ধুলোমাখা বই থেকে চকচকে ডিভিডি। দাদুর আলমারি থেকে নাতির আই-প্যাড। জেনারেশন থেকে জেনারেশনে তাঁর অবাধ বিচরণ। গোয়েন্দা-গ্রহের ধ্রুবতারা। বাঙালি নন, কিন্তু বাঙালি মননে অনায়াসে থাকেন। বাংলা কেন, গোটা পৃথিবীর গোয়েন্দাকুলের প্রপিতামহ। তিনি শার্লক হোমস। আজও যাঁকে পাওয়া যায় ২২১বি বেকার স্ট্রিটে!
সেও ছিল এক শীতের সকাল। ক্রিসমাস আসেনি তখনও, উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহর। তারই মধ্যে এল হাড়হিম খবরটা। খুন! শহরের এক অভিজাত ফ্ল্যাটে! বিরাশি বছরের বৃদ্ধা মারিয়ন গিলক্রিস্টকে কে খুন করেছে তাঁর বাড়িতেই। খুনের বীভৎসতা দেখে শিউরে উঠল পুলিশও। হাতুড়ির মতো কোনও কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে মুহুর্মুহু। এত বার, এমন তীব্র আক্রোশে মারা হয়েছে, অটপ্সির জন্য তোলা ফোটোগ্রাফ দেখে বোঝা যাচ্ছে না, ওটা একটা মানুষের মুখ ছিল!
বৃদ্ধা রীতিমতো ধনী ছিলেন। বিস্তর টাকাপয়সা, অলঙ্কার ছিল ঘরে। পরিচারিকাটি খুঁজেপেতে পুলিশকে জানাল, একটা মহার্ঘ ব্রোচ গায়েব। কাস্তে আকারের চাঁদের মতো দেখতে, ধার বরাবর এক সারি হীরে বসানো! ১৯০৮ সালে, আজ থেকে ১১১ বছর আগে ওই খাঁটি জিনিস চুরি যাওয়ার অর্থ পরিষ্কার। ওটা বাগানোর জন্যই হত্যা করা হয়েছে হতভাগ্য অশীতিপরকে। কিন্তু, খুনি কে?
আহাহা, যেন জানো না! এ আবার মুখে বলে দিতে হয় না কি? কিছু দিন আগেই শহরে এসেছে এক বিদেশি। এই ঠান্ডার দেশের, ফ্যাকাশে গোলাপিরঙা স্কটিশদের ভিড়ে একেবারে বেমানান এক জন। কালো চুল, গোঁফ। ব্যাটা জার্মান ইহুদি, ছ্যা ছ্যা! আর চরিত্র? না বলাই ভাল। জুয়ার ঠেকে, সস্তা সহজলভ্য বিনোদনের জায়গাগুলোতে ঘোরে-ফেরে। নিষিদ্ধপল্লিতেও যায় নিশ্চয়ই! এ সব চোরছ্যাঁচোড় না হয়ে যায়? তক্কে তক্কে থাকো, নজর রাখো!
আর নজর রাখতেই, দেখাও গেল, অস্কার স্লেটার নামের এই পরদেশিও একটা ব্রোচ বন্ধক রেখেছে শহরের এক দোকানে! আর যায় কোথা। পরিচারিকা, অন্য লোক সাক্ষী দিল, এই লোকটাই চোর। এ-ই খুনি! পুলিশ পিছু নিল। লোকটা আমেরিকা গিয়েছিল, সেখানে পর্যন্ত ধাওয়া করে, ধরে আনল স্কটল্যান্ডে। অতঃপর হাজত এবং আদালত। সেখানেও বিচারপর্ব অতি সংক্ষিপ্ত এবং সক্রিয়। ব্রোচের লোভ+হত্যার পাপ= দুয়ে দুয়ে চার, মৃত্যুদণ্ড! ফাঁসিই হত অস্কারের, দ্বিধাবিভক্ত নাগরিকদের একাংশ সইসাবুদ জোগাড় করে রাজার কাছে পাঠাল, রাজা শেষ মুহূর্তে তাকে আজীবন (কুড়ি বছর) কারাদণ্ডে পাঠালেন পিটারহেড-এর অতিকায়, খাঁ-খাঁ এক দুর্গ-কারাগারে। ক্যালেন্ডারে তখন ১৯০৯ সাল।
এক, দুই, তিন, ছয়, নয়-নয় করে আঠেরোটা বছর চলে গেল পাথরের চাঁই ভাঙতে ভাঙতে, টুকরো রুটি আর বিস্বাদ ঝোল খেয়ে। ১৯২৭ সালের এক দিন, হঠাৎই দরজা খুলে গেল সেল-এর। অস্কার স্লেটার, তুমি মুক্ত! কেন? কী করে? এক সাহেব ওর ‘কেস’টা হাতে নিয়েছিলেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন জেলের বাইরে অস্কারের আইনজীবীকে। তাতেই এসেছে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি! তবে হ্যাঁ, বছর দুয়েক আগে অস্কার নিজেও জেল থেকে লুকিয়ে পাঠিয়েছিল এসওএস, ওই সাহেবকেই। প্যারোলে ছাড়া-পাওয়া এক সহবন্দির নকল দাঁতের ফাঁকে গোঁজা কুচি কাগজে লিখে দিয়েছিল, আমি নির্দোষ, দয়া করে বাঁচান আমাকে!
সাহেব মস্ত লেখক, ওঁর বই বাজারে বিকোয় হুহু করে। ওঁর কাহিনির নায়কের বুদ্ধি ক্ষুরধার, পর্যবেক্ষণ নিখুঁত, যুক্তিবোধ অতুলন। তাই বহু মানুষই সাহেবকে অনুরোধ করেন, আমার পরিবারে অমুক হারিয়ে গেছে, তমুক মারা গেছে; আসল রহস্যটা কী, একটু দেখবেন? অস্কার জেলে যাওয়ার দু-তিন বছরের মাথাতেই সাহেব এই কেসটা নিয়ে লেগে পড়েছিলেন। সাক্ষ্যপ্রমাণ, পুলিশ রিপোর্ট, নথিপত্র-ভর্তি ফাইল ঘেঁটে জলদি বুঝেও যান, গোটা কেসটাই সাজানো। নিয্যস অবিচার হয়েছে অস্কারের উপর। চুরি-যাওয়া ব্রোচ আর অস্কারের বন্ধকি ব্রোচ এক নয়, একেবারে আলাদা। অস্কারের ব্যাগে পাওয়া নিরিমিষ হাতুড়ি দিয়ে ও রকম আঘাত করা যাবেই না, বলেছিলেন এক ডাক্তার— তাঁকে সাক্ষী হিসেবে রাখাই হয়নি! সাক্ষ্য পাল্টানো হয়েছে, প্রমাণ চেপে যাওয়া হয়েছে, সত্যকথনের শপথ নিয়েও মিথ্যে বলা হয়েছে আদালতে— স্রেফ অস্কারকে ফাঁসাতে। পুলিশ, সরকারপক্ষের আইনজীবী সব জানত, জেনেও একটা নির্দোষ লোককে শুধু কাঠগড়াতেই তোলেনি, আদালতকে প্রভাবিত করে তাকে প্রাণে মেরে দিচ্ছিল! আর এত সব কিছুই— অস্কার স্লেটার আন-দেশের, ভিন্-ধর্মের লোক বলে! ইহুদি বলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে, তা বলে জাতিবিদ্বেষ থেমে থাকবে কেন? বেজাত, বিধর্মী লোক ভয়ের কারণ, এই ধুয়ো তোলা সমষ্টির পক্ষে অতি সহজ। আর পুলিশ বা বিচারব্যবস্থা তাতে পোঁ ধরলে তো পোয়াবারো! মার ওকে। চুরি, ডাকাতি, খুনের কেস সাজা। জেলে ভর। ফাঁসি দে। পরিস্থিতিটা চেনা লাগছে? একুশ শতকেও তো এই ঘটনা অহরহ!
অস্কার স্লেটারও মরেই যেত। তাঁকে বাঁচালেন সেই সাহেব। তিনি পুলিশ নন, গোয়েন্দা নন, বিচারকও না। কিন্তু মানুষটার বড় একটা মন ছিল। গরিবদুঃখী, বা অবিচারের শিকার মানুষের দুঃখে যে মনটা দ্রব হত। আর ছিল তাঁর গোয়েন্দা-কাহিনির নায়কের মতোই, খর বুদ্ধি-যুক্তিতে শক্তিমান মগজাস্ত্র। এহেন মন আর মাথাই এক হয়ে, বাঁচিয়েছিল অস্কারকে।
সাহেবের নামটা যে ‘স্যর আর্থার কোনান ডয়েল’, এর পরেও সেটা বলে দিতে হবে?
বই বা সেলুলয়েডের গোয়েন্দা চরিত্রদের মধ্যে শার্লক হোমস সর্বকালের সেরা। ক্ষুরধার বুদ্ধি, অসম্ভব অন্তর্দৃষ্টি শার্লককে ভক্তগণের মাঝে গোয়েন্দার থেকেও বেশি নায়ক করে রেখেছে। কিন্তু প্রায় সব গোয়েন্দা চরিত্রগুলির মতো শার্লকও কি কোনান ডয়েলের শুধুমাত্র ভাবনার ফসল? শার্লক হোমসের আগমন বাস্তব থেকেই। লেখক আর্থার কোনান ডয়েলের মাথায় ছিলেন তাঁরই কলেজের প্রফেসর।
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে জোসেফ বেল নামক এক প্রফেসরের ক্লাস, কোনান ডয়েলের বড় প্রিয় ছিল। প্রফেসর ছাড়াও জোসেফ ছিলেন একজন চিকিৎসক। ১৮৭৭-৭৮ সালে লেখক ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। পরবর্তীকালে কোনান জানান, বড়ই চিত্তাকর্ষক ছিল প্রফেসরের এক একটা ক্লাস।
নিজের বিশেষ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে যাচাই করতে বেল ছিলেন শ্রেষ্ঠ। কোনও মানুষকে দূর থেকে একবার দেখেই লোকটির আপাদমস্তক বিচার করতে পারতেন এই প্রফেসর। কোনও মানুষের অঙ্গবিন্যাস, উপস্থিতি, এক নিমেষে তাঁর স্বভাব ইত্যাদি দেখে সহজেই তিনি ব্যক্তির খুঁটিনাটি সম্বন্ধে ধারণা করতে পারতেন। ছাত্র এবং তাঁর রোগীদের কাছে তাঁর এই বিচক্ষণ ক্ষমতা ছিল ম্যাজিকের মতো।
ছাত্রদের তিনি বলতেন, প্রখর পর্যবেক্ষণ যে কোনও রোগ নির্ধারণে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করে। তারপর আর্থার কোনান ডোয়েলের কাছে আসে প্রিয় প্রফেসরের সহকারী হওয়ার সুযোগ। বহু বছর এই প্রফেসরের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পান কোনান ডয়েল। এর মাঝেই তাঁর মাথা থেকে বেরিয়ে পড়ে শার্লক হোমস। শার্লক হোমসের সবকিছুই ছিল ডয়েলের মস্তিস্ক প্রসূত। কিন্তু কেস সমাধান করার কিছু কিছু সূত্র তাঁকে দিয়ে দিতেন গুরু জোসেফ বেল। একদা আর্থার হোমস নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে, ‘এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের এক প্রফেসরকে কল্পনা করে আমার শার্লক হোমস লেখা।’
ডয়েল একবার জোসেফ বেলকে লিখেছিলেন, “আপনার জন্যই আমি শার্লক হোমস চরিত্রের সৃষ্টি করতে পেরেছি।” প্রত্যুত্তরে বেল বলেছিলেন, “তুমি নিজেই শার্লক হোমস, আর সে কথা তোমার থেকে ভাল আর কেউ জানে না।”