালকি সচরাচর তিন ধরনের হয়ে থাকে যেমন, সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি চারদিক কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় এবং ছাদ হয় ঢালু। এর দুদিকে দুটি দরজা থাকে।পালকির বাইরের দিকে আলপনা আঁকা থাকে। আয়না পালকিতে আয়না লাগানো থাকে। ভিতরে চেয়ারের মতো দুটি আসন ও একটি টেবিল থাকে। ময়ূরপঙ্খী পালকির আয়তন সবচেয়ে বড়। এই পালকি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়, ভিতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল ও তাক থাকে। এ পালকির বাঁটটি বাঁকানো এবং এর বাইরের দিকে কাঠের তৈরি পাখি, পুতুল ও লতাপাতার নকশা থাকে।
 
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চৌদ্দ শতকের পর্যটক জন ম্যাগনোলি ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এবং
পরে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল পালকি। আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা পালকিতে চড়েই যাতায়াত করতেন। অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসা করতে নেওয়ার জন্য পালকি ব্যবহৃত হতো। এছাড়া হিন্দুরা তীর্থে যাবার সময়ও পালকি ব্যাবহার করতো। সেই সময় সচ্ছল পরিবারগুলিতে সবারই নিজস্ব পালকি ছিলো।
 
সেই সময় অভিজাত শ্রেণির লোকজন যাতায়াতের জন্য পালকিই ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন শিলাইদহে ছিলেন তখন তিনি তাদের জমিদারির কাচারি পরিদর্শনের সময় যে পালকি ব্যবহার করতেন, তা এখনও কুঠিবাড়িতে রাখা আছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতায়ও উঠে এসেছে পালকির কথা…‘তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে/ দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে’।
 
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় পালকির বিভিন্নরকম নাম — রোমে লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো, তুরস্কে টাহটিরেভান ইত্যাদি নামে পালকি পরিচিত হয়ে আসছে।
 
উপমহাদেশে সম্ভ্রান্ত মহলে এটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তা আস্তে আস্তে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে ওঠে। যার ফলে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে পালকির একটি বিশেষ জায়গা আছে।
পালকির প্রভাব আমাদের লোকসাহিত্যে মিশে গেছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পালকির কবিতাটা সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, যা এখনো বাংলা ভাষার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি।এই গানে সবশেষে পালকি চালকদের শারিরীক পরিশ্রমের কথাও বলা হয়েছে, যারা কড়া রোদে একটানা পালকি বইতে গিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে।
পালকি চলে রে,
অঙ্গ টলে রে;
সূর্য্য ঢলে,
পালকি চলে!