মানব ইতিহাসের প্রাচীন যুগের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার নাম শুনলে সবার আগে আসে সুমেরীয় সভ্যতা এবং সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা। এই দুটি সভ্যতাই মানবজীবনের প্রাচীন অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে কোনটি আগে গড়ে উঠেছিল তা জানার জন্য প্রত্নতত্ত্ববিদরা নানা প্রমাণ খুঁজে দেখেছেন। মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা নিদর্শন, প্রাচীন লিপি, স্থাপত্য এবং জীবনযাত্রার নানা চিহ্ন বিশ্লেষণ করে তারা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন।
সুমেরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় অর্থাৎ আজকের ইরাক অঞ্চলে। ধারণা করা হয়, এই সভ্যতার শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৪৫০০ সালে, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩১০০ সালের মধ্যে এটি সুসংগঠিত রূপ লাভ করে। সুমেরীয়রা মানবসভ্যতায় অসাধারণ কিছু অবদান রেখেছিল। তাদের উদ্ভাবিত কিউনিফর্ম লিপি ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম লেখার পদ্ধতি। এছাড়া তারা গড়ে তোলে একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসনব্যবস্থা এবং একটি অর্থ ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক সমাজ। তারা রূপা ও ব্রোঞ্জের মুদ্রা এবং পণ্যবিনিময়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালাত।

প্রাচীন সুমেরীয় লিপির নিদর্শন: পোড়ামাটির ফলকে লেখা বাণিজ্যিক দলিল © wikipedia
সুমেরীয়দের নগরজীবনও ছিল অত্যন্ত উন্নত ও বিস্ময়কর। প্রাচীন নগর যেমন এরিডু, উরুক ও উর-এ গড়ে ওঠে অনন্য স্থাপত্যশৈলী। এসব নগরে তৈরি হয় জিগুরাত নামে পরিচিত বিশাল মন্দির-টাওয়ার, যেগুলো ছিল সিঁড়িবিশিষ্ট ও চূড়ান্তভাবে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর জল ব্যবহারের মাধ্যমে তারা একটি কার্যকর সেচব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং খাদ্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে।
প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালে, তারা কিউনিফর্ম লিপির মাধ্যমে প্রশাসনিক কাজ চালানো শুরু করে—যেমন কর আদায়, হিসাব-নিকাশ রাখা ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে এই লিপিতেই লেখা হয় সাহিত্য, ইতিহাস ও ধর্মীয় গ্রন্থ। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্যকীর্তি “গিলগামেশ মহাকাব্য” এই সুমেরীয় ভাষায় রচিত হয়েছিল।
অন্যদিকে, সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার উদ্ভব ঘটে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩৩০০ সালে। এটি আজকের পাকিস্তান, ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশজুড়ে বিস্তৃত ছিল। এই সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালের দিকে তার উচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়।

সিন্ধু সভ্যতার একটি ষাঁড়ের আকারে পোড়ামাটির নৌকা, এবং মহিলা মূর্তি। কোটদিজি সময়কাল (খ্রিস্টপূর্ব২৮০০-২৬০০ অব্দ )। © wikipedia
সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম বড় কৃতিত্ব ছিল তাদের উন্নত নগরপরিকল্পনা। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর মতো শহরে একই মাপের পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি করা হয় ঘরবাড়ি, সুশৃঙ্খল রাস্তা এবং অত্যাধুনিক নর্দমা-ব্যবস্থা যা সেই সময়ের জন্য ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও ব্যতিক্রমধর্মী।
তবে সুমেরীয়দের মতো, হরপ্পীয় লিপি আজও সম্পূর্ণরূপে পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মৃৎপাত্র ও সীলমোহরে পাওয়া চিহ্নগুলো এখনও গবেষকদের কৌতূহল ও ধাঁধার বিষয় হয়ে রয়েছে। ফলে, সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম, শাসনব্যবস্থা বা সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায়নি। তবু প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, এটি ছিল একটি উন্নত ও সংগঠিত সমাজ। এরা মেসোপটেমিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্য করত যা বোঝা যায় সেখানে পাওয়া বিভিন্ন দ্রব্য থেকে।

মহেঞ্জোদাড়োয় খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত প্রত্নস্থল, সম্মুখে মহাস্নানাগার। © wikipedia
যদিও ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে দুই অঞ্চল আলাদা, তার পরেও দুই সভ্যতার মধ্যে বেশ কিছু আশ্চর্যজনক মিল ছিল। উভয় সভ্যতাই নদীনির্ভর কৃষিকেন্দ্রিক সমাজ গড়ে তোলে সুমেরীয়রা ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদী, আর সিন্ধুবাসীরা সিন্ধু নদীর জল ব্যবহার করত কৃষিকাজে। উভয় সভ্যতাতেই দূরপাল্লার বাণিজ্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধাতু, কাপড়, নানান পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
লিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য ছিল। সুমেরীয়রা মাটির ফলকে লিখে তাদের প্রশাসনিক নথিপত্র, সাহিত্য এবং ইতিহাস সংরক্ষণ করত। অন্যদিকে, হরপ্পীয়রা সীলমোহরে নানা চিহ্ন ব্যবহার করে দলিল বা বাণিজ্যিক চুক্তির চিহ্ন রাখত।
সবদিক বিচার করে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যদিও সিন্ধু সভ্যতা ছিল এক অত্যন্ত উন্নত ও বিস্ময়কর সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতাই ইতিহাসে প্রথম মহান মানবসভ্যতা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এর সূচনা সিন্ধু সভ্যতার চেয়ে আগে, এবং তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবদান মানবজাতির ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল।

