ভারতীয় মুঘল স্থাপত্য কলা গুলো উপরের বক্তব্যের প্রমান হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে l মোগল সম্রাটরা প্রেমের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন কিছু উপহার আমাদের দিয়েছে l হ্যা,এই নান্দনিক উপহারগুলি সম্রাটরা তাদের প্রিয় জনের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করার জন্য তৈরি করেছিলেন। আর এই স্থাপত্যগুলি কেবল সম্রাট বা সম্রাজ্ঞীর স্মৃতিতে নিবেদিত ছিল না, তাদের বাবা-মা, বাচ্চাদের এবং অন্যান্য জীবন্ত প্রাণীদের জন্যও তৈরি করা হয় l চলুন দেখে আসি স্থাপত্য গুলো l
তাজমহল
ভারত এবং সারাবিশ্বের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই স্মৃতিসৌধটি….প্রেমের এক স্মৃতি ফলক হিসেবে। প্রেমের উদাহরন হিসেবে তাজমহলকে সবসময় তুলে ধরা হয়। এটা মুঘল শক্তি ও স্থাপত্যের একটা নিখুঁত উদাহরণ l বাদশা শাহজাহান তার সবচাইতে প্রিয় স্ত্রী আনজুমান্দ বানু বেগম বা মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর তার স্মৃতিটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে এই তাজমহল তৈরি করেছিলেন। তাজমহল একটা বিষ্ময়… পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য এবং আইকন হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হুমায়ুনের সমাধি
ভালোবাসার প্রতীক কি শুধুমাত্র তাজমহলই ? না, এমন আরো অনেক স্থাপনা রয়েছে যেগুলোকে আমরা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে গণ্য করতে পারি ! উদাহরণ হিসেবে আমরা বেছে নিয়েছি দ্বিতীয় মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের স্মৃতিকে জীবন্ত রাখতে তৈরিকৃত হুমায়ুনের সমাধিকে l হুমায়ুনের মৃত্যুর নয় বছর পর ১৫৬৫ সালে এটি নির্মিত হয় l এই সমাধিতে প্রথম লাল বেলে পাথরের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় l হুমায়ূনের প্রথম স্ত্রী, সম্রাজ্ঞী বেগা বেগম (যা হাজী বেগম নামেও পরিচিত) তার স্বামী হুমায়ূনের স্মরণে এই স্মৃতিসৌধটি তৈরি করেছিলেন। এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম উদ্যান-সমাধি। এ সমাধিতে পার্সিয়ান, তুর্কি ও ভারতীয় স্থাপত্যরীতির মিশ্রণও লক্ষ্য করা যায়।
হারকাবাঈ এর মহল
এখন শুরু হবে হারকাবাঈ প্রাসাদের গল্প l আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে, রাজপুতরা যেমন শত্রু হিসেবে প্রবল, তমনি মিত্র হিসাবে নির্ভরযোগ্য। আকবরের শাসনকালে তিনি তাই রাজপুতদের সাথে সন্ধি করার দিকে মনোযোগ দেন l কিছুটা যুদ্ধের মাধ্যমে এবং অনেকটাই বিবাহসূত্রের দ্বারা তিনি এই কাজে সফল হয়েছিলেন। অম্বরের রাজা ভর মল্লের কন্যা হারকাবাঈ-এর সাথে তার বিয়ে হয়। আকবরের রাজপুত স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার প্রকাশের জন্য তৈরি করা হয়েছিল হারকাবাঈএর প্রাসাদ l এটি আকবরের তৈরি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাসাদ ।
হিরণ মিনার
হিরণ মিনারটি আকবরের আরেকটি ভালবাসার নির্দশন। হিরণ নামটি শুনলে মনে হতে পারে এই মিনারটি হয়তো আকবরের হরিণের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো, কিন্তু না, তা নয়…. আসলে আকবরের হিরণ নামে একটি প্রিয় হাতি ছিল এবং এই প্রিয় হাতির স্মৃতির জন্যই তিনি এই মিনারটি উৎসর্গ করেছিলেন। এই স্মৃতিস্তম্ভটি বানাতে গিয়ে তিনি কোনো প্রকার কার্পণ্যতা করেননি। নান্দনিক সৌর্ন্দয্যে তৈরি করা এ মিনারের বাইরের দিকের প্রাচীরগুলোতে একটা করে স্পাইক বের করা হয়েছিলো….এমন ভাবে এটার ডিজাইন করা হয়েছিল যাতে মানুষ দূর থেকে দেখেও মুগ্ধ হয়ে যায়!
ইতমাদ-উদ-দৌলার সমাধি
ইতমাদ-উদ-দৌলার সমাধিটি নূরজাহান তার বাবা এবং মায়ের জন্য বানিয়েছে। এই সমাধিতে বাবা-মা‘র প্রতি নূর জাহানের ভালবাসার ছবি আঁকা রয়েছে। ইতমাদ -উদ -দৌলা জাহাঙ্গীরের স্ত্রী– নূর জাহানের বাবা ছিলেন। এই স্মৃতিসৌধটি নির্মানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, লাল বেলে পাথর থেকে আস্তে আস্তে সরে এসে নূর জাহান সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করেছিলেন। এই পর্যন্ত লাল বেলে পাথরই ছিল মুঘল স্থাপনা তৈরির একমাত্র উপাদান কিন্তু নূর জাহান তার প্রাসাদ বানাতে নিয়ে আসলেন মার্বেল পাথর। ইতমাদ-উদ-দৌলার এই প্রাসাদটিকে মিনি তাজও বলা হয়ে থাকে। পরর্বতীতে শাহাজাহান যখন তাজমহল তৈরি করেন তখন তিনি এই ইতমাদ -উদ-দৌলার প্রাসাদের কারুকাজ এবং নকশাগুলোকে তাজমহল তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন।
বিবি কা মাকবারা
আওরঙ্গজেব তার রাজত্বকালে নতুন নতুন স্থাপত্য নির্মাণে খুব একটা মনোযোগ দেননি বরং মোঘল আমলের বিভিন্ন ইমারত তৈরির ক্ষেত্রে মোঘলদের যে শান–শৈকত ছিলো তা কিছুটা কমে এসেছিল আওরঙ্গজেবের সময়কার স্থাপত্যকলার ক্ষেত্রে l ‘বিবি কা মাকবারা’ আওরঙ্গবাদ শহরে অবস্থিত মোঘলদের তৈরি ভালোবাসার আরেকটি নিদর্শন l এটি আওরঙ্গজেব তার স্ত্রী– বেগম রাবিয়া-উদ-দুরানীর স্মরণে তৈরি করেছিলেন। এই স্থাপনাটিও তাজমহলকে মাথায় রেখে তাজমহলের নক্সাকে কিছুটা অনুকরণ করে তৈরি করা হয়েছিল বলেই গঠনগতভাবে তাজমহলের সাথে এর মিল আছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুটো স্থাপনাই দুজন নারীর স্মরণে নির্মিত এবং দুজন নারীই শেষ প্রতাপশালী মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে সম্পর্কিত। তাজমহল নির্মিত হয় তার মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আর তার স্ত্রীর জন্য বিবি কা মাকবারা। দিরিলিস বেগম ছিলেন পারস্যের সাফবী রাজবংশের রাজকন্যা। তিনি পঞ্চম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তার মৃত্যুতে বিরহকাতর সম্রাট সমাধিসৌধ বানানোর কথা ভাবেন। অন্যান্য মোঘল সমাধিসৌধের মতো এরও আছে চারবাগ রীতির বাগান। মূল ভবনের উপরের সাদা গম্বুজটি ফুলেল নকশায় সজ্জিত। দেয়ালজুড়ে রয়েছে নিখুঁত প্লাস্টার ও স্টাকোর সজ্জা। পশ্চিমে রয়েছে মসজিদ আর দক্ষিণে প্রবেশপথ।