Inside the Musee de Louvre

প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ল্যুভর যাদুঘরের নাম কে না শুনেছে! Le Musee du Louvre ল্য ম্যুজে দ্যু লুভ্‌র্‌ বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পকলা যাদুঘর এবং ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা।

আসেন আমরা জেনে নেই বিশ্ববিখ্যাত এই যাদুঘরের নেপথ্য কাহিনী—
এখনকার লুভ্যর যাদুঘরটি প্রথমে একটি দূর্গ ছিল। রাজা ফিলিপ অগাস্টের নির্দেশমতো ১১৯০ সালে দুর্গটির নির্মান কাজ শুরু হয়। ক্রুসেডের যুদ্ধে যাওয়ার আগে প্যারিস শহরকে ভাইকিং দস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি এ দূর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।
সিন নদী আর প্যারিস শহরের মাঝখানে বানানো হয় দূর্গটি। শহরকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই জায়গাটি ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। ল্যুভর এখন যেমন শহরের কেন্দ্রেস্থলে আছে, তখন এর অবস্থান এমন ছিলো না। এর অবস্থান ছিলো শহরের বাইরের দিকে আর এর কাজ ছিলো শহরের উপর প্রতিরক্ষামূলক নজরদারি করা।
তবে পরবর্তীতে নগরের পরিধি বাড়ার ফলে প্রতিরক্ষার কাজে এ দুর্গটি আর ব্যবহার করা হয়নি। এখনও ল্যুভর জাদুঘরের বেইসমেন্টে গেলে পুরনো সেই দুর্গের কিছুটা অংশ দেখা যায়।
 
প্রতিরক্ষার দিকে খেয়াল রেখেই করা হয় এ দুর্গের নকশা। ভবনটির আকার ছিলো চারকোনা, যার চারপাশে ছিলো দুর্ভেদ্য পরিখা। দেয়ালের চারদিক দিয়ে ছিলো বেশ কিছু প্রতিরক্ষা টাওয়ার। প্রধান টাওয়ারটি ছিলঠিক মাঠের মাঝখানে আলাদা এক পরিখায় ঘেরা। আর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কারাদণ্ডের জন্য বিশেষ সিলিন্ডার আকৃতির আর একটি ভবন।
এই দুর্গটিতে পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজা বসবাস করেছেন। ১২০০ সালে গড়া যে ভবনকে ঘিরে লুভ্যর গড়ে ওঠেছে তা ছিল ফরাসি সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপের রাজকীয় দুর্গ ও প্রাসাদ।
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব ঘটার আগ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ের একটি স্থায়ী জাদুঘর তৈরির কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। ১৭৯৩ সালের ১০ আগস্ট ফ্রান্সের বৈপ্লবিক সরকার ল্যুভরের গ্র্যান্ড গ্যালারিতে মিউজি সেন্তাল ডি আর্ট (Musée Central des Arts) চালু করে, সবার জন্য খুলে দেয়া হয়।

The Mona Lisa painting is display at the Louvre Museum

ল্যুভর যাদুঘরের বেশিরভাগ কাজ হয়েছিলো সতের শতকে, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ লুইসের সময়। ১৫৪৬ সালে রাজা প্রথম ফ্রান্সিস এটিকে প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। এরপর থেকে এটি ফরাসি রাজাদের প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ লুইসের ছিল শিল্পের প্রতি অসীম ভালোবাসা। তাদের মন্ত্রীরা তাদের জন্য পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে মূল্যবান শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে আনতো। ১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় চতুর্দশ লুইস ও তার স্ত্রীকে টুইলারিস প্রাসাদে বন্দি করে তাদের শিরোচ্ছেদ করা হয়। টুইলারিস প্রাসাদটি ছিলোঠিক ল্যুভরের পাশে।সেই বছরের ১০ই আগষ্ট ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির নির্দেশে ল্যুভরকে জাদুঘর হিসেবে সবার জন্য খুলে দেয়া হয়। তখন শিল্পকর্মগুলোর অধিকাংশ ছিল রাজকীয় এবং চার্চের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি। সে সময় মোট ৫৩৭টি চিত্রকর্ম নিয়ে ল্যুভর আনুষ্ঠানিকভাবে গণ-জাদুঘর হিসেবে যাত্রা শুরু করে। প্রায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে এই বিশ্ব বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘর। এটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয় ১৮ শতকে। এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটি কিন্তু বেশ দীর্ঘ। বিভিন্ন রাজা- রাজড়ার শাষনকাল পেরিয়ে ষোড়শ লুই একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুসারে ১৭৯৩ সালে তিনি এই জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। জাদুঘরটির সংগ্রহশালা আটটি ভাগে বিভক্ত – মিশরীয় পুরাতত্ত্ব, নিকট প্রাচ্য পুরাতত্ত্ব গ্রিক, এট্রাস্কান ও রোমান পুরাতত্ত্ব, ইসলামিক শিল্পকলা, ভাস্কর্য, সজ্জা সংক্রান্ত শিল্প, অঙ্কনশিল্প এবং ছাপা শিল্প।
 
দূর্গটির গঠনে সমস্যা থাকায় ১৭৯৬ থেকে ১৮০১ সাল পর্যন্ত জাদুঘরটি বন্ধ করে রাখা হয়। ফ্রান্সের সম্রাট প্রথম নেপোলিয়ন জাদুঘরটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন “নোপোলিয়ন জাদুঘর“। সে সময় ল্যুভরের সংগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। ফরাসি সৈন্যদের লুট করা সব শিল্পকর্ম এখানে আসতে থাকে, সেইসাথে জাদুঘরটির সংগ্রহশালা ফুলে ফেঁপে উঠে। ওয়াটারলু যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হলে তার সৈন্যরা জাদুঘরটির অনেক শিল্পকর্ম মূল মালিকের কাছে ফেরত দেয়। রাজা অষ্টাদশ লুইস ও রাজা দশম চার্লসদের শাসনকালে জাদুঘরটির সংগ্রহ আবার বেড়ে যায়। পরে বিভিন্ন সময়ে দান অথবা উপহারের মধ্যদিয়ে সংগ্রহ আস্তে আস্তে বেড়ে যায়।
 
লুভ্যর সারা বিশ্বের পুরানো জাদুঘরগুলোর মধ্যে একটি। এখানে জাদুঘরের পাশাপাশি রয়েছে আর্ট গ্যালারি। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ১৮৪৮ অর্থাৎ ১৯ শতক পর্যন্ত পশ্চিমা শিল্পের এক বিশাল সমাহার রয়েছে ল্যুভরে, পাশাপাশি রয়েছে প্রাচীন অনেক নিদর্শন। এই জাদুঘরে প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু থেকে আধুনিক সভ্যতার অনেক কিছুই রাখা আছে। বর্তমানে এই জাদুঘরটির মূল প্রবেশ পথে কাঁচের তৈরি পিরামিড বসিয়ে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে, এই পিরামিডের স্থপতি ছিলেন আই. এম. পে এবং পিরামিডটি ১৯৮৮ সালে উদ্বোধন করা হয়।
 
১৮৫৭ সালের মধ্যে বহু ভবন বিশিষ্ট ল্যুভরের স্থায়ী কাঠামোটি সম্পূর্ণ হয়েছিলো ৮০ ও ৯০-এর দশকে জাদুঘর হিসেবে ল্যুভরে আধুনিক সরঞ্জামাদি যোগ করা হয় ও প্রদর্শনীর পরিধি কয়েক হাজার বর্গ মাইল বাড়িয়ে ল্যুভরকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্র্যান্ড ল্যুভর নামকরণ করা হয়। এখানেই রয়েছে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি‘র আঁকা পৃথিবী বিখ্যাত ঐতিহাসিক ছবি “মোনালিসা“। এটা এতটাই দামী যে এটি চারদিক থেকে বুলেট প্রুফ কাঁচে ঘেরা এবং এটি পাহারা দেয়ার জন্য সবসময় পাহারাদার থাকে, তারপরও ১৯১১ সালে এটি চুরি হয়েছিল এবং দু’বছর পর সেটা উদ্ধার করা হয়। নেপোলিয়ানের শাসনকালে, তিনি মোনালিসার এই চিত্রকর্মটি ল্যুভর থেকে সরিয়ে নিজের শোবার ঘরে রেখেছিলেন।
ল্যুভর যাদুঘরের একটি অংশ ফরাসি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিলো। ১৯৯৩ সালে ল্যুভরের ২০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই অংশটি সকলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।