আমাদের পূর্বপুরুষরা তিন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে এমন সব স্থাপত্য গড়ে তুলেছিল, যা আজও বিস্ময়ে আমাদের অভিভূত করে। তখন তাদের হাতে ছিলনা আধুনিক কোনোযন্ত্র।
সীমিত প্রযুক্তি দিয়েই তারা এগুলোকে গড়েছিল। মিশরের আকাশছোঁয়া পিরামিড, মেসোপটেমিয়ার দেবালয় জিগুরাত, কিংবা ক্রিট দ্বীপের মাইনান প্রাসাদ আর মাইসেনীয় গ্রীসের দুর্গ—সবই ব্রোঞ্জ যুগের অমর কীর্তি। প্রাচীন মিশর আজও গর্বিত হচ্ছে তার স্থাপত্যের অমর মহিমায়। মিশরের সবচেয়ে আলোচিত নিদর্শন হচ্ছে তাদের পিরামিড। তবে পিরামিডের আগে তারা তৈরি করেছিল সমাধি ভবন। একে মাস্তাবা বলা হত। এটি দেখতে অনেকটা লম্বা বেঞ্চের মতো। আরব ভ্রমণকারীরাই প্রথম এদের এমন নাম দেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় রাজবংশের রাজাদের আবিডস নগরের এই সমাধিগৃহগুলোর নিচে শোয়ানো হতো। কিন্তু পরিবর্তন আসে তৃতীয় রাজবংশে। তখন রাজধানী চলে যায় মেমফিসে। তখনই রাজা জোসের (২৬৮৭–২৬৪৮ খ্রিস্টপূর্ব) নির্মাণ করান ইতিহাসখ্যাত স্টেপ পিরামিড। তাঁর প্রধান মন্ত্রী ও স্থপতি ইমহোতেপ তৈরি করেছিলেন এই অসাধারণ নকশা। ছয়টি মাস্তাবা একটির উপর আরেকটি বসিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল এই ১৯৬ ফুট উঁচু অট্টালিকাকে। চারপাশে ছিল ৩৪ ফুট উঁচু, পাঁচ হাজার ফুট দীর্ঘ প্রাচীর—যেন রাজকীয় এক গোপন নগরী।

আবিদসের সেতি প্রথমের মন্দিরের সম্মুখভাগ, নির্মিত খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ১৩০০ সালে © wikipedia
চতুর্থ রাজবংশে এসে শুরু হয় সত্যিকার পিরামিড যুগ। রাজা স্নেফেরু (২৬১৩–২৫৮৯ খ্রিস্টপূর্ব) একটির পর একটি করে চারটি সৌধ নির্মাণ করেন। মেইদুমে একটি, দাহশুরে দুটি (বিখ্যাত বেন্ট পিরামিড ও রেড পিরামিড), আরেকটি সেলায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বেন্ট পিরামিডই ছিল ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত পিরামিড, এটি পরবর্তীতে গিজার মহাপিরামিড তৈরিতে পথ দেখিয়েছিল।
তারপর এলেন সম্রাট খুফু। তিনি নির্মাণ করলেন গিজার সবচেয়ে বড় পিরামিড (২৫৮৯–২৫৬৬ খ্রিস্টপূর্ব)। একে প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বের সাত আশ্চর্যের একটি হিসেবে মান্য করেছিল। প্রায় ১৩ একর জায়গাজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্থাপত্যের উচ্চতা ছিল ৪৭৯ ফুট, ঢালের কোণ ৫৩ ডিগ্রি। বলা হয়, প্রায় ২৫,০০০ শ্রমিক তিন মাস অন্তর পালা বদল করে তৈরি করেছিলেন এই বিস্ময়। খুফুর পর তাঁর পুত্র খাফরা এবং নাতি মেনকাউরাও নিজেদের পিরামিড নির্মাণ করেন।
তবে পিরামিড শুধু সমাধি নয়, ছিল এক বিশাল ধর্মীয় কমপ্লেক্স। দেবত্বপ্রাপ্ত রাজাদের উদ্দেশে এখানে আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতেন পুরোহিতরা। পিরামিডের রহস্যময় আকৃতিকে সূর্যের কিরণের প্রতীক হিসেবে ভাবা হয়। এটি মৃত রাজাকে নতুন জীবন দেয়, আবার কারও মতে এটি সৃষ্টির আদিম পাহাড়ের প্রতিরূপ। চতুর্থ রাজবংশের পরও পিরামিড নির্মাণ অব্যাহত ছিল, তবে সেগুলো ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে। মধ্য রাজবংশে অধিকাংশ পিরামিডই বানানো হয়েছিল কাদামাটির ইট দিয়ে, যা আজ প্রায় বিলীন।

বেন্ট পিরামিড © wikipedia
খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০–১০৬৯ অব্দের নতুন রাজবংশে শুরু হয় মিশরের স্থাপত্যে এক নতুন অধ্যায়। রাজারা আর শুধু সমাধি বানালেন না, তারা গড়ে তুললেন অসাধারণ মন্দিরসমূহ—কর্ণাক, লুক্সর, মেদিনেত হাবু, রামেসিয়াম। এগুলো ছিল পাথরের তৈরি , এখানে রাজারা একের পর এক নতুন প্রাচীর, ফটক আর অট্টালিকা যোগ করতেন। ফলে এগুলো রূপ নিত বিশাল গোলকধাঁধায়, যার প্রতিটি কোণে লুকিয়ে ছিল দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর রাজাদের মহিমার স্মারক। এই ধারা পরবর্তীতে গ্রিক আর রোমানদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। তারা নিজেদের মন্দির নির্মাণে মিশরীয় অনুকরণে গড়ে তোলে নতুন অধ্যায়। এভাবেই ব্রোঞ্জ যুগে মানুষের হাতে জন্ম নেয় একের পর এক বিস্ময়কর স্থাপত্য—যেখানে সীমিত প্রযুক্তি জয় করেছিল সময়কে, আর ইট-পাথরের গাঁথুনিতে উঠে এসেছিল মানুষের স্বপ্ন, বিশ্বাস আর অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা।

