এক সময় ছিল, যখন ইউরেশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডজুড়ে চারটি মহাশক্তি পাশাপাশি টিকে ছিল—হান, কুশান, পার্থিয়া আর রোমান সাম্রাজ্য। দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তারা তুলনাহীন শান্তি ও সমৃদ্ধির আবহে বাস করেছিল। তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ খুব কমই হতো, বরং সিল্ক রোডের পথে চলত অবাধ বাণিজ্য। ইতিহাস সেই সময়কে বলে—প্রথম বিশ্বায়নের যুগ।
সেই সিল্কের রাস্তায় শুধু পণ্যই নয়, চলত মানুষ, নতুন নতুন ভাবনা, শিল্প-সংস্কৃতি, এমনকি রোগবালাইও। প্রথম আর দ্বিতীয় শতকে ইউরোপ ও এশিয়ার এই সাম্রাজ্যগুলো যেন উজ্জ্বল এক সোনালি যুগে প্রবেশ করেছিল। পূর্বে চীনের হান রাজবংশ তখন সমৃদ্ধির শীর্ষে। তাদের রেশম, কাগজ, চীনামাটির বাসন আর অন্যান্য অমূল্য জিনিস সিল্ক রোড ধরে পশ্চিমা দুনিয়ায় পৌঁছে যেত।

সিল্ক রোডের ম্যাপ Source: TheCollector
দক্ষিণে ভারতের উত্তরে কুশান সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছিল ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র, যেখানে পূর্ব-পশ্চিমের বণিকেরা মিলিত হতো। মাঝখানে পার্থিয়া শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করত মেসোপটেমিয়া থেকে ইরানের মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল, যা ছিল সিল্ক রোডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাঝপথ। আর পশ্চিমে, রোমান সাম্রাজ্য তখন তিনটি মহাদেশ জুড়ে তার ক্ষমতা ছড়িয়ে দিয়েছিল, ভূমধ্যসাগরকে করেছে নিজের আঙিনার মতো।
এই চার শক্তির যুগকে ইতিহাস মনে রাখে “সাম্রাজ্য যুগ” নামে। কারণ তখন প্রথমবারের মতো মানুষ, পণ্য, সংস্কৃতি আর চিন্তাধারা এত সহজে, এত দ্রুত আর এত দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। যেন পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্লোবাল গ্রাম গড়ে উঠেছিল সেই সিল্কের পথে।

মাটির তৈরি কেন্দ্রীয় প্রহরী টাওয়ারের মডেল (খ্রিস্টীয় ১ম–প্রারম্ভিক ৩য় শতক), সংগ্রহশালা: মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট।
শুরু হয় হাজার বছরের আগের সেই সময়ে, যখন হান সেনারা শিয়াননুকে পরাজিত করল। শিয়াননুরা তখন তাদের প্রতিবেশী ইউয়েজির দিকে নজর দিল। ইউয়েজিরা পশ্চিমের দিকে রওনা হল এবং খ্রিস্টপূর্ব ১২৮ সালে হেলেনিস্টিক বাকত্রিয়ার ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করল। তারা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে সেই অঞ্চলে শক্তি সংহত করে রাখল। প্রথম শতকের মাঝামাঝি, ইউয়েজিরা কাশ্মীর এবং উত্তরপশ্চিম ভারতের দিকে অগ্রসর হয়। তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে কুশান সাম্রাজ্য, যা বর্তমানের আফগানিস্তান, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং ভারতের উত্তরাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। কুশান রাজারা ছিলেন সংস্কৃতির প্রকৃত মেলবন্ধনকারী। তারা হেলেনিস্টিক, পারস্য ও ভারতীয় সংস্কৃতিকে একত্রিত করল। গ্রিক লিপি ব্যবহার শুরু করল, গ্রিক মুদ্রার মডেল অনুযায়ী কয়েন ছাপাল এবং স্থানীয় ধর্ম ও প্রথা গ্রহণ করল। তারা গ্রিক দেবতা, জোরোয়েস্ট্রিয়ানিজম, বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দুধর্মের মিল ঘটাল। দ্বিতীয় শতকে কুশান সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়ে চীন ও পার্থিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছায়। তারা সিল্ক রোডে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। ইন্দাস উপত্যকার বার্বারিকাম বন্দর রোম, ভারত ও চীনের মধ্যে পণ্যের আদানপ্রদানের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এইভাবে কুশানরা শুধু সাম্রাজ্য নয়, একটি বহুসাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক চেতনার গল্পও রচনা করে।
অন্যদিকে, পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত একসময় ছড়িয়ে ছিল সেলিউকিড সাম্রাজ্য। কিন্তু বারবার যুদ্ধ করতে করতে সেই সাম্রাজ্য ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে। ঠিক সেই সময়, খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে, পারনি নামে এক যাযাবর গোষ্ঠী তাদের নেতা আর্সেসেসকে নিয়ে পার্থিয়া প্রদেশ দখল করে নিল। এভাবেই শুরু হলো এক নতুন শক্তির উত্থান। পরের শতকগুলোতে তারা ধীরে ধীরে আরও অনেক অঞ্চল দখল করতে লাগল। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮ সালের মধ্যে তাদের রাজ্য বিস্তৃত হলো ইউফ্রেটিস নদী থেকে দূরের বাকত্রিয়া পর্যন্ত। আর্সাসিড রাজারা এক অদ্ভুত মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে তুললেন। পারস্যের ঐতিহ্য, গ্রিকদের হেলেনিস্টিক ধারা আর স্থানীয় সংস্কৃতি—সব মিলিয়ে পার্থিয়ান সমাজ দাঁড়াল এক অনন্য রূপে। প্রথম শতকের শেষের দিকে তারা পরিণত হলো এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যে।
তাদের আসল শক্তি ছিল দুই জিনিসে—সিল্ক রোডের নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্দান্ত ঘোড়সওয়ার বাহিনী। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩ সালে কার্হায়ের যুদ্ধে পার্থিয়ানরা রোমান সেনাদের মুখোমুখি হয়। সেখানে তারা এমন ভয়ংকর আঘাত হানে যে রোমান কমান্ডার মার্কাস লিসিনিয়াস ক্রাসাস প্রাণ হারান। যদিও পরবর্তীতে নানা দুর্যোগ, অভ্যন্তরীণ রাজবংশীয় কলহ আর রোমানদের চাপ তাদের কষ্টে ফেলেছিল, তবুও তারা সিল্ক রোডের মাঝের অংশে বহুদিন প্রধান শক্তি হিসেবে টিকে রইল। অবশেষে, তৃতীয় শতকে এসে, সেই গৌরবময় পার্থিয়ান সাম্রাজ্য সাসানিয়ানদের হাতে পতিত হলো। পার্থিয়ার গল্প তাই এক সেতুবন্ধনের ইতিহাস—যেখানে পূর্ব ও পশ্চিম এসে মিলেছিল এক মহাসড়কের মতো।

খ্রিস্টীয় প্রায় ৩য় শতকের দেবতা জিউস, সেরাপিস বা আহুরা মাযদা এবং উপাসকের প্যানেল চিত্র, সংগ্রহশালা: মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট।
একই সময়ে, ভূমধ্যসাগরের পশ্চিম প্রান্তে গড়ে উঠেছিল এক অদম্য শক্তি—রোমান সাম্রাজ্য। প্রথমে তারা কারথেজকে পরাজিত করল, আর সেই জয়ের পর পুরো ভূমধ্যসাগর যেন তাদের দখলে চলে এল। এরপর তাদের চোখ পড়ল পূর্বের ধনী ও ঐশ্বর্যময় হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলোর দিকে। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে পম্পি দ্য গ্রেট সিরিয়ায় সেলিউকিডদের শেষ শক্তিকে ধ্বংস করে দিলেন। কয়েক দশক পরে, খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালে অক্টেভিয়ান—যিনি পরে সম্রাট অগাস্টাস নামে পরিচিত হন—অ্যাকটিয়ামের যুদ্ধে টলেমি নৌবাহিনী ভেঙে দিলেন। আর এক বছরের মধ্যেই রোম দখল করে নিল সমৃদ্ধ মিশরকে।
রোমের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু তারা চাইলেও পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের বাধা পুরোপুরি ভাঙতে পারল না। তার ওপর আবার পামফিরা আর নাবাতীয় রাজ্য রোমের বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছিল। তবে সময় বদলাল। খ্রিস্টীয় ১০৫ সালে সম্রাট ট্রাজান নাবাতীয়দের রোমান সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করলেন। আরও পরে, তৃতীয় শতকে সম্রাট অরেলিয়ান শক্ত হাতে দখল করলেন পামফিরাকে। কিন্তু তখন পার্থিয়ার পরিবর্তে শক্তিশালী সাসানিয়ান সাম্রাজ্য উঠে এসেছে। তাই রোম তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিল ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যের দিকে। প্রতি বছর শত শত জাহাজ ভেসে যেত ভারতের উদ্দেশে, ফিরত রেশম, মসলা আর দামী রত্নভাণ্ডার নিয়ে।
কিন্তু সিল্ক রোডের পথ কখনোই সহজ ছিল না। খ্রিস্টীয় ১১৬ সালে ট্রাজানের সেনারা একসময় পারস্য উপসাগর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু সম্রাটের মৃত্যুর পর সেই অগ্রযাত্রা থেমে গেল। ১৩০ সালে হান সাম্রাজ্যের সৈন্যরাও মধ্য এশিয়ার সীমান্ত ছেড়ে ফিরে এলো। পশ্চিমে এদিকে রোম ও পার্থিয়ার সম্পর্ক আবার খারাপের দিকে গেল, আর ১৬৩ সালে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধের ভেতরেই এক ভয়ংকর বিপর্যয় এসে পড়ল—মহামারী। সিল্ক রোডের পথে পথেই রোগ ছড়িয়ে পড়ল, কয়েক বছরের মধ্যেই তা রোম থেকে হান পর্যন্ত পৌঁছে গেল। সাম্রাজ্যগুলোর অর্থনীতি ভেঙে পড়ল, মানুষ কমে গেল, নগরগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়ল।

খ্রিস্টীয় ১ম থেকে ৩য় শতকের পার্থিয়ান ঘোড়সওয়ার তীরন্দাজের সেরামিক রিলিফ প্লেক, সংগ্রহশালা: ব্রিটিশ মিউজিয়াম।
দ্বিতীয় শতকের শেষ দিকে এসে দেখা গেল, রোম, হান, পার্থিয়া আর কুশান—সব শক্তিশালী সাম্রাজ্যই সংকটে কাঁপছে। তৃতীয় শতকের শুরুতে হান আর পার্থিয়া ভেঙে পড়ল। তবুও সিল্ক রোড থেমে রইল না। ঝড়ঝাপটা, যুদ্ধ কিংবা মহামারীর মাঝেও সেই বাণিজ্যের পথ বয়ে চলল—যেন ইতিহাসের শিরায় প্রবাহিত রক্তধারা।
হান, কুশান, পার্থিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস প্রমাণ করে, সিল্ক রোড ছিল শুধু বাণিজ্যের পথ নয়, মানবসভ্যতার প্রথম বৈশ্বিক সংযোগের প্রতীক। যুদ্ধ, মহামারী কিংবা সাম্রাজ্যের পতন সেই প্রবাহকে থামাতে পারেনি। আজকের বিশ্বায়নের ধারণা আসলে শেকড় গেড়েছিল সেই প্রাচীন রেশমের পথে—যেখানে পণ্য, সংস্কৃতি ও মানুষের মিলনে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর প্রথম গ্লোবাল ভিলেজ।

খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে ব্রুন্ডিসিয়ামে (Brindisi) তৈরি অগাস্টাসের সোনার মুদ্রা, দক্ষিণ ভারতের পুদুকোটাই-এ পাওয়া, সংগ্রহশালা: ব্রিটিশ মিউজিয়াম।