বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম একটি পবিত্র স্থান হচ্ছে সারানাথ। আমরা জানি ষষ্ঠ শতাব্দীতে বোধগয়ার বোধিবৃক্ষের নিচে রাজকুমার সিদ্ধার্থ বোধী লাভ করেন এবং এই জ্ঞান অর্জনের পরপরই এই অভয়ারণ্যে তিনি প্রথম তার ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন। সেই থেকে প্রায় দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১৭০০ বছর বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং পন্ডিতদের এক তীর্থ স্থান ছিল সারানাথ। সারানাথ উত্তর প্রদেশের বারাণসী থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে গঙ্গা এবং বরুণা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। বৌদ্ধ পালি গ্রন্থ অনুযায়ী এর প্রাচীন নাম হচ্ছে ইসিপাতানা এবং মৃগদাব। মৃগদাব শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘হরিণের বন’। আর ইসিপাতানা মানে ‘ঋষিদের পতন’।
আধুনিক এই নাম সারানাথের সঙ্গে হরিণেরও সম্পর্ক রয়েছে। সারানাথ শব্দের উৎপত্তিও ‘সারঙ্গনাথ’ থেকে। এর অর্থ ‘হরিণের নাথ’। এটি আসলে দেবতা শিবের নাম। আমরা প্রায়শই শিবের মূর্তিতে তার বাম হাতে একটি হরিণ ধরে থাকতে দেখি l
বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে বুদ্ধ ৫ জন ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে পৃথিবীর অর্থ খোঁজার জন্য তীর্থ যাত্রা শুরু করেন। তবে হঠাৎ করেই এই ৫ জন ব্যক্তি বুদ্ধকে ত্যাগ করে সারানাথে গিয়ে তাদের আস্তানা গাড়েন। এর পরে বুদ্ধ যখন জ্ঞান বা বুদ্ধত্ব লাভ করেন তখন বোধি লাভের এই সুখবরটি তিনি সর্বপ্রথম ঐ পাঁচজন সংগীকে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। করলেনও তাই l তিনি সারানাথে পৌঁছে ঐ ৫ জনের কাছে কাছে তার অভিজ্ঞতার বর্ননা দেন। তার এই প্রথম উপদেশকে বলা হয় ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্র।
বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারীদের জন্য এই সুত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবজীবন সম্পর্কিত শিক্ষা গুলোর ব্যাখ্যা রয়েছে এই সুত্রে। মানবজীবনে যে ৪ টি সত্য রয়েছে তার প্রথম সত্য হল পৃথিবীতে দুঃখ আছে। দ্বিতীয় সত্য হল দুঃখের উৎপত্তি এবং তার কারণ। তৃতীয় সত্য হল দুঃখ দূর করা এবং চতুর্থ সত্য হল আর্য অষ্টাঙ্গিক পথ যার মাধ্যমে দুঃখের অবসান ঘটবে। এবং মানব জীবনে শান্তি, জ্ঞান, নির্বাণ লাভ হবে।
প্রথম শতাব্দীতে সারানাথ কুষাণদের দ্বারা শাসিত হয়। তারাও এখানে অনেক স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন। কুষাণ শাসক কনিষ্কের রাজত্বকালে তৃতীয় বছরে মথুরার একজন সন্ন্যাসী বালা একটি বিশাল বেলেপাথরের বোধিসত্ত্ব মূর্তি তৈরি করেছিলেন। আর সেই সময়ই অশোকের স্তম্ভের উপরে নিজেদের কিছু বাণী খোদাই করে লিখে রেখেছিলেন।
এর পরে আসে গুপ্ত শাসনকাল। তারাও সারানাথের শিল্পকলায় তাদের নিজেদের ছাপ রাখেন । চিনা সন্ন্যাসী ফা- হিয়ান ৩৯০ খৃষ্টাব্দ অর্থাৎ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় সারানাথ দর্শনে আসেন সারানাথে ৪টি স্তূপ এবং দুইটি মঠ ছিল বলে তিনি বর্ণনা করেন। তার বর্ণনা থেকে জানা যায় ধর্মরাজিকা স্তূপটি বেশ বড় ছিল এবং ধামেক স্তূপের নকশায় নানা রকম ফুলের কাজ করা ছিল। তবে ক্রমাগত হুনদের আক্রমণে দুর্বল হতে শুরু করে গুপ্ত সাম্রাজ্য। তার প্রভাব সারানাথের উপরে এসেও পরে। বলা হয় সারানাথের স্মৃতিস্তম্ভ এবং মুর্তি গুলো হুনদের আক্রোশের থেকে মুক্তি পায়নি। এখন গুপ্ত যুগের পরের কথা বলছি। গুপ্তদের পর বর্ধন রাজবংশের শাসনের আওতায় চলে আসে উত্তর ভারতের কিছু অংশ। ভাবুক রাজা হর্ষবর্ধনকে আমরা সবাই চিনি। তিনি সপ্তম শতাব্দীতে সারানাথের মেরামতের কাজে হাত দিয়েছিলেন। আর হর্ষবর্ধনের সময় চিনা সন্যাসী হুয়েন সাং ভারতে এসেছিলেন। তার লেখা থেকে স্পষ্টতই জানতে পারা যায় ধর্মরাজিকাস্তূপ বা অশোকস্তম্ভ আয়নার মত চকচক করতো এবং এই স্তূপ স্তম্ভ বর্ণনার সময় তিনি বিখ্যাত মৌর্য পোলিশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়াও মঠে প্রায় ১৫০০ জন সন্যাসী বাস করতেন এমন মতামত দিয়েছিলেন তিনি। তিনি আরও বলেন মূল মন্দিরে একটি চাকা ঘুরানো বুদ্ধের এক বিশাল লোহার মূর্তি ছিল। এরপর পাল রাজারা আসলো। তারা বৌদ্ধ ধর্মকে শুধু পৃষ্ঠপোষকতাই দান করেননি নিজেদের মধ্যে ধারণও করেছিলেন। ১০১৭ সালের আগ পর্যন্ত পাল রাজারা ক্রমাগতভাবে এই সারানাথের দায়িত্ব নেন।
অনেকে বলেন মোহাম্মদ গজনী বেনারস যখন আক্রমণ করেন তখন হয়তো সারানাথের কিছু অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এর পর গহরওয়াল রাজ বংশের শাসক নিজেকে কনৌজ অযোধ্যার এবং বেনারসের রাজা ঘোষণা করেন। তার রানী কুমার দেবী ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তিনি সারানাথে ধর্ম চক্র জিনাবিহা নামে এক বিশাল মঠ তৈরি করেছিলেন। গহরওয়াল রাজবংশ বর্তমান উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের অধিকাংশ অঞ্চলই শাসন করতো। সারানাথে রয়েছে চৌখণ্ড – স্তূপ নামে বিশাল এক স্মৃতিস্তম্ভ। ইটের এই স্তূপটি বেশ লম্বা এবং বুরুজটি অষ্টভূজাকৃতি।
মজার বিষয় হল এই অষ্টভূজাকৃতি বুরুজটি আকবরের দরবারে সুবেদার রাজা টেডামলের- পুত্র গোবর্ধন ১৫৮৮ সালে তৈরি করেন। সম্রাট হুমায়ূনের বিজয় উপলক্ষে তার স্মরণে এই মোঘল স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি হয়েছিল। বেনারসের রাজা চেতন- সিং এর দেওয়ান জগৎ সিং কিন্তু সারানাথের রক্ষার বদলে ধ্বংসই ডেকে এনেছিল। তিনি নিজের নামে একটি বাজার তৈরি করতে চেয়েছিলেন। যার জন্য তার ইট পাথরের দরকার ছিল এবং সেই ইট পাথর তিনি জোগাড় করেছিলেন এই ধর্মরাজিকা স্তূপ থেকে। তারপর লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে যায় এই অঞ্চলটি। ১৮১৫ সালে ভারতের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল কর্নেল কলিন ম্যাকেঞ্জি- যথাযথভাবে সারানাথ খনন করা শুরু করেন।
ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের জনক আলেকজান্ডার কানিংহামও এই খননকার্য চালাবার সময় তার সাথে ছিল। আলেকজান্ডার কানিংহাম খননকাজ চালাবার সময় একটি বাক্স খুঁজে পেয়েছিলেন। বেলে পাথরের বৃত্তাকার বাক্সের ভিতরে ছিল মার্বেলের একটি নলাকার বাক্স। যাতে হাড়, সোনা, রুপার অলংকার, মুক্তা এবং রুবি রাখা ছিল৷ পরবর্তীতে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলকে কানিংহাম এটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। ১৯২১-২২ সালে দায়ারাম- সাহনি আবার এটিকে খনন শুরু করেন। ভাষ্কর্য , পাথরের ছাতা এবং অন্যান্য বেশ কিছু বস্তু সারানাথে খনন কাজের মাধ্যমে পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো সারানাথ যাদুঘরে আজ রাখা রয়েছে। পোড়ামাটির প্রতিলিপি স্থাপনের মাধ্যমে শতশত বছর আগে এই অঞ্চলটি কেমন ছিল তা দেখানোর চেষ্টা করেছে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। ধর্মরাজিকা স্তূপ, ধামেক স্তূপ, অশোকস্তম্ভ এবং মঠের ধ্বংসাবশেষ, বৌদ্ধ ধর্মের ক্রম বিকাশ গুলোকে তুলে ধরে। সারানাথকে তাই ভারতের বৌদ্ধ জগতের এক সম্পূর্ণ ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এখানেই সমগ্র বৌদ্ধ বিশ্ব আলোকিত হয়েছিল।