যদি ভবিৎষতে কোন দুর্ঘটনা, যুদ্ধ, নাশকতা, মহামারী অথবা প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে বিশ্বের কোন শস্য-বীজের সম্পূর্ণ বিলুপ্ত ঘটে, তখন কি হবে? আবারো ঐ শস্য ফলনের জন্য বীজ কোথায় পাওয়া যাবে?
এই সমস্যা সমাধানে নরওয়ের সরকার দেশটির উত্তরে স্ভালবার্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চল স্পিটসবার্গেন দ্বীপে নির্মাণ করে বিশ্ব বীজ সংরক্ষণাগার। এর ধারণ ক্ষমতা সাড়ে চার কোটি বিভিন্ন বীজের নমুনা। দীর্ঘ কাল সময়ের জন্য এখানে বীজ সংরক্ষণ করা যায়। এই সংরক্ষণের সময়কাল হতে পারে সহস্রাধিক বছরও। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০০৬ সালের ১৯শে জুন একসাথে মিলিত হয়ে এই বীজ সংরক্ষন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড , ডেনমার্ক এবং আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীরা। এটির সম্পূর্ণ নির্মাণ ব্যয় এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নরওয়ে সরকারের।
স্পিটসবার্গেন দ্বীপটি বেছে নেবার প্রধান কারণ হলো, এই এলাকাটির ভূগর্ভ চিরহিমায়িত এবং ভূমিকম্প সতর্কতামুক্ত। সংরক্ষণাগারটি নির্মাণ করা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩০ মিটার বা ৪৩০ ফুট উপরে বেলে পাথরের পাহাড়ের ভেতরে। সম্পূর্ণ স্থাপনাটিকে পাহাড়ে এমনভাবে প্রোথিত করা হয়েছে যে, এটির প্রবেশ দ্বার এবং আংশিক ছাদ পাহাড় থেকে কিছুটা বের হয়ে এসেছে। এটির ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে এটিকে দেখা যায় অনেক দূর থেকে। উত্তর গোলার্ধের সব বরফ গলে গেলেও এই স্থাপনাটি থাকবে সবসময় শুষ্ক এবং জলমুক্ত।
সংরক্ষণ কক্ষের তাপমাত্রা সব সময় রাখা হয় মাইনাস আঠারো (-১৮) ডিগ্রী সেলসিয়াসে বা -০.৪ ফারেনহাইটে। কক্ষগুলোতে অক্সিজেনের পরিমান রাখা হয় অনেক সীমিত পরিমানে, যাতে বীজগুলো সজীব হয়ে শিকড় ছাড়তে না পারে। অক্সিজেনের পরিমান কম থাকায়, বীজগুলো নষ্ট হতে সময় নিতে পারে কয়েক শো থেকে কয়েক হাজার বছর। বীজগুলোকে রাখা হয় বায়ুরোধী বা এয়ারটাইট তিন-স্তর বিশিষ্ট অ্যালুমিনিয়ামের থলেতে। একটি থলেতে রাখা যায় একই রকমের পাঁচ শো বীজ। অবশ্য এটি নির্ভর করে বীজের আকারের উপর। থলেগুলোকে রাখা হয় ধাতবনির্মিত তাকে রক্ষিত সারি-সারি এয়ারটাইট প্লাস্টিকের বড় পাত্রে। এখানে সার্বখানিক কোন কর্মী থাকে না, থাকার প্রয়োজনও নেই। এখানে সবই চলে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় এবং রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে।
দ্বীপের প্রাকৃতিক কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে চালানো হয় সংরক্ষণাগারকে হিমায়িত রাখার রেফ্রিজেরেটর ব্যবস্থাকে। এটিকে সার্বক্ষণিক মাইনাস ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হিমায়িত রাখার প্রধান কারণ হলো, যদি হিমায়িত রাখার ব্যবস্থাগুলো, যেমন, রেফ্রিজেরেটর কোন কারণে অকেজো হয়ে পড়ে এবং সেগুলো মেরামতেরও অযোগ্য হয়ে পড়ে, তাহলে স্থাপনাটির তাপমাত্রা বেড়ে শূন্য ডিগ্রী সেলসিয়াতে (৩২ ফারেনফাইট) পৌঁছাতে সময় লাগবে কমপক্ষে দু’শো বছর।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এই ভল্টটি বিভিন্ন বীজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে শত শত বছর। তবে, এটির কোন কোন বীজকে সংরক্ষণ করার ক্ষমতা কয়েক হাজার বছর। বিশ্বের সব অঞ্চল থেকেই বীজ সংগ্রহ করে এই ভল্টে রাখা হয়। যে কোন দেশ তাদের বীজ এখানে সংরক্ষণ করতে পারে। নরওয়ের সরকার এই স্থাপনাটির মালিক। যারা বীজ সরবরাহ করেছে তারাই বীজের স্বত্বাধিকারী। এটি যে কোন অব্যবস্থাপনা, দুর্ঘটনা, রেফ্রিজেরেটরের ব্যর্থতা, অর্থের অভাব, সর্বাত্মক নাশকতা, রোগ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিশ্বে কোন বীজের সম্পূর্ণ বিলুপ্ত ঘটলে, এই সংরক্ষণাগারটি বিশ্বে বীজ সরবরাহ করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
সংরক্ষণটির ছাদ এবং প্রবেশদ্বার নির্মাণ করা হয়েছে এমন সব চকচকে স্টেইনলেস স্টীল, বিশাল আয়না, এবং প্রিজম দিয়ে, যাতে এগুলোর উপর আলো প্রতিফলিত হয় অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে। অনেক দূর থেকে এই উজ্জ্বল আলো দেখে এর অবস্থান জানা যাবে সহজেই। নরওয়ের গ্রীষ্মের মাসগুলোতে উত্তর মেরুর আলো প্রতিফলিত হয় এই প্রবেশ দ্বার এবং ছাদের উপর। আবার শীতকালে দু’শোটি ফাইবার-অপ্টিক তারের একটি নেটওয়ার্ক সংরক্ষণটির প্রবেশ দ্বারের উপর ফেলে এক নিঃশব্দ সবুজ-ফিরোজা এবং সাদা আলোর বিচ্ছুরণ করা হয় চব্বিশ ঘন্টা। এই আলো দেখা যায় ঐ এলাকার দিগন্ত জুড়ে। উদ্দেশ্য, যাতে এর অবস্থান সহজে দেখা যায় অনেক অনেক দূর থেকে।
এই ভল্টটি ২০০৮ সালে টাইম ম্যাগাজিনে ষষ্ঠ “সেরা উদ্ভাবন” হিসেবে স্থান পায়। গত ৫০ বছরে এটি ছিল বিশ্বের ১০তম সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রকল্প। শুধু তাই নয়, এই প্রকল্পের দুই প্রধান অবদানকারী, ডঃ জাফরী হটিন এবং ডঃ ক্যারি ফওলার, বীজ সংরক্ষণে তাদের অসাধারণ নেতৃত্বর জন্য সম্প্রতি পেয়েছেন “বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার -২০২৪”
তথ্যসূত্র: “The History,” Svalbard Global Seed Vault. 4 July 2017.