আমাদের মানতেই হবে—তখনকার দিনে একজন বাবা, যিনি রাজধর্ম পালনের জন্য নিজের কন্যাকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন, তিনি নারীর ক্ষমতায়নে সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন। ইতিহাস যতই তাঁকে অবজ্ঞা করুক কিংবা ভুলে যাক, ভারতের প্রথম মহিলা শাসকের আসন কিন্তু তাঁরই প্রাপ্য।
ইলতুৎমিসের কন্যা রাজিয়া সুলতানা। দিল্লির সিংহাসনে তিনি মাত্র চার বছরের জন্য বসেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, প্রেম, বিয়ে এবং মৃত্যুকে ঘিরে আজও রয়েছে নানান বিতর্ক। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই—ভারতের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী সম্রাজ্ঞী।
রাজিয়া সুলতানার শাসন আমলের মুদ্রা © wikipedia
রাজিয়ার শেষ আবাস
আজও বিতর্ক রয়েছে, রাজিয়া সুলতানার কবর আসলে কোথায়। কেউ বলেন দিল্লির বুলবুল-ই-খানা মহল্লায়, আবার কেউ বলেন হরিয়ানার কোইথালে। একটি মানুষের দুটি কবর হতে পারে? মতভেদ থাকলেও অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, পুরোনো দিল্লিতেই রয়েছে তাঁর প্রকৃত সমাধি।
তুর্কমান গেট থেকে সরু গলি পেরিয়ে পৌঁছানো যায় রাজিয়ার কবরস্থানে। এত সরু ও অন্ধকার সেই গলি, যেখানে দুপুরের রোদও ঠিকমতো ঢোকে না। শেষ মাথায় একটি ছোট টিলায় ধুলো-ধুসরিত ফলকের নিচে শুয়ে আছেন ভারতের প্রথম মহিলা শাসক। নিঃশব্দ সেই পরিবেশে দাঁড়িয়ে অবাক লাগে—ঝাঁসির রানীর মতোই সাহসিনী হয়েও তাঁর প্রতি এত অমর্যাদা!
রাজত্ব থেকে মৃত্যুর কাহিনি
বাদাউনে জন্মেছিলেন রাজিয়া। ছোটবেলা থেকেই বাবার নির্দেশে অস্ত্রশিক্ষা, ঘোড়সওয়ারি, রাজনীতি—সবকিছুর মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠেছিলেন। হয়তো তখনই তিনি অজান্তে প্রস্তুত হচ্ছিলেন অস্থির ভারতে নতুন ইতিহাস গড়ার জন্য।
শাসনকালে তিনি হিন্দু-মুসলিম উভয়ের প্রতিই সমান দৃষ্টি দিয়েছিলেন। মৌলবাদীদের পাত্তা দিতেন না। এ কারণেই রাজধানীর অভিজাতদের একাংশ তাঁর বিরোধিতায় উঠে পড়ে লাগে। শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহে তিনি সিংহাসনচ্যুত হন।

রাজিয়া সুলতানার সমাধি, দিল্লি © wikipedia
শেষ যুদ্ধের পরাজয়ে রাজিয়া এক পথচারীর কাছ থেকে খাবার চান। পুরুষবেশী দামি পোশাকে তাঁকে দেখে পথচারী ভেবেছিল, নিশ্চয়ই তিনি ধনসম্পদে ভরপুর। ভুল বোঝাবুঝি থেকেই সেদিন রাজিয়া খুন হন। জনশ্রুতি আছে, অপরাধবোধে ভোগা সেই পথচারীই তাঁকে দূরের টিলায় কবর দেয়।
লোককথা ও ইতিহাস
রাজিয়ার সমাধি নিয়ে আজও লোককথা প্রচলিত। কেউ বলেন, পাশের আরেকটি কবর তাঁর বোন সাজিয়ার। কল্পনায় ভেসে আসে—দুই বোন যেন পাশাপাশি শুয়ে আছে, আর হয়তো ইতিহাসকে প্রশ্ন করছে:
“একটা নারীর বঞ্চনার ইতিহাসই কি তবে তোমরা দেখতে চাও?”
শেষ কথা
ছোটবেলা থেকে আমরা সুলতান আমলের কত গল্প পড়েছি। কিন্তু দিল্লির অন্ধকার গলিতে রাজিয়া সুলতানার নিরাভরণ শেষ আবাস দেখে মনে প্রশ্ন জাগে—যাকে ভারতের ইতিহাসের প্রথম নারী সম্রাজ্ঞী বলা হয়, তাঁর প্রতি এই অবহেলা কেন?

দিল্লি সালতানাতের রাজিয়া সুলতানার চিত্রকর্ম, তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ পাণ্ডুলিপির বাঁধাই থেকে © wikipedia