গ্রিক পুরাণ মতে, প্যান্ডোরা হলো প্রথম নারী যাকে অপরূপ সৌন্দর্য আর গুণাবলী দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিলো।
কাহিনীটির শুরু হয়েছিলো জিউস আর প্রমিথিউসের ভেতরের দ্বন্দ থেকে।
গ্রীক দেবতাদের মধ্যে ছোটোখাটো যুদ্ধ লেগেই থাকতো l অলিম্পাসের দেবতারা টাইটানদের হারিয়ে তাদের কাছ থেকে স্বর্গ ছিনিয়ে নেয় l স্বর্গ তাদের দখলে আসার পর তারা পৃথিবীতে নতুন প্রাণী সৃষ্টি করার কথা ভাবে এবং সে দায়িত্ব দেয়া হয় এপিমেথিউস ও প্রমিথিউস নামের দুই ভাইকে। এপিমেথিউস পৃথিবীতে নতুন প্রানীর সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে ভালো ভালো গুণ দিয়ে দেয়। পরে প্রমিথিউস দেখে মানুষকে দেয়ার মতো কোনো বিশেষ গুণই আর বাকি নেই। তখন সে স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনে মরনশীল মানুষের হাতে তুলে দেয় । প্রমিথিউস ছিলেন- মানব প্রেমী দেবতা। তিনি বুঝেছিলেন আগুন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে না l ওদিকে জিউস মানুষকে আগুন দিতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন l কিন্তু তার এই মানব প্রেম তাকে জিউসের নিষেধ উপেক্ষা করতে সাহসী করে তুলেছিলো l গ্রিক পুরাণেও আছে, ‘মানুষের জন্য, মানুষের কল্যানের জন্য প্রমিথিউসের বড় বেশী পক্ষপাত ছিলো, কখনো কখনো তা দেবতাদের থেকেও বেশী ছিলো’। জিউস টাইটানদেরকে পরাজিত করে দেবতাদের রাজা হন। প্রমিথিউসের এই মানব প্রীতি গুনটি দেবতা জিউসের একদম পছন্দ ছিলো না। এজন্য প্রমিথিউসের উপর তার ছিলো প্রচন্ড রাগ ও ক্ষোভ। তাই মানুষকে আগুন দেবার শাস্তি হিসেবে জিউস তাকে বন্দি করে রাখে এবং প্রতিশোধ নিতে হেপাফানকে দিয়ে মাটি ব্যবহার করে নারীরূপী ‘প্যান্ডোরাকে’ তৈরি করান l
প্রত্যেক দেবতাই অবদান রেখেছে এই প্যান্ডোরাকে গড়ে তুলতে, সবাই কিছু না কিছু উপহার দিয়েছে প্যান্ডোরাকে। কিভাবে বানালো এই প্যান্ডোরাকে ? প্যান্ডোরাকে তৈরী করার জন্য ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতিকে বেছে নেয়া হয় তার মডেল হিসেবে, আফ্রোদিতি তাকে দেয় সৌন্দর্য- লাবণ্য-আকাঙ্ক্ষা। হার্মিস দেয় চাতুর্য ও দৃঢ়তা, অ্যাপোলো নিজে তাকে সঙ্গীত শেখান এভাবে প্রত্যেক দেবতাই নিজেদের সেরাটা দিয়ে সাজিয়ে তোলেন প্যান্ডোরাকে । সবশেষে জিউসের স্ত্রী-হেরা তাকে উপহার হিসেবে দেন তার অনন্য বৈশিষ্ট্য- কৌতুহল। সব মিলিয়ে প্যান্ডোরা হয়ে ওঠে এক অপরূপ সুন্দরী নারী ।
প্যান্ডোরাকে দেবতারা যেসব বৈশিষ্ট্য দিয়েছিলেন তার মধ্যে কৌতুহল স্বভাবটি ছিলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর বা দুশচিন্তার কারণ। প্যান্ডোরাকে সমস্ত মানবিক গুনাবলীর সাথে তার বিয়েতে আরেকটি জিনিস উপহার হিসাবে দেয়া হয় সেটি হলো, মুখ বন্ধ করা একটি অপূর্ব বাক্স l বাক্সটি “প্যান্ডোরা বক্স” নামে পরিচিত। বাক্সটি যেনো সে কখনো না খুলে সে নির্দেশনা দিয়ে দেন জিউস। বাক্সটির ভেতরে জিউস ভরে দিয়েছিলেন লোভ-লালসা, জরা-জীর্ণ, ক্রোধ, দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক, ঘৃণা, হতাশা ইত্যাদি । এরপর প্যান্ডোরাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীতে এপিমেথেউসের কাছে, আর তাকে বলা হয় তার ভাই প্রমিথিউসের কৃতকর্মের ওপর জিউসের আর কোনো রাগ নেই তাই তার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে তার জন্য প্যান্ডোরাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন তিনি।
প্রমিথিউস তার ভাই এপিমেথিউসকে বার বার বলেছিলেন, দেবতাদের দেয়া কোনো উপহার গ্রহণ না করতে। কিন্তু অপরূপ প্যান্ডোরাকে দেখা মাত্র তার প্রেমে পড়ে যান এপিমেথিউস , ভুলে যান তার ভাইয়ের দেয়া সতর্কবাণী l
বিয়ে হয়ে যায় এপিমেথেউস ও প্যানডোরার। সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিলেন তারা। কিন্তু দুর্যোগ আসাকে বন্ধ করবে কে? এটা তো পূর্বনির্ধারিত প্ল্যান! যে কারণে নিষিদ্ধ বাক্সের প্রতি তীব্র আকর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলল প্যান্ডোরার। তার মনে হতে থাকলো কোনো একটি অজানা শক্তি বার বার তাকে বাক্সটির প্রতি তীব্রভাবে আকৃষ্ট করছে, যাকে ঠেকানোর সাধ্য তার নেই। যা তার ভেতরের কৌতুহলী স্বভাব বাক্সটি খুলে দেখবার ইচ্ছেকে বারবার জাগ্রত করছিলো। এভাবে একদিন আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না প্যান্ডোরা। জিউস কিন্তু তাকে বলেও দিয়েছিলো, যতোদিন সে বাক্সটির মুখ না খুলবে ততোদিন সে এপিমেথিউসের সাথে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু কৌতুহলী প্যানডোরা একদিন জিউসের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এপিমেথিউস এর চোখ এড়িয়ে বাক্সটির মুখ খুলে ফেলে, হেরে যায় তার কৌতুহলী বৈশিষ্টের কাছেও।
বাক্সটি খোলা মাত্র তা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক, লোভ, ঘৃণা যা ছড়িয়ে যায় সারা পৃথিবীতে। ভয়ে প্যান্ডোরা তখন দ্রুত বাক্সটির মুখ বন্ধ করে ফেলে l যখন সে বাক্সটির মুখ বন্ধ করে তখন শুধুমাত্র ‘আশা’ রয়ে যায় বাক্সটিতে। তখন থেকে পৃথিবীতে এতো অশান্তি, হানাহানি, রোগ-শোক ছেয়ে গেছে আর আজও চলছে, আর এই আশা’ই মানুষকে টিকিয়ে রেখেছে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে।
এভাবে, পৃথিবীর সর্বপ্রথম আর সর্বগুণে গুণান্বিত নারী-প্যান্ডোরার নারীসুলভ কৌতুহল পৃথিবীর জন্য বয়ে আনে নারকীয় দুর্ভোগ। জিউস এভাবেই মানবজাতির উপর তার প্রতিশোধ নেন। আজ পর্যন্ত প্যান্ডোরাকে পৃথিবীর সকল অনিষ্টের জন্য দায়ী করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর জন্য শাস্তি কিন্তু পাওয়া উচিত দেবতা জিউসের। দেবতা জিউস তার দুষ্টু বুদ্ধির কৌশলে মানুষকে দিয়েই মানুষের ক্ষতি করে দিলেন, আর প্যানডোরা পরিচিত হলো মানুষের অনিষ্টকারী হিসেবে।
এই গল্প গুলো হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক l আমাদের উত্তর প্রজন্মের মধ্যে পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার অভ্যাস ও চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে এবং একদিন নিশ্চয়ই আসবে যেদিন এসব মিথের ঘটনাগুলো একেবারে শেষ হবে। সেদিন এই পৃথিবীতে লক্ষ কোটি নতুন নারী পুরুষ নেতৃত্ব দেবে l তারা পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর মধ্যে সমতা আনবে l তারা নিশ্চিত ভাবে অস্বীকার করবে লিংগ বৈষম্যের অপ-রাজনীতিকে।