দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত লেখক পেরুমাল মূর্গান রচিত বই ‘one Part Woman’ এই যাবৎকালের অন্যতম বহু চর্চিত উপন্যাস। ২০১৩ সালে বইটির ইংলিশ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকৃত নাম ‘মাধুরভাগন’। এটি ভগবান শিবের অর্ধনারীশ্বর, অর্ধ-নারী অর্ধ-পুরুষ মূর্তির তামিল নাম; সমগ্র এশিয়ায় যার একটিমাত্র মন্দির তামিলনাড়ুতে অবস্থিত। বইটির মূল থিম এই মন্দিরটির একটি ধর্মীয় প্রচলন ‘নিয়োগ’ কেন্দ্রীভূত। উপন্যাসের নায়ক সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। এদিকে পরিবার পরিজনের থেকে বারবার অপদস্থ হতে থাকে ওই দম্পতি। ১২ বছরের বিবাহিত জীবনেও যখন সন্তান আসে না তখন সন্তান সুখ পেতে নায়িকা স্বামীর অনুমতি ছাড়াই নিয়োগ প্রথার আশ্রয় নেন।
কোনো বিবাহিত দম্পতি যদি কোনো কারণবসত বংশ বৃদ্ধিতে অক্ষম হয়, তবে স্বামী নির্দ্বিধায় দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারেন। অপরদিকে সেই যুগে কোনো রাজা বা পুরুষ নপুংসক হলে বা রাজার অকালমৃত্যু হলে বংশবৃদ্ধির জন্য কোনোভাবেই স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি ছিল না। কিন্তু শুধুমাত্র গর্ভধাণ করার জন্য দেওর বা মহর্ষির শরণাপন্ন হতেন নারী।বলা হতো ঋষির দ্বারা যে সন্তান আসে সে আসলে রাজারই সন্তান। এখানে স্বামীর ইচ্ছা ও অনুমতি সর্বোচ্চ মানা হতো। এবং সর্বোচ্চ তিনটি সন্তানের জন্য নিয়োগ প্রথার আশ্রয় নেওয়া যেত। আশ্চর্যজনক ভাবে এটি এখনকার যুগের সারোগেট মাদারের অপর রূপ যেখানে সন্তানের ওপর জন্মদাতার কোনো অধিকার থাকে না। তবে উল্লেখ্য এই ধরনের শারীরিক মিলনে যাতে কোনরকম ভাবেই স্ত্রী বা তৃতীয় পুরুষটি উপভোগ না করতে পারে তাই সারা দেহে ঘী লেপন করা হতো। এমনকি সন্তান জন্ম নেবার পর কোনোভাবেই সন্তান বা নারী কেউ-ই এই তৃতীয় পুরুষের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারতো না। তৃতীয় পুরুষ চিহ্নিতকরণ স্বামী নিজে করতেন। স্বামীর অকালমৃত্যু হলে স্বামীর পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ কেউ এই দায়িত্ব নিতেন। এই ধরনের সুবিধা ‘নিয়োগ প্রথা’ নামে পরিচিত। এখনও বহু জায়গায় এই প্রথা রীতিমতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে পালন করা হয়।
প্রথম মনুস্মৃতিতে এই প্রথার বর্ণনা পাওয়া যায়। এই প্রথার প্রচলন রামায়ণ, মহাভারতেও উল্লেখ আছে। এভাবেই ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু, বিদুরের জন্ম হয়। এমনকি পঞ্চ পাণ্ডবদের জন্ম এই একই ভাবে হয়। মন্দিরের এই প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী, পূজার ১৪তম দিনে, সন্তানহীন কোনো পুরুষ নিজের স্ত্রীর জন্য পছন্দমত সমজাতের বা উচ্চজাতের পুরুষ বেছে নিতে পারেন ও শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য দুজন মিলিত হতে পারেন। এই প্রথাই হলো মাধুরভাগন বইটির থিম। যাকে নিয়ে শুরু হয় বহু বিবাদ, তর্ক। নায়িকা এখানে বিনা অনুমতিতে নিয়োগ প্রথায় যান, যা কিনা স্বামীর চরম অসম্মান। কবি এখানে মন্তব্য করেন – এক স্ত্রী যদি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়, তবে স্বামীটি দ্বিতীয় বিয়ে করবেন, এদিকে স্বামী অক্ষম হলে স্ত্রীকে পরপুরুষের হাতে তুলে দেওয়া কেমন বিচার! একবারও ভাবত না তখনকার সমাজ একটি নারী মানসিক ও শারীরিকভাবে কতখানি প্রস্তুত। এমনকি নিজেদের পুরুষত্ব খর্ব হবার ভয়ে এমন বহু ঘটনাকে চাপা দিয়ে দিতেন স্বামী অর্থবলে, লোকবলে। স্ত্রীকে কেন শুধু বংশ বৃদ্ধির যন্ত্র বা ভোগ বিলাসের উপকরণ হিসেবে দেখা হবে? তার বিচার বিবেচনার কি কোনোই দাম নেই? নারীবাদীরা এই ধরনের পদক্ষেপকে নারী স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ বলেছেন তবে সনাতন ধর্মের মাথারা এরকম স্পর্ধা মেনে নিতে পারেনি। ফলস্বরূপ সারা দেশে আলোচনা, কটূক্তি।
বেদের সময়ও নারীদের গুরুত্ব দেওয়া হত, তাদের মর্যাদার গুরুত্ব দেওয়া হত। তাহলে এমন কি হয়ে গেল যে হঠাৎ করে মেয়েদের আবার লড়াই করতে হচ্ছে সেই সম্মান ফেরত পাওয়ার জন্য। নারী স্বাধীনতার অর্থই নারীর নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা এবং তা বাস্তবায়িত করা। সময় বলছে সময় হয়েছে। নারীরা এগিয়ে আসুক। এসে বলুক, “আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত!”